আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইংরেজ কবি বায়রন: প্রেমিক ও বিপ্লবী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
জর্জ গর্ডন নোয়েল বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪) ইংরেজ কবি। ইউরোপের রোম্যান্টিক শিল্পআন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ। রোম্যান্টিক বিপ্লবী কবি বলেই বায়রন জীবনভর ছিলেন তুমুল উদ্দাম; উদ্দাম আর নিত্যনতুন পথের অভিযাত্রী।

প্রাচীন গ্রিক উপকথার প্রেমিক লিয়েন্ডার মতো পাড়ি দিয়েছিলেন দার্দানেলেস প্রনালী ... ভ্রমন করেছেন বিস্তর ... শিখেছেন অপর জাতির ভাষা ...লিখেছেন সে ভাষার ব্যকরণ... ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অপরজাতির স্বাধিকার আন্দোলনে ...এরই ফাঁকে ফাঁকে লিখেছেন মানবমানবীর হৃদয়ে গূঢ়তম অনুভূতিসঞ্জাত গীতিকবিতা- যখন আমরা সরে যাই নিঃশব্দ কান্নায় আমাদের ভগ্ন হৃদয় থাকে বহুকাল বিচ্ছিন্ন তোমার গাল ঠান্ডা আর ফ্যাকাশে তোমার চুম্বন শীতল সত্যিই সেই প্রহর এসবের ভবিষ্যৎবানী করেছিল? উনিশ শতকের প্রথম দিককার কথা। সমগ্র গ্রিস দখল করে রেখেছিল অটোমান সাম্রাজ্য। ক্রমশ অটোমানবিরোধী ক্ষোভ দানা বাধতে থাকে গ্রিসে। ইংরেজ কবি বায়রন ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা - তিনি সেই গ্রিসীয় জনগনের সেই স্বাধিকার আন্দোলনে জীবনবাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কোরিন্থ উপসাগরটির অবস্থান মধ্যগ্রিসে; সেখানে লেপান্ত নামে একটি জায়গা আছে।

সেখানে তুর্কিনিয়ন্ত্রিত দূর্গ ছিল; মাভরোকোদাতোস ছিলেন গ্রিক সেনাপাতি, তিনি এবং বায়রন সেই লেপান্ত দূর্গ দখলের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করলেন। সময়টা ১৮২৪ সাল। বায়রন গ্রিক বিদ্রোহীদের মধ্য থেকে কয়েকজন দূর পাল্লার গোলা নিক্ষেপকারী বেছে নিলেন। আক্রমনের পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করলেন...কিন্তু, হঠাৎই ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়লেন বায়রন; ১৮২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি; স্থান: গ্রিসের মেসোলনঘি.... কবির শরীরের নানা স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল ... এভাবে মারাত্মক দূর্বল হয়ে পড়লেন তিনি । যা হোক।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু জীবন হয়তো গভীর রহস্যময়। সে কারণেই এপ্রিল মাসের গোড়ায় আবার প্রবল ঠান্ডায় গুরুতর কাতর হয়ে পড়লেন কবি। সেই সঙ্গে রক্তপাত আর কেঁপে কেঁপে প্রবল জ্বর। ১৯ এপ্রিল মারা গেলেন বায়রন ... বেঁচে থাকলে তিনি গ্রিসের রাজা হতেন।

২ অস্টাদশ শতকের শেষের কথা। লন্ডনের হলিস স্ট্রিট নামে একটা রাস্তা আছে। সে রাস্তারই ২৪ নং বাড়িতে বাস করতেন ক্যাপ্টেইন জন ম্যাড জ্যাক বায়রন। অভিজাত নাবিক পরিবারের সন্তান ম্যাড জ্যাক বায়রন । এঁরই বাবা ছিলেন সেই বিখ্যাত ভাইস অ্যাডমিরাল দি হন।

ইনি সপ্তদশ শতকে জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন। যা হোক, জুয়ার নেশা ছিল বলেই দেনায় জর্জরিত ছিলেন ক্যাপ্টেইন জন ম্যাড জ্যাক বায়রন । দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ক্যাথেরিন গর্ডন; উত্তরাধিকারসূত্রে ধনী ছিলেন ক্যাথেরিন-তিনি তার স্বামীর ঋণ শোধ করেছিলেন। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি ২৪ নং হলিস স্ট্রিট-এর বাড়িতেই এক ছেলে হল ক্যাথেরিনের।

মনে একটা দুঃখ রইল-ছেলের পায়ে খুঁত। এই ছেলেই পরে হয়ে উঠেছিল পৃথিবী কাঁপানো এক কবি ও বিশিষ্ট রোম্যান্টিক বিপ্লবী-বেঁচে থাকলে যিনি গ্রিসের রাজা হতেন । ম্যাড জ্যাক বায়রন ক্যাথেরিনের বাকি টাকা উড়িয়ে দিয়ে স্ত্রীকে ছেড়ে চলে যান! ক্যাথেরিনের অবস্থাটি কল্পনা করা যায়। তার ওপর তিনি ভুগতেন বিষন্নতায় । মেজাজের ভয়ানক তারতম্য (মুড সুইং) ছিল ক্যাথেরিনের।

তাঁর মেজাজের ধাত তাঁর বিখ্যাত পুত্রটি পরবর্তীতে পেয়েছিল সম্ভবত। যা হোক। লন্ডনে সুবিধে হচ্ছিল না-ক্যাথেরিন তাঁর ছোট ছেলেটিকে নিয়ে চলে এলেন স্কটলল্যান্ড । সেখানে অ্যাবারডিন নামে একটা জায়গা আছে; সেখানেই ছোট্ট বায়রন বড় হতে লাগল। গ্রামার স্কুলে ভর্তি হল।

পায়ের খুঁত নিয়ে ছিল ভীষন স্পর্শকাতর। কেউ কিছু বললে অমনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বায়রনের বয়েস তখন দশ। মা ছাড়াও ঘরে এক আয়া ছিল। আয়ার নাম, মে গ্রে, -সে প্রায় রাতেই দশ বছর বয়েসী বালক বায়রনের লিঙ্গ ধরে খেলা করত।

বায়রনের মতে, এটিই নাকি পরবর্তীকালে তার অতিরিক্ত কামবোধ করার অন্যতম কারণ। যা হোক। মে গ্রে-কে পরে অবশ্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই সময় দারুন এক ঘটনা ঘটল-যা কে বলে হঠাৎ করেই লটারিতে কোটি টাকা পেয়ে যাওয়া। ওর, মানে, বায়রনের বড় আব্বা (মানে, দাদার বাবা) মারা গেলেন।

বায়রনের জন্য প্রচুর ধন সম্পদ রেখে গেলেন। ক্যাথরিন ছেলেকে নিয়ে ইংল্যান্ড চলে এলেন। নটিংহ্যামশায়ার। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ। স্কুলে ভরতি হল বায়রন।

হাররো স্কুল। তখনও বোঝা যায়নি যে পায়ে খুঁত থাকলেও এ ছেলে মারাত্মক প্রতিভান। বড় হয়ে লিখবে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম দীর্ঘ কবিতা: ডন জুয়ান। শিখবে আর্মেনিয় ভাষা; লিখবে ইংরেজি-আর্মেনিয় ভাষার অভিধান ও গ্রামার ... স্কুল ও কলেজের চৌহদ্দি পেরিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন; তার আগে থেকেই সম্ভব কবিতা লিখতেন। কবিতাই তো বায়রনের আরাধ্য; বায়রন কবি-এটাই তো বায়রনের সবচে বড় পরিচয়।

কবি। কবি আর বিপ্লবী। আর, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কবিদের থাকে দুর্নিবার আকর্ষন । সব কবিরই তো তাই থাকে ...কৌতূহল জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, আনন্দ দেয়, সজীব রাখে ... কিশোর বয়েস থেকেই এর-ওর সঙ্গে প্রেম করে বেড়াতেন বায়রন। মে গ্রে নামে সেই আয়ার সঙ্গেই প্রথম শিহরন ও বিস্ময়- তবে প্রথম (দৈহিক) প্রেমটা হয়েছিল দূর সম্পর্কের দু’জন চাচতো বোনের সঙ্গে: এদের নাম ম্যারি ডাফ ও মার্গারেট পার্কার।

হাররো স্কুলে পড়ার সময় ওদের সঙ্গে পরিচয়। শরীরের স্বাদ তাদের কাছেই প্রথম পান বায়রন। অবশ্য, বায়রনের সমলিঙ্গের প্রতিও আকর্ষন ছিল। এতদিনে আমরা জেনেছি যে - এই হোমোসেক্সুয়ালিটির ব্যাপারটা মানবপ্রজাতিতে একেবারেই বিরল নয়। বায়রনের মা- ক্যাথেরিন গর্ডন থাকতেন নটিংহ্যামশায়ারের একটি বাড়িতেই।

কলেজ ছুটি হলে বায়রন ওখানেই গিয়ে থাকতেন। মার সঙ্গে ঝগড়া হত প্রায়ই ... দু-জনই সংবেদনশীল। দু-জনই বিষন্নতায় কাতর আর দু-জনই মুড সুইং-এর চক্রে বন্দি ...মানুষ এভাবেই নিরানন্দ উত্তরাধিকার বহে বেড়ায় ...আর মা বোধহয় পুত্রের অবাধ (উভয়লৈঙ্গিক?) যৌনবিহার মেনে নিতে পারেন নি;....এবং আমরা এতকাল পর এও ভাবতে আগ্রহী হই যে- ক্যাথেরিন গর্ডন-এর জীবনে কোনও পুরুষ এসেছিল কি না ...যা পুত্রের মনে তৈরি করেছিল অস্বস্তি ... যাজ্ঞে। নটিংহ্যাশায়ারে থাকতেই এলিজাবেথ পিগট নামে এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল বায়রনের । এলিজাবেথের এক পিঠেপিঠি ভাই ছিল; নাম জন।

জনের সঙ্গে দু-দুটো নাটক মঞ্চস্থ করেছিল বায়রন। তরুণী এলিজাবেথ বায়রনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সম্ভবত। বায়রনের কবিতার খসড়া তৈরি করে দিত। কবিতা লিখতে অনুপ্রেরনা যোগাত। তবে প্রকৃত কবি বিপ্লবীরা অনুপ্রেরণার ধার ধারে না সম্ভবত।

১৮০৭। বায়রনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আওয়ারস অভ আইডলনেস” বেরুল। কতকটা এলিজাবেথের আগ্রহেই ...বায়রন কি এলিজাবেথকেও সম্ভোগ করেছিলেন? সেকালে ইউরোপের অভিজাত পরিবারের তরুণদের দেশভ্রমনের রেওয়াজ ছিল। কাজে কাজেই দেশভ্রমনে বেরুলেন বায়রন। সময়টা ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ।

সে সময়টায় নেপোলিয়নের যুদ্ধের কারনে মধ্যইউরোপ ছিল দারুন ভাবে বিপর্যস্ত। কাজেই বায়রন পর্তুগাল, স্পেন ও গ্রিস সফরের সিদ্ধান্ত নিলেন। কারও কারও মতে, সমকামের অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই বায়রন প্রাচ্য সফরের সিদ্ধান্ত নেন। যা হোক। এই গ্রিস সফরই পরে তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।

গ্রিস তখন ছিল মধ্যযুগীয়মনা কট্টরপন্থি খেলাফতি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। বায়রন রোম্যান্টিক বলেই স্বাধীন গ্রিসের স্বপ্ন দেখতেন। এত কিছুর ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লেখা কিন্তু চলছিল। তাঁর একটি শ্রেষ্ট কবিতা - শি ওয়াকস ইন বিউটি She walks in Beauty, like the night Of cloudless climes and starry skies; And all that's best of dark and bright Meet in her aspect and her eyes: Thus mellowed to that tender light Which Heaven to gaudy day denies. One shade the more, one ray the less, Had half impaired the nameless grace Which waves in every raven tress, Or softly lightens o'er her face; Where thoughts serenely sweet express, How pure, how dear their dwelling-place. And on that cheek, and o'er that brow, So soft, so calm, yet eloquent, The smiles that win, the tints that glow, But tell of days in goodness spent, A mind at peace with all below, A heart whose love is innocent! গ্রিস থেকে তারপর তুরস্ক গেলেন বায়রন । মায়ের মুখে ছোটবেলাতেই লিয়েন্ডার আর কুমারী হিরোর করুন কাহিনীটি বায়রন শুনেছেন ।

তিনি জানেন -এশিয়া ও ইউরোপকে পৃথক করেছে তুরস্কের দার্দানালেস প্রনালী; এই দার্দানালেস প্রানালীই প্রাচীন হেলাসপন্ট। প্রাচীনকালে দার্দানালেস প্রনালীর দক্ষিণ বা এশিয় অংশে ছিল অ্যাবিডস নগরী আর ইউরোপীয় বা উত্তর অংশে ছিল গ্রিসের সেসটস নগরী। কথিত আছে, লিয়েন্ডার ছিলেন অ্যাবিডোসের এক তরুণ। অ্যাবিডোসের তরুণ লিয়ান্ডার কুমারী হিরোর প্রেমে পড়েছিল। কুমারী হিরো বাস করত সেসটস-এ; কুমারী হিরো ছিলেন অসামান্যা সুন্দরী আর দেবী ভেনাসের নারীপুরোহিত।

রোজ রাতে লিয়েন্ডার সাগর পেরিয়ে যেত সেসটস-এ; কুমারী হিরোর কাছে। কুমারী হিরো উঁচু একটা টাওয়ারে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখত। দুজনের প্রেমে নাকি আফ্রোদিতির নাকি সম্মতিও ছিল। তো গ্রীষ্মে লিয়েন্ডারের সমুদ্রপাড়ি দিতে অসুবিধে হত না। সমুদ্র তখন থাকে উষ্ণ।

শীতকাল এলে সমুদ্র গেল জমে। তারপরও লিয়েন্ডার তার প্রেমিকাকে না দেখে থাকে কী করে?এক রাতে সে সেসটস রওনা হল। ঝড়ের উঠল। নিভিয়ে দিল কুমারী হিরোর প্রদীপ। দূরন্ত বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল লিয়েন্ডারকে।

সে পথ হারিয়ে ফেলল। তারপর লিয়েন্ডার তলিয়ে গেল । শোক সহ্য করতে না পেরে কুমারী হিরো টাওয়ার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুকেই বেছে নিল। সময়টা ১৮১০ সাল। বায়রন দার্দানেলেস প্রনালী পাড়ি দিলেন।

“বায়রোনিক হিরো” বলেই বায়রন দার্দানেলেস প্রনালী পাড়ি দিলেন। “বায়রোনিক হিরো” বলে একটা কথা আছে ইংরেজিতে। বায়রনের নিজের জীবনের ওপরই ধারনাটি গড়ে উঠেছে। প্রাচ্যের বীরদের জীবন অনুকরণে গড়ে উঠেছিল ধারনাটি। চাইল্ড হ্যারল্ড নামে একটি চরিত্র সৃষ্টি করে বায়রণ তাঁর জীবনদর্শনের প্রকাশ ঘটালেন।

বিচ্ছিন্ন, আত্মনির্ভরশীল, তরুণ, উদ্দাম আবেগের বশবর্তী; মানবতার ধার ধারে না। এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়, নিত্য নতুন প্রেমে মাতে; আবার আত্বগ্লানীতেও ভোগে। অতীত জীবনের পাপ বয়ে বেড়ায়। ১৮১২ সালে বেরুল চাইল্ড হ্যারল্ড এর ভ্রমনকাহিনী। বিস্তর খ্যাতি এল বায়রনের জীবনে।

বায়রনের আরেকজন আর্দশ ছিলেন: তিনি হলেন ডন জুয়ান। ডন জুয়ান একটি কীংবদন্তী; কিংবা বলা যায় ডন জুয়ান একজন কাল্পনিক দ্রোহী। ইউরোপীয় লেখকদের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। ডন জুয়ান রমনীমোহন-সে প্রেমিকার প্রেমিকদের সঙ্গে দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ত । বায়রনও ডন জুয়ানকে নিয়ে লিখেছেন ১৭ ক্যান্টোর (অনুচ্ছেদ) দীর্ঘ কবিতা।

মিলটনের পর অত বড় দীর্ঘ কবিতার সম্মান ইংরেজি সাহিত্যে আর কারও নেই। নাম প্রকাশ না করে ১৮১৯ সালে ডন জুয়ানের প্রথম দুই অনুচ্ছেদ প্রকাশ করেন বায়রন । ভিক্টোরিয় নৈতিকতায় আঘাত পাওয়ায় দারুন হইচই পড়ে গেছিল। তবে আসল ডন জুয়ানের সঙ্গে বায়রনের ডন জুয়ানের পার্থক্য আছে। বায়রনের ডন জুয়ান মেয়েদের পিছনে দৌড়ায় না।

মেয়েরাই বরং সুদর্শন ডন জুয়ানকে দেখে কাতর হয়ে পড়ত। বায়রন দেখতে কেমন ছিলেন? পায়ে খুঁত থাকলে কী হবে-অতি সুদর্শন। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি; ১৩৩ পাউন্ড। আসলে নীচের ছবিটিই বলে দেবে আমাদের প্রেমিক কবিটি কেমন ছিলেন দেখতে ... জর্জ গর্ডন নোয়েল বায়রন বায়রনের শরীর ছিল অ্যাথলেটিক দের মতন দূরন্ত; বক্সারদের মতন পেশল, ঘোড়সরওয়ারদের মতন চঞ্চল, সাঁতারুদের মতন ছিমছাম। হ্যারো থাকার সময় নাকি ক্রিকেটও খেলতেন বায়রন।

তবে সে খেলায় জুত করতে পারেনি কিশোর বায়রন। ৩ কবি বায়রনের জীবনের পর্যালোচনায় তাঁর যৌনজীবনের কলঙ্কের বিষয়টিও কিন্তু অনিবার্যভাবেই উঠে আসে। তাঁর সবচে গভীর যৌনসম্পর্ক ছিল বিখ্যাত লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব এর সঙ্গে। ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে ভিক্টোরিয় আদর্শে লালিত ব্রিটিশ জনগন নিদারুন আহত হয়েছিল। লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব বিবাহিতা বলেই-বায়রণ যদিও পরবর্তীকালে লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব এর কাছ থেকে সরে এসেছিলেন।

কেননা, কেবলি শরীরের আকর্ষন তো -তাই কথা বলে জমত না। অভিজ্ঞজন বলেন, কথা বলেই তো বিরক্তিকর বৃষ্টি না হওয়া দীর্ঘ সন্ধ্যাগুলো কাটাতে হয়। তবে বায়রন ক্লান্ত হয়ে উঠলেও লেডি ক্যারোলিন অবশ্য আশা ছাড়েননি। তিনি নাকি পুরুষের ছদ্মবেশে বায়রনের বাড়ি যেতেন। এসবেই ছিঃ ছিঃ উঠল নীতিবাগীশ ভিক্তোরিয় সমাজে- ওদিকে লেডি ক্যারোলিন তো বিরহে শুকিয়ে কঙ্কালসার।

বায়রণ কবি হয়েও নারীর প্রেমকে বোঝেননি মনে হয়। প্রকৃত ডন জুয়ানের ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল তার। এতকাল পরে আমরা বুঝতে পারি লেডি ক্যারোলিন সত্যিই সত্যিই ভালোবেসেছিলেন জর্জ গর্ডন নোয়েল বায়রন কে। লেডি ক্যারোলিন নিয়ে তিনি গ্রিসে পালিয়ে যেতে পারতেন। চতুর বায়রন অবশ্য অন্য পথ ধরলেন।

লেডি ক্যারোলিন ল্যাম্ব-এর এক কাজিন ছিল। নাম: ইসাবেলা মিলবাঙ্কে। ডাকনাম অ্যানাবেলা। লেডি ক্যারোলিনের হাত থেকে বাঁচতে অ্যানাবেলা কে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন বায়রন। ঘৃনাভরে বায়রনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন অ্যানাবেলা।

“ছিঃ, যে লোক অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া করে তাকে বিয়ে করব আমি!” এভাবে পরিস্থিতি হয়ে উঠল ঘোলাটে। কিন্তু, মানুষ ভারি বিচিত্র প্রানি। ১৮১৫ সালে বায়রনকে বিয়ে করতে সম্মত হলেন অ্যানাবেলা । তার কারণ সম্ভবত- (১) বায়রণ সুদর্শন; সুদর্শন ও জনপ্রিয়। (অনেক তরুণে অর্থ থাকতে পারে -কিন্তু, জনপ্রিয় আর ক’জন?) (২) অ্যানাবেলা সম্ভবত ভেবেছিলেন- বিয়ের পর নোয়েলকে (বায়রনকে) ঠিকই আমি বদলে ফেলব।

আমার আছে প্রেমের মোহিনী শক্তি আর আমরাই সবাইকে ইর্ষান্বিত করে সবচে বেশি সুখি হব। বিয়েটা হল। একটা মেয়েও হল। মেয়ের নাম রাখা হল আগুস্তা আডা; বায়রনের একমাত্র বৈধ সন্তান। কিন্তু হায়, লেডি বায়রন (ইসাবেলা মিলবাঙ্কে ) সুখি হলেন না।

তিনি কবিকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরের বছরই অর্থাৎ ১৮১৬ সালে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকরী হয়। অত্যন্ত বিষাদগ্রস্থ হয়ে বায়রন লিখলেন- ভোরের শিশির আমার ভুরুর উপরে জমে আছে এও এক ধরনের সর্তক সঙ্কেত যা আমি অনুভব করছি। তুমি শপথ ভঙ্গ করেছ তোমার জীবন ভঙ্গুর কারা তোমার নাম উচ্চারণ করে তোমার নামে লজ্জ্বা লেপ্টে আছে বিবাহবিচ্ছেদ সম্পর্কে লেডি বায়রন এর ভাষ্য শোনার আগ্রহ বোধ করছি। তথ্য কোথায় পাব বুঝতে পারছি না।

তবে কল্পনা করা যায় ... তো, সেই সময় লন্ডনের এক উঠতি (কিন্তু, বিবাহিতা) অভিনেত্রীর সঙ্গে রমরমা পরকীয়া চলছিল বায়রনের। আগস্টা লেহ নামে বায়রনের এক সৎ বোন ছিল। তারও সঙ্গে যৌনসংসর্গের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। আসলে গুজব না-সত্যি; আগস্টা লেহ-র গর্ভে বায়রনের একটা মেয়েও হয়। মনে রাখতে হবে-যুগটা ভিক্টোরিও।

যা কিনা characterized by attitudes commonly considered to be prevalent during the Victorian era, especially prudery or conventionalism... আর, অভিযোগ যখন ইনসেস্ট-এর। বায়রন তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করবেনই। দিন দিন শহর লন্ডন অসহ্য হয়ে উঠছিল! প্রিয়তমা অ্যানাবেলা পাশে নেই। বায়রন ভেবেছিলেন অ্যানাবেলা বুঝবে-কেন এত কামবোধ, কেন সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষন। সে আকর্ষনজনিত গ্লানি।

সর্বত্র সমালোচনা আর সমালোচনা। সবই কানে আসে। বায়রন নাকি সমকামী -সমকামের অভিজ্ঞতা নিতেই ১৮০৯ সালে প্রাচ্য ভ্রমন করেছিলেন। বায়রন কিছুদিনের জন্য উন্মাদ হয়ে যান। নিজেকে অভিজাত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

ত্যক্ত হয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে চিরতরে চলে যাওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন । ৪ ইংল্যান্ড থেকে বেলজিয়াম হয়ে রাইন নদী পেরুলেন কবি। ১৮১৬ সাল; সুইজারল্যান্ড পৌঁছলেন। জেনেভা লেকের পাশে ভিলা দিওদাতি-সেখানেই বাস করতে লাগলেন। ওখানেই দেখা আরেক প্রখ্যাত রোম্যান্টিক ইংরেজ কবি পার্সি বেশি শেলির সঙ্গে।

শেলির সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ম্যারি গডউইন আর ম্যারি গডউইন এর সৎ মেয়ে ক্ল্যারি ক্লাইরমন্ট। ম্যারি গডউইন ফ্রাঙ্কেস্টাইন নামে একটি উপন্যাস লিখছেন। ম্যারি গডউইন এর সৎ মেয়ে ক্ল্যারি ক্লাইরমন্টের সঙ্গে বায়রনের অ্যাফেয়ার ছিল। লন্ডনে । যা হোক।

বেশ কটা দিন কাটল কবিতা আর গানে; কাটল প্রখ্যাত সুইস শুভ্র ধবল জোছনায় ... জেনেভা হ্রদের ওপরে কাঠের নৌকায়। বায়রন লিখলেন- তারা আমার সামনে তোমার নাম নেয় যা আমার কানে অমঙ্গল ধ্বনি আমার শরীরে কাঁপুনি আসে তুমি কেন আমার এত প্রিয় ছিলে? ওরা জানে না যে আমি তোমাকে চিনি সবার চেয়ে ভালো করে জানতাম অনেক অনেক দিন তোমাকে আমি শাসন করব গভীর ভাবে তোমার কথা বলব। ...আমরা গোপনে মিলিত হতাম নীরবে কাঁদতাম তোমার হৃদয়কে কি ভোলা যায় ছলনাময়ী তোমার আত্মাকে অনেক অনেক বছর পর তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলে কী ভাবে সম্বোধন করব? নীরব কান্নায় ... ভালো লাগছিল না। মন ভীষন অস্থির। লন্ডনের কথা মনে হয়।

তখন চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ১৮১৬ সাল। ভেনিস এলেন বায়রন। ভেনিসের সেন্ট লাজারাস দ্বীপে আর্মেনিয়রা বাস করত। যে কোনও সংস্কৃতি সহজে আত্বস্থ করতে পারতেন বায়রন।

বায়রন আর্মেনিয় ভাষা শিখলেন। আরমেনিয় ও ইংলিশ গ্রামারের ওপর বই লিখলেন। ১৮২১ সালে ইতালির পিসায় এলেন। পিসায় ছিলেন এক বছরের মতন। এখানেই অনেকটা “ডন জুয়ান” লিখে শেষ করলেন (আসলে লেখাটা কখনোই শেষ হয়নি)।

ওখানেই প্রখ্যাত সমালোচক লে হান্ট ও শেলির সঙ্গে দেখা হল বায়রনের। এরপর পিসা থেকে জেনোয়া এলেন বায়রন । মনে অস্থির ভাব । ভোগসুখে সময় কাটছে-জগতের জন্য কিছু করা হল না। জেনোয়ায় পরিচয় হল সুন্দরী এক কাউন্টেস-এর সঙ্গে।

প্রেমকামে ডুবলেন আবার। নতুন প্রেমে ডুবে থেকে জীবনের কয়েকটা দিন পার করলেন কবি । হায়/ ...সময় গড়িয়ে চলে ... প্রেমিকার চোখের সৌন্দর্যর দূত্যি যায় নিভে । তখন প্রেমালাপ বাদ দিয়ে শুরু হয় খুঁটিনাটি কথা নিয়ে কাটাকাটি ... ১৮২৩ অবধি জেনোয়া ছিলেন বায়রন। সব কিছুর ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন।

আসলে ভোগের পর্ব শেষ হয়ে গেছে তাঁর। এবার আত্মত্যাগ করবেন। জীবন বিলিয়ে দেবে অন্যজাতির কল্যানে। গ্রিস যাবেন ঠিক করলেন। গ্রিসে দীর্ঘদিন ধরে কট্টরপন্থি অটোমানরা জাঁকিয়ে বসেছে।

তারা গ্রিকদের ২য় শ্রেনির নাগরিক মনে করে ... নারী স্বাধীনতা নেই ...নারীদের কালো কাপড়ে ঢেকে রাখে ধর্মের দোহাই দিয়ে। ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে বায়রনের মুখ; যে করেই হোক না কেন- গ্রিস থেকে থেকে অটোমানদের হটাতেই হবে। ১৮২৩ সালের ১৬ জুলাই। জাহাজে চেপে জেনোয়া ত্যাগ করলেন বায়রন। ৪ আগস্ট পৌঁছলেন গ্রিসের কেফালোনিয়ায় ।

এর পরের ঘটনা আমরা জানি ... একটা অটোমান-নিয়ন্ত্রিত দূর্গ আক্রমন করার কথা ...বায়রনের বয়স তখন মাত্র ৩৬ ...গ্রিসের মেসোলনঘি ...সময়টা ১৮২৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি .... কবির শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল ... এভাবে মারাত্মক দূর্বল হয়ে পড়লেন তিনি । সেই সঙ্গে প্রবল জ্বর। ১৯ এপ্রিল ভোরে মারা গেলেন বায়রন। যে বিপ্লবী কবিটি বেঁচে থাকলে রাজা হতেন গ্রিসের... বায়রনকে নিয়ে ব্লগার বাফড়ার একটি পোস্ট ... Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.