আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার একলা থাকার ঘর, আহা! একলা রইল না...

.

মশারি টাঙিয়ে কোনো লাভ হয় না। কোন কোন ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে জানি মশাগুলো ঠিকই চলে আসে আমার আশে পাশে। ডানা মেলে। গান ধরে। একলা আমার ঘুম ভেঙে যায়।

তারপর কিছুক্ষণ হাত-তালি পড়ে ওদের সিম্ফনি শুনে। ওদের গান থেমে যায়। হাত ধুই না আমি। কাল-সকালে লাল দাগগুলো খয়েরি হয়ে যায়। বালিশগুলো ভিজতে থাকে ঘাড়ের ঘামে।

বেডকাভারগুলো কুঁচকে যায়। ফ্যানের বাতাসে শুকাতে থাকে সেই ঘামগুলো। আর তারপর কাল-সারারাতের অমানবিক পরিশ্রমে ক্লান্ত ফ্যানটা একটু জিরোয়। টেবিলের ওপর ছোট্ট ডুপ্লেক্সে ধুলো জমে না। সবগুলো ফাঁক-ফোকর ধুলোকণা পিঠে নিয়ে নাক ডাকছে, নতুন আর কারো জায়গা নেই।

ধুলোকণাগুলো ডুপ্লেক্সের আশ-পাশে ঘুরতে থাকে উড়তে উড়তে। সুযোগ খুঁজতে থাকে একটু বাতাসের। একটা-দুইটা উড়ে গেলেই জুড়ে বসবে সেই লোভে। কিন্তু ঐ বাতাসে সেও উড়ে চলে যায় বেশ দূরে। 'বুরুদা'র থ্রিলার উড়তে থাকে ডুপ্লেক্সের ছাদের ওপর... থার্টি ফার্স্ট নাইট।

হঠাৎ করে দরজায় পাথরের টুকরা ছুড়ে মারার আওয়াজ। দরজা খুললে একটা ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর একটা আর্চিসের কার্ড। আর এই ডুপ্লেক্সটা। অনেক রঙিন।

অনেক কিউট। এত বড় একটা ছেলে ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলেকে নিউ ইয়ারে কার্ড-গিফট দেবে! এত রাতে! সেই সংকোচে পাথর ছোঁড়ার কাছে হাত পাততে হয়েছে বুরুদাকে। বুরুদা এখন চশমা পড়ে। রাস্তায় একসাথে হাঁটতে হাঁটতে শুনি ডাক্তার বলেছে সে নাকি অপুষ্টিতে ভুগছে। হাঁটতে হাঁটতে ওর, অনেকগুলো বিয়েতে দাওয়াত না পাওয়ার কষ্টের গল্প শুনতে থাকি।

সবগুলো কাছের মানুষের বিয়ে। 'খ সাইন তুই, কিলা লাগে?' আমি চুপ করে থাকি। লোডশেডিঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা রাস্তার হলুদ বাতিগুলো বুরুদার কথা শুনে হাসে। রাস্তার দুপাশে মানুষজনের কথা আরো বেশি করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। লামাবাজার মোড়ের সাইকেল-রিক্সার বেল এর শব্দ অনেক দূর থেকেই শুনতে পাই আমরা একসাথে।

‌'বুরুদা, চটপটি খাইবাই নি?' আমরা তখন স্ট্যাডিয়ামের সামনে। শান্ত অনেক দূর থেকে রিক্সায় দাঁড়িয়ে গিয়ে হাত নেড়ে ডাক দিয়েছিল। আমি ঠিক চিনতে পারি নি। কিছুটা ধারণা করেছিলাম ও হতে পারে। অনেক লম্বা চুল।

আর ওর পাশের ছেলেটাকে ওওদের বন্ধুদের একজন লেগেছিল যার নাম আমি জানি না কিন্তু চেহারা চিনি। স্ট্যাডিয়ামের সামনে নেমে যখন ও রিক্সাভাড়া দিচ্ছিল তখন নিশ্চিত হলাম শান্তই। আমাকে দাদা বলে ডাকছিল, বাসায় যেতে বলছিল। আমি খুব অস্বস্তিবোধ করছিলাম। আমি ওর বন্ধুই হতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু... সেও কি ইচ্ছে করেই আমাকে সিনিয়র করে রাখছে! 'নারে। আমি চটপটি খাইনা। ' উত্তরটা আমাকে একটুও চমকে দেয় নি এমন একটা ভাব করে আমি অন্য একটা প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছিলাম। বুরুদা থামিয়ে বলল, আমার মতোই ওর একটা খুব প্রিয় ভাই ছিল। প্রতি সন্ধ্যায় সে বুরুদার দোকানের সামনে আসত।

ওরা একসাথে চটপটি খেত। সেদিন সন্ধ্যায়ও খেয়েছে। বুরুদা ওকে ওদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে একসাথে হেঁটে হেঁটে। 'ধাম' করে বিশাল পাঞ্জার একটা 'আদর'ও দিয়েছে পিঠে অনেক জোরে। আর পরদিন সকালেই শোনে সে মারা গেছে! এমসি কলেজের পুকুরে খেলা শেষে পা ধুতে গিয়ে পা পিছলে নাকি মারা গেছে।

সাঁতার জানত না। তারপর থেকে বুরুদার আর চটপটি খেতে ইচ্ছে করে না। ওর কথা মনে পড়ে যায়। এই রাস্তাটা আমার খুব প্রিয়। রিকাবীবাজার মোড় থেকে স্ট্যাডিয়ামের গা ঘেষে চৌহাট্টা মোড় পর্যন্ত।

এই রাস্তার হলুদ বাতিগুলো আরেকটু বেশি উজ্জ্বল। বুরুদার কথা শুনে আমি কেবল 'ও' বললাম। ............................................................................................ তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার ব্যাগের ভেতর ছাতা ছিল। আর আমি ওর ঘুম না ভাঙিয়ে ভিজে ভিজেই হাঁটছিলাম।

একটা দোকানে 'গুডনাইট' পেয়েছি, কিন্তু ওটা ছিল সকেট সিস্টেম। পুরো মেশিনটাকেই সকেটে ঢোকাতে হয়। আমি চাইছিলাম লম্বা তারে প্লাগ লাগানো একটা মেশিন। কয়েকটা দোকানে হামলা চালাতে সংকোচ করলাম না পছন্দের জিনিসটা বেছে নিতে। নিজের টাকায় কিনছি।

নিজের জন্য। শেষমেষ তিন নম্বর দোকানাটাতে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'গুডনাইট ম্যাট আসে নি?' মধ্যবয়স্ক স্টিলের ফ্রেমের চশমা মাথা নাড়ে। 'মানে মেশিনটা আর কি,' কেবল লিকুইডটা বের করে দেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতায় বললাম আমি, ‌'ওউ যে প্লাগ লাগাইল?' মধ্যবয়স্ক চশমা আবারও মাথা নাড়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে। আমি ছোট্ট ছেলেটার দিকে তাকাই। ঝুলে থাকা লেইস এর প্যাকেটগুলোতে তাকাই।

দেয়ালে তাক করে রাখা অল ক্লিয়ার ফর ম্যান, হ্যাড এন্ড শোউল্ডার ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ছেলেটার হাতে ধরা একটা লাল প্যাকেটের দিকে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মধ্যবয়স্ক চশমা মুখ খোলে, 'টেস্ট খরি দিতাম নি?' আমি একটা মাঝামাঝি ইশারা করলাম। হ্যাঁও না, না-ও না। ধুলোজমা প্যাকেটটা খুলে প্লাগটা ঢোকানো হলো সকেটে।

সুইচ দিতেই মেশিনের ইন্ডিকেটর লাইটটা জ্বলে উঠলো লাল রঙ মেখে আর আমরা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলাম মেশিনটা ঠিক আছে, যদিও এটার কাজ আলো দেয়া না। লাল প্যাকেটের গায়ের ধুলো মোছা হলো। একটা সাদা জালির ব্যাগে ঢোকানো হলো। তারপর আমার হাতে তুলে দেয়া হলো দুইটা ১০০ টাকার নোট নিয়ে ১ টাকা ফেরত দিতে দিতে। আমি মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম ও না আসুক একটা বারের জন্যও যদি ওদের বাসার কেউও ফ্লেক্সিলোড করতে আসে! কিন্তু কেউ এলো না।

দোকানে কেবল আমরা তিনজন। ওদের দুজনকে রেখে আমি বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। রাস্তার পাশের উঁচু স্ল্যাবগুলোর উপর হাঁটতে লাগলাম। ডান দিকে ফেলে যেতে লাগলাম কয়েকটা ফার্মেসি আর সিতারা বেকারীর ভেতর থেকে আসা মিষ্টি সেই খুব চেনা গন্ধটা। বেড়ে যাওয়া বেগের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে ঘাম ঝরানোর মতো যথেষ্ট বেগে দৌঁড়ে দৌঁড়ে হাঁটতে লাগলাম আমি।

ইতো যখন প্রথম গোলটা দিল তখনও আমি কোনো গন্ধ পাই নি। বেশ বোকা বোকা লাগছিল লাল ইন্ডিকেটর লাইটটা জ্বলতে দেখেই মেশিনটা ভালো আছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলাম ভেবে। অবশ্য মেসি দ্বিতীয় গোলটা দিতে দিতেই মনটা আবার ভালো হয়ে গেল আমাকে আর মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে না ভেবে। আমি এখন মশারি ছাড়াই ঘুমাই! আমি যখন অনেকগুলো ভিডিও ক্লিপিংস এলোমেলোভাবে দেখতে থাকি ঘুমের ঘোরে, তখন আমার নাকের পাশে গুডনাইটের গন্ধ উড়তে থাকে লাঠি হাতে। মশাগুলো আর গান বাঁধে না।

দু হাত আমার লাল হয়ে কাল-সকালে খয়েরি হওয়ার সুযোগ পায় না। আমার একলা থাকার ঘর, আহা! একলা রইল না!...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।