আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তানভীর মোকাম্মেলের ‘বস্ত্রবালিকা’ দর্শন



একের পর এক গার্মেন্ট কারখানায় যখন শ্রমিক বিদ্রোহ চলছে, রাজপথে নেমে আসছে লাখ লাখ শ্রমিক; তখন মালিকশ্রেণী, রাষ্ট্রীয় মহল, দাতাগোষ্ঠির পক্ষ থেকে নানা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে বা ওঠানো হচ্ছে। সবারই ভাবনা ‘কিভাবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা যায়’। মিডিয়ায় ধ্বনি উঠছে, ‘শ্রমিকের নৈরাজ্যে’ কারখানা উঠে যাবে। অতি মুনাফা, খুন-ধর্ষণ, শ্রম লুট, আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ যাবতীয় মালিকপীয় নৈরাজ্যে কারখানা উঠে যাবার ভয় থাকে না, ভয় কেবল শ্রমিকের বিক্ষোভ নিয়ে। তাই মালিকী চরিত্রের প্রায় সবটুকু উম্মোচিত থাকার পরও সেসব উপেক্ষা করে সরকারি উদ্যোগে শ্রমিকের ‘নৈরাজ্য’ দমনে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়।

বিজেএমইএ-র নেতৃত্বে ‘ক্রাইসিস কন্ট্রোল কমিটি’ নামে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন সংস্থা গঠন করা, শিল্পাঞ্চলের জন্য ৩০ হাজার সদস্যের বিশেষ পুলিশ বাহিনী গঠন, নারী পুলিশ বাহিনী নিয়োগের মতো পরিকল্পিত কর্মসূচী গুরুত্ব সহকারে হাতে নেয়া হচ্ছে। তাল মিলিয়ে চলছে এনজিও ও মিডিয়ার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ ও ভাষ্য-প্রচার। এরই মধ্যে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী তানভীর মোকাম্মেল গার্মেন্ট কারখানার নারী শ্রমিকদের নিয়ে নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র গোছের একটি ছবি : বস্ত্রবালিকা। মালিকরা শ্রমিক নামক সোনার হাঁস পুষতে চায়, বিনিয়োগকারী চায় নিশ্চিত মুনাফার অবাধ ক্ষেত্র। রাষ্ট্র দমনমূলক যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সিদ্ধহস্ত, মধ্যবিত্ত চায় ‘শান্তি ও উন্নয়ন’।

এমন সময় নির্মাতার চাওয়া ভিন্ন কিছু কি-না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ‘বস্ত্রবালিকা’ কী অনুভুতির জন্ম দেয়? ‘বস্ত্রবালিকা হেঁটে যায় ভোরের আলোয় আর নিয়নের আলোকচ্ছটায়। ছোট ছোট স্বপ্ন তার পায়ে পায়ে হাঁটে আমাদের নগরের ফুটপাতে। ’(সূত্র:সূচনা/কবিতা,বস্ত্রবালিকা,নির্মাতা- তানভীর মোকাম্মেল) আমাদের বাংলা ভাষায় একটি নতুন শব্দকল্পের যোগান দিলেন এবং নিজেও কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন তানভীর মোকাম্মেল। ২২ লাধিক শ্রমিকের কর্মক্ষেত্র গার্মেন্ট কারখানার কর্মরত নারীরা তার কাছে কেবলই ‘বালিকা’।

শ্রমিক তো নয়ই, নারী নয় এমনকি পুরো মানুষও নয় বরং অপূর্ণাঙ্গ ও অ-প্রাপ্তবয়স্ক এক চরিত্র ‌‌'বালিকা'। শ্রমিক কেবল একটি শব্দই নয়; ‘শ্রমিক’ একটি সত্তা, একটা শ্রেণী, সমাজের এক সক্রিয় চরিত্র, উৎপাদনের কর্তা। শ্রমিক আরো অনেক কিছুও হতে পারতো। হতে পারতো বাঙালি বা আদিবাসি, শহুরে বা গ্রামীণ, নারী বা পুরুষ। কিন্তু এত পরিচয়ের মধ্যে মিলের জায়গা হলো তাদের শ্রমিকতা।

কারণ, তারা শ্রম বিক্রি করে রুজি যোগাড় করতেই এসেছে। শ্রম দেয় বলে মালিকের বিপরীতে তারা প্রধানত শ্রমিক পরিচয়েই নিজেদের দেখতে পায়। শ্রমিককে তার আপন উৎপাদনী পরিচয়ে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে তার স্বাতন্ত্র্য, অধিকার ও শক্তিকেও স্বীকার করে নিতে হয়। গার্মেন্ট-এ কর্মরত নারী বা পুরুষের প্রধান পরিচয় তার এ শ্রমিকতা। কিন্তু এখন এক এনজিও দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড়িয়েছে যারা তাদের তহবিল যোগানদাতা তথা ‘দাতা’-দের পছন্দের ভাষায় শ্রমিক না বলে উৎপাদন সহযোগী, কর্মী ইত্যাদি নামে ডাকতে ভালবাসে।

এতে করে শ্রমিকতার মধ্যে শোষণের দিকটি সফলভাবে আড়াল করা যায়। এ জন্য নানা প্রকল্প হাজির করা হচ্ছে যেখানে ‘নারী অধিকার’, ‘দরিদ্র উন্নয়ন’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ ইত্যাদি মোড়কে শ্রমিকের মূল চরিত্র যে শ্রমদান ও তার মাধ্যমে শোষিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি আড়ালে পড়ে যায়। ঢাকা পড়ে তার অধিকারের প্রশ্ন। দরিদ্র নারীদের নিয়ে কোটি কোটি টাকার এইসব প্রকল্প বাংলাদেশে নারীদের কী উন্নয়ন ঘটালো, তা মাত্র একদিনের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা সম্ভব। সরকার ও এনজিও একযোগে দরিদ্র নারীদের হাঁস মুরগী পালন আর গার্মেন্টে দরজিগিরি করিয়েই মুক্তির স্বাদ দিতে চান।

তানভির মোকাম্মেলও এর চেয়ে বেশি কিছু চাননি। তার চোখে গ্রাম থেকে আসা এইসব নারীরা অশিতি, নিরীহ, নেতৃত্বহীন, অসংগঠিত এবং যাদের জীবনের একমাত্র ভবিতব্য ছিল ‘গৃহপরিচারিকা’ হওয়া। গার্মেন্ট শ্রম তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ভাল থাকার, স্বাবলম্বী হওয়ার। গৃহপরিচারিকাকে দেখার কোন চোখ থাকতে পারে একজন মধ্যবিত্তের? দয়া-মায়া ও করুণা! নির্মাতা অবশ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে। তাই ছবির শুরুর কবিতা আর সুমধুর পাঠের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা করুণ-রস আপনাতেই চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে ছবির শরীর জুড়ে।

তবুও ক্ষান্ত হন না নির্মাতা। নিজ থেকেই ছবির শেষ পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যান তার কবিতাকে। সেই কবিতায় কী নেই? ছোট পা, ছোট কাঁধের অধিকারী বস্ত্র বালিকা ‘লাজুক চোখে চায়’। এভাবে প্রথম চোটেই শ্রমিক নারীকে তিনি দর্শকের কাছে হাজির করেন ‘খন্ডিত সত্ত্বা’ হিসাবে যে নারীও নয় শ্রমিকও নয়। সে হলো ‘বস্ত্রবালিকা’।

কী এর অর্থ? বস্ত্র ও বালিকা - দুটি আলাদা শব্দ একত্রে কী অর্থ বহন করে জানা নেই, তবে অনেক ক্ষেত্রে তা যে কল্পনার ডালপালায় ভর করে নেতি অর্থে ‘ বালিকা ও বস্ত্রহীনতা’ অথবা সদর্থে ‘বালিকা ও বস্ত্রসহযোগে’- এমনটি হতে পারে। ইতি বা নেতি যে দিক দিয়েই বিষয়টি দর্শকের মনে স্থান নিক না কেন শেষ পর্যন্ত তা কোন ভাবে যৌন উদ্দিপনা সৃষ্টি করে কিনা সে ব্যপারে আশঙ্কা জাগে। এর পর নির্মতার দৃষ্টিতে নারী শ্রমিকের সুখ-দুঃখের নানা কথা, নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা, দাবি-দাওয়া এমন ভাবে উঠে আসে যা ভেদ করে দর্শকের মনে তিল তিল করে এক অলীক বাস্তবতা নির্মিত হতে থাকে। যার নিচে চাপা পরে হারিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক হত্যা, এখানে সেখানে ধর্ষন, মাত্র ৯০০/১০০০ টাকায় কিনে ফেলা শ্রমিকের গোটা জীবন, কথায় কথায় ছাঁটাই, প্রহার, লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, পুলিশি নির্যাতনের মতো নির্মম ঘটনাগুলো - দিনের পর দিন হাজারটা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন আর শ্রমশোষণের ভিতে নির্মিত সেই বাস্তবতা। বর্বরোচিত এই বাস্তবতাকে নির্মাতা দেখতে পান সিলিকন পেপারে মোড়া রোমান্টিক দৃষ্টিতে।

যেখানে সবকিছু ধরা দেয় কোমল অদ্ভুত এক করুণ সূর মুর্চ্ছনায় ধারাভাষ্যের প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি দৃশ্যে। ন্যুনতম শ্রদ্ধাভক্তির জ্ঞানরহিত নির্মাতার চোখে ‘গৃহ পরিচালিকা হবার যোগ্য’ নারীদের প্রতি বার বার সম্বোধন হিসাবে আসে ‘ওকে আমরা খুঁজে পাই, ‘তুমি কত চাও’, ‘ওকে’ ‘তুমি’ ধরনের সম্বোধনে। নিজের পুরুষত্বের স্বার রাখেন তিনি। নারী শ্রমিকদের তিনি ‘তুমি’ সম্বোধন করলেও পুরুষ শ্রমিককে করছেন ‘আপনি’ করে। নারীদের সাথে আলাপের বিষয় হয়ে ওঠে প্রেম-ভালবাসা-বিবাহ, প্রিয় নায়ক-নায়িকা।

নির্মাতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তার ‘বালিকারা’ সচেতন হয়ে উঠছে। তারা ছোট সংসারের কথা ভাবে, নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চায়। সালমান খানকে পছন্দ হলেও তা যে কেবল ছবিতেই তা তারা বোঝে। বিষয়ের কোনোরকম গভীরতায় প্রবেশ না করে নিজের অস্বচ্ছ জ্ঞানকে তিনি একত্রিত করেছেন পুরো ছবিতে। তাই ছবির চরিত্রগুলো পূর্ণতা পায় না।

অনেক অনেক চরিত্রের উপস্থিতি যেমন, তাদের নাই হয়ে যাওয়াও তেমন। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনার সহায়ক হিসাবে তারা একের পর এক হাজির হয় ও হারিয়ে যায়। যেন অবিরাম ধারাভাষ্যকে সমর্থন করতেই তাদের উপস্থিতি। উপর্যুপুরি তথ্যের উপস্থাপনা দর্শককে কোথাও একদন্ড ভাববার সুযোগ দেয় না, ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ভাসতে ভাসতে দর্শক গিয়ে পড়েন অন্য এক এলাকায়, যেখানে পুরো গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা রয়েছে।

এ শিল্পের অনেক প্রতিবন্ধকতা, মালিকদের অপারগতা, বায়ারদের প্রাপ্তির আকাংখা, রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসনের ভূমিকা, বিভিন্ন সংগঠন ও এনজিও’র তৎপরতা, শ্রমিকের অদক্ষতা, আন্দোলনের ফল, অন্যান্য দেশে এ শিল্পের ভাবমূর্তি, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবনা, এসব কিছু মিলিয়ে ছবি এমন একটি মোড় নেয় যেখানে নির্মাতার ‘বস্ত্রবালিকা’ও হারিয়ে যেতে বসে। শুধু একটি প্রশ্নই থেকে যায়: এই শিল্পের কী হবে? কিন্তু এই প্রশ্নটি কার? মালিকদের প্রতি নির্মাতার অনুনয় ‘শ্রমিকের এতো বড় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যে মালিক করেছেন সেই শ্রমিক কিভাবে চলে, কিভাবে থাকে, তা দেখবার দায়িত্বও কি তাদের নয়?’ এখানেও সেই একই করুণাভরা, মমতাময় দৃষ্টি। ক্ষমতাসম্পর্কের যে অবস্থানে তিনি দাঁড়িয়ে, তাতে মালিকের প্রতি অনুনয় আর শ্রমিকের প্রতি করুণাই তাকে মানায় এবং তার অবস্থানকেও স্পষ্ট করে। তিনি মেনে নিয়েছেন নারীর মুক্তিদাতা যেমন পুরুষ, শ্রমিকের অধিকারদাতাও তেমনি মালিক। শ্রমিককে তাই মালিকের কাছে চাইতে হবে মাথা নিচু করে; বুক উঁচিয়ে নয়।

দরকষাকষি আর সমঝোতা করে যেতে হবে। বিদ্রোহ করা চলবে না। কারণ বিদ্রোহ করলে এ শিল্প টিকবে না। বায়াররা শূন্য হাতে ফিরে যাবেন। কি হবে তখন? বিনিয়োগকারিরা তো শুধু দাতাই নন আমাদের সুখদুঃখের সাথীও বটে,শিক্ষিত দালাল মধ্যবিত্তের অন্নদাতা।

সাভারে স্পেকট্রামে যখন আগুন লাগে তখন মালিক হিসাব কষলেও আহত শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল স্পেনের ইনডিটেক্স জারা গ্রুপ। শুধু মাত্র এই তথ্যটুকুর প্রমান যোগাতে চলচ্চিত্রকার অনেক অর্থ ব্যয় করে জারা গ্রুপের মালিকগোষ্ঠীর মন্তব্য যোগাড় করতে স্পেনে ছুটেছেন। অন্যদিকে আহত আগুনে-ভবনধসে নিহত শ্রমিকের বাড়ি পর্যন্ত তিনি যেতে পারেন না। তাদের পরিবার আর আহতদের এক সাথে বসিয়ে দিয়েছেন কোনো এক পার্কে। তাদের মুখ থেকে একের পর এক তথ্য নিয়েছেন।

একজন দর্শক হিসাব আমরা শুধু পরিচিত হই হাত-কাটা, পা-কাটা, পঙ্গু মানুষ এবং কোন এক নিহত শ্রমিকের মাতার আহাজারির সাথে। তারপর অন্যান্য সকল চরিত্রের মতোই নামহীন বিকাশহীনভাবে হারিয়ে যায় তারা। শ্রমিককে তার নিজ বাস্তবতায় না দেখিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্কহীন স্থানে টেনে এনেছেন নির্মাতা। তথ্যচিত্রে চরিত্রের সঠিক প্রকাশ নির্ভর করে, বানোয়াট ও আরোপিত বাস্তবতার বাইরে নিজস্ব বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবে তাকে দেখতে পারার সামর্থ্যরে ওপর। কিন্তু নির্মাতা তো মালিক ছবির মালিক, বিষয়েরও মালিক ।

তাই বিষয়কে তিনি যেমন খুশি সাজিয়েছেন। যে শ্রমিকের জীবনে এতো উত্থানপতন, অস্থিরতা তাদের তিনি বারবার ক্যামেরাবন্দি করেছেন জড় বস্তুর মতো, সজ্জিত ভঙ্গিতে বসে বা দাঁড়িয়ে, স্থান-কাল-পাত্রের সমস্ত শর্ত উপেক্ষা করে। এর বাইরে নুরজাহানকে চরিত্র হিসাবে বিকশিত করার চেষ্টাতেও রয়েছে অসততা। তিনি তাকে হাজির করার চেষ্টা করছেন ছবির প্রধান চরিত্র হিসাবে, শ্রমিকের প্রতিনিধি করে। কেন? কারণ নূরজাহান ১৮০০ টাকা বেতন পায়।

এ ঘটনা গার্মেন্ট শিল্পে খুব অল্প শ্রমিকের ক্ষেত্রে সত্য। নুরজাহান বিশেষ, সাধারণ নয়। তার সরলতা তাকে হেলপার থেকে অপারেটর হওয়াতেই খুশি প্রতীয়মান করে। যে নুরজাহান শ্রম বাজারে এখনও তার অবস্থানকে পরিমাপে সমর্থ হয়নি অথবা হয়েছে, কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা কোনোভাবেই এ চরিত্রের জীবনের যতটুকু দৃশ্যমান, তার বাইরে গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণসমেত তাকে উপস্থিত করার প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ এই চরিত্রটিই ছবির একমাত্র চরিত্র যার ধারাবাহিকতা আছে।

যেহেতু শ্রমিকের অবিকশিত, খণ্ডিত, দুর্বল রূপকেই তিনি শ্রমিকের রূপ হিসাবে প্রতীয়মান করাতে চেয়েছেন। বারবার ঢাকতে চেয়েছেন শ্রমিকের ঐ চেহারাকে, যে ঐক্যবদ্ধভাবে বাঁচতে চায়, অধিকার আদায়ে লাখে লাখে নেমে আসে, রাজপথে জীবন দেয়, গায়ের ওড়না পেতে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকের কাফনের টাকা তোলে। ঘটনা আকারে এসব ছবিতে এলেও কোন শক্তি কোন মনোবল নিহিত রয়েছে শ্রমিকের মধ্যে, তার কোন খোঁজ নেয়া বা তুলে ধরার মিশন হয়তোবা ছিল না এই প্রজেক্টে। সমাজের তে একটু একটু মলম লাগানোর যে কাজ প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিরা তানভীর মোকাম্মেল সেই কাজেরই প্রতিনিধি হয়ে রয়ে যায় তার ছবিতে। ছবি থেকে মনে হয় এ শিল্পের বাঁধা অপসারণ করতে চেয়েছেন তিনি।

এ শিল্প তানভীর মোকাম্মেলের কাছে বাংলার ঐতিহ্য মসলিন শিল্পেরই ধারাবাহিকতা। গার্মেন্ট মৌলিক শিল্প নয় এটা সবাই জানে। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আমাদের শ্রমিকরন্ধনী বিশ্বের নাগরিকদের দর্জির কাজ পেয়েছে। আর এ দর্জিগিরিকেই তিনি বলছেন মসলিন শিল্পের ধারাবাহিকতা। এরচেয়ে বড় মুর্খতা একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার জন্যে আর কী হতে পারে? হাজারটা সমস্যাকে ভাসা ভাসা ভাবে চিহ্নিত করে, তথ্যপ্রাচুর্যে ছবিকে ভরপুর করে সকল সমস্যা সমাধান খুঁজতে ছবির শেষপ্রান্তে তিনি দেশ ছেড়ে ছুটেছেন বিদেশে সেইসব ক্রেতার কাছে, যারা বাংলাদেশের শ্রমিকের সেলাইকরা বস্ত্র পরিধান করেন।

তাদের প্রতি নির্মাতা প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা যাতে কিঞ্চিত বেশি বেতন পায় তার জন্য তারা আরো বেশি দামে এসব পোশাক কিনতে রাজি আছেন কিনা। যেন ইউরোপ-আমেরিকার ঐসব নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত ক্রেতাই বাংলাদেশের শ্রমিকদের শোষক। আরো কিছু পাউন্ড তাদের খরচ করা উচিত। এই নৈতিক ব্ল্যাকমেইলে ক্রেতাকে ফেলে তাদের মুখ থেকে আদায় করে নিয়েছেন যে ‘তারা আরো কিছু বেশি দাম দিতে রাজি আছে। ’ তাহলে ফলাফল হলো তারা আরো বেশি দাম দেবেন, যা বায়ার এবং মালিকদের লুটেরাপুঁজিকে আরো শক্তিশালী করবে।

কারণ, নির্মাতা নিজেই তার ছবিতে দেখিয়েছেন, কিভাবে মালিকরা শ্রম আইন লঙ্ঘন করে বায়ারদের শর্ত ভেঙ্গে অমানবিকতার সর্বোচ্চে পৌঁছে, শ্রমিকের ন্যূনতম প্রাপ্যটুকুও নিজ হস্থগত করছেন। উৎপাদন এবং উৎপাদক সম্পর্কের সমস্ত নিয়মের বাইরে এমন একটি সিদ্ধান্তে দর্শকের মনোজগতকে কেন্দ্রীভূত করেন এক সময়ের বামপন্থি সংগঠক-তাত্ত্বিক তানভীর মোকাম্মেল যেখানে মালিক, বায়ার, প্রশাসন, সরকার সবকিছু উবে গিয়ে মুখোমুখি হয় শুধু ক্রেতা-বিক্রেতা। যুক্তি নির্মনের চাতুরিতে, সিদ্ধ হস্তে পুঁজির শোষণের দুই ক্ষেত্রকে লাগিয়ে দিয়ে মাঝখান থেকে মালিক ও রাষ্ট্রের শোষণ-নির্যাতন থেকে দৃষ্টি থেকে সরিয়ে দেন তিনি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদক ও ক্রেতা পরস্পরের কাছে অদৃশ্য ও অচেনা। ক্রেতার অবস্থান উৎপাদন সম্পর্কের বাইরে।

দুজনই আবার বাব্জার অর্থনীতিতে পণ্যের ক্রেতা ও শ্রমিক। এ অর্থে উভয়ই শোষিত। এই দুই শোষিতকে মুখোমুখি শক্র হিসাবে দেখিয়ে এক কাল্পনিক সমাধানসূত্র আবিস্কার করেছেন নির্মাতা। এ ছবি অবশ্য মাঝে মাঝেই আলিফ-লায়লার যুগে পদার্পণ করে। নির্মাতা পানির কথা বললে পানি, রোদের কথা বললে রোদ, এমনকি মিডলেভেল কর্মচারীর মুখে ‘শ্রমিক নির্যাতন নয় বরং মাঝে মধ্যে বকাবাজি’ দেখাতে কর্মচারীর মুখ থেকে নরম বকাও দর্শককে শুনিয়ে দিয়ে আস্বস্ত করেন।

এভাবে অবাস্তবতাকে বাস্তবতায় রূপদানের ক্ষমতা তার অসীম । অধিপতিদের ক্ষমতা সবসময় সীমাহীন। তারা গণতন্ত্র, সুশাসন, সহনশীলতা, মানবিকতা নানা কিছুর বোঝা জনগণের মাথায় চাপিয়ে তাকে অশিক্ষিত, বর্বর, নৈরাশ্য সৃষ্টিকারী বলে হীনম্মন্য করে তোলার চেষ্টা করেন। যে মনোভঙ্গি দ্বারা আবিষ্ট জনগণের ভূমিকা হয়ে উঠবে প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের ধর্ষণকারীদের আনুগত্যে থাকা। বাস্তব দেনা পাওনা, মালিক-শ্রমিক সম্পর্কে অধিকারের প্রশ্ন আড়ালের জন্য এগুলো সব কার্যকরী যুক্তি।

আর দেশীয় ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা মনস্তাত্বিক এ ধোলাইকরণে অপার মতাধর। গণমাধ্যমকে তারা সংযুক্ত রেখেছেন এ কাজে। নির্মাতার আত্মকর্মসংস্থানের এই প্রচেষ্টায় বাধা দেবার মতা দর্শক বা শ্রমিক কারোই নেই। তাই শেষ বিচারে এই ছবি এই দুই অংশের সঙ্গেই প্রতারণার স্বাক্ষর বহন করে। ............................................................... [লেখাটি সম্প্রতি ‌'চলচ্চিত্র বুলেটিন' ও শ্লেট নামের একটি অনুকাগজে প্রকাশিত হয়েছে।

আপনাদের কাছে আবারও তুলে ধরলাম। ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.