আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর ‘অবরোধবাসিনী’ থেকে পাঠ (৪)

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর (১৮৮০-১৯৩২) বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। তাঁর সম্বন্ধে আমরা কমবেশি জানি। তাঁর রচিত “অবরোধবাসিনী” বইটি আমাদের কারও কারও পড়া কিংবা কারও কারও এখনও পড়া হয়নি।

এ কারণেই বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন-এর অবরোধবাসিনী থেকে পাঠ-এর এই পরিকল্পনা। উদ্দেশ্য, একুশ শতকে বসে বেগম রোকেয়ার চিন্তার স্বরুপ উপলব্দি করা। [ ২১ ] বঙ্গদেশের কোন জমীদারের বাড়ী পুণ্যাহের উৎসব উপলক্ষে নাচ গান হইতেছিল। নর্ত্তকীরা বাহিরে যেখানে বিরাট শামিয়ানার নীচে নাচিতেছিল, সে স্থানটা বাড়ীর দেউড়ীর কামরা হইতে দেখা যাইত। কিন্তু বাড়ীর কোনও বিবি সে দেউড়ীর ঘরে যান নাই।

নৃত্য দর্শন ও সঙ্গীত শ্রবণের সৌভাগ্য লইয়া বিবিরা ধরাধামে আসেন নাই। জমীদার সাহেবের একটী তিন বৎসর বয়স্কা কন্যা ছিল। মেয়েটী দিব্যি গৌরাঙ্গী। তাহাকে আদর করিয়া কেহ বলিত, চিনির পুতুল, কেহ বলিত, ননীর পুতুল। নাম সাবেরা।

ভোরের সময় রৌশন চৌকির ভৈরবী আলাপে নিদ্রিত পাখীরা জাগিয়া কলরব আরম্ভ করিয়াছে। সাবেরার ‘খেলাই’ও (আধুনিক ভাষায় “আয়া”) জাগিয়া উঠিয়াছে। তাহার সাধ হইল, একটু নাচ দেখিতে যাইবে। কিন্তু সাবেরা তখনও ঘুমাইতেছিল। সুতরাং খেলাই সে নিদ্রিতা শিশুকে কোলে লইয়া ঘরে নাচ দেখিতে গেল।

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়! কর্ত্তা সেই সময় বহির্ব্বাটী হইতে অন্তঃপুরে আসিতেছিলেন। দেখিলেন, সাবেরাকে কোলে লইয়া খেলাই খড়খড়ির পাখী তুলিয়া তামাসা দেখিতেছিল। তাঁহার হাতে একটা মোটা লাঠি ছিল তিনি সেই লাঠি দিয়া খেলাইকে প্রহার আরম্ভ করিলেন। খেলাইয়ের চিৎকারে বিবিরা দৌড়িয়া দেউড়ী ঘরে আসিলেন। এক লাঠি লাগিল সাবেরার ঊরুতে।

তখন কর্ত্তার ভ্রাতৃবন্ধু অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “ছোট সাহেব, করেন কি! করেন কি! মেয়ে মেরে ফেলবেন?” প্রহারবৃষ্টি তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল। জমীদার সাহেব সক্রোধে কহিলেন, “হতভাগী, নিজে নাচ দেখবি, দেখ না, কিন্তু আমার মেয়েকে দেখাতে আনলি কেন?” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিশু ত খেলাইয়ের কাঁধে মাথা রাখিয়া গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিল,-সে বেচারী কিছুই দেখে নাই। বাড়ীময় শোরগোল পড়িয়া গেল। -সাবেরার দুধের মত শাদা ধবধবে ঊরুতে লাঠির আঘাতে এক বিশ্রী কালো দাগ দেখিয়া কর্ত্তাও মরমে মরিয়া গেলেন। এইরূপে লাঠির গুতায় আমাদের অবরোধ-কারায় বন্দী করা হইয়াছে।

[ ২২ ] শিয়ালদহ ষ্টেশনের প্লাটফরম ভরা সন্ধ্যার সময় এক ভদ্রলোকে ট্রেণের অপেক্ষায় পায়চারী করিতেছিলেন। কিছু দূরে আর একজন দাঁড়াইয়া ছিলেন; তাঁহার পার্শ্বে এক গাদা বিছানা ইত্যাদি ছিল। পূর্ব্বোক্ত ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ কান্তি বোধ করায় উক্ত গাদার উপর বসিতে গেলেন। তিনি বসিবা মাত্র বিছানা নড়িয়া উঠিল-তিনি তৎক্ষণাৎ সভয়ে লাফাইয়া উঠিলেন। এমন সময় সেই দণ্ডায়মান ভদ্রলোক দৌড়িয়া আসিয়া সক্রোধে বলিলেন,-“মশায়, করেন কি? আপনি স্ত্রীলোকদের মাথার উপর বসিতে গেলেন কেন?” বেচারা হতভম্ব হইয়া বলিলেন, “মাফ করিবেন, মশায়! সন্ধ্যার আঁধারে ভালমতে দেখিতে পাই নাই, তাই বিছানার গাদা মনে করিয়া বসিয়াছিলাম।

বিছানা নড়িয়া উঠায় আমি ভয় পাইয়াছিলাম যে, এ কি ব্যাপার!” [ ২৩ ] অপরের কথা দূরে থাকুক। এখন নিজের কথা কিছু বলি। সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দ্দা করিতে হইত। ছাই কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারও সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দ্দা করিতে হইত। পুরুষদের ত অন্তঃপুরে প্রবেশ নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই।

কিন্তু মেয়েমানুষের অবাধ গতি-অথচ তাহাদের দেখিতে না দেখিতে লুকাইতে হইবে। পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ীর কোন লোক চক্ষুর ইসারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র-কখনও রান্নাঘরের ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটীর অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নীচে লুকাইতাম। বাচ্চাওয়ালী মুরগী যেমন আকাশে চিল দেখিয়া ইঙ্গিত করিবা মাত্র তাহার ছানাগুলি মায়ের পাখার নীচে পলায়, আমাকেও সেইরূপ পলাইতে হইত। কিন্তু মুরগীর ছানার ত মায়ের বুক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট আশ্রয় থাকে, তাহারা সেইখানে পলাইয়া থাকে; আমার জন্য সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান ছিল না। আর মুরগীর ছানা স্বভাবতঃই মায়ের ইঙ্গিত বুঝে-আমার ত সেরূপ কোন স্বাভাবিক ধর্ম্ম (রহংঃরহপঃ) ছিল না।

তাই কোন সময় চক্ষের ইসারা বুঝিতে না পারিয়া দৈবাৎ না পলাইয়া যদি কাহারও সম্মুখীন হইতাম, তবে হিতৈষিণী মুরুব্বিগণ, “কলিকালের মেয়েরা কি বেহায়া, কেমন বেগয়রৎ” ইত্যাদি বলিয়া গঞ্জনা দিতে কম করিতেন না। আমার পঞ্চম বর্ষ বয়সে কলিকাতা থাকাকালীন দ্বিতীয়া ভ্রাতৃবধূর খালার বাড়ী-বেহার হইতে দুইজন চাকরাণী তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছিল। তাহাদের ‘ফ্রী পাসপোর্ট’ ছিল,-তাহারা সমস্ত বাড়ীময় ঘুরিয়া বেড়াইত, আর আমি প্রাণ-ভয়ে পলায়মান হরিণশিশুর মত প্রাণ হাতে লইয়া যত্র-তত্র-কপাটের অন্তরালে কিম্বা টেবিলের নীচে পলাইয়া বেড়াইতাম। ত্রিতলে একটা নির্জ্জন চিল-কোঠা ছিল; অতি প্রত্যুষে আমাকে খেলাই কোলে করিয়া সেইখানে রাখিয়া আসিত; প্রায় সমস্ত দিন সেইখানে অনাহারে কাটাইতাম। বেহারের চাকরাণীদ্বয় সমস্ত বাড়ী তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিবার পর অবশেষে সেই চিল-কোঠারও বিপদের সংবাদ দিল।

ভাগ্যে সেখানে একটা ছাপরখাট ছিল, আমি সেই ছাপরখাটের নীচে গিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া রহিলাম-ভয়, পাছে আমার নিঃশ্বাসের সাড়া পাইয়া সেই হৃদয়হীনা স্ত্রীলোকেরা খাটের নীচে উঁকি মারিয়া দেখে! সেখানে কতকগুলি বাক্স, পেটারা, মোড়া ইত্যাদি ছিল। বেচারা হালু, তাহার (৬ বৎসর বয়সের) ক্ষুদ্র শক্তি লইয়া সেইগুলি টানিয়া আনিয়া আমার চারিধারে দিয়া আমাকে ঘিরিয়া রাখিল। আমার খাওয়ার খোঁজখবরও কেহ নিয়মমত লইত না। মাঝে মাঝে হালু খেলিতে খেলিতে চিল-কোঠায় গিয়া উপস্থিত হইলে, তাহাকেই ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা বলিতাম। সে কখনও এক গ্লাস পানি, কখনও খানিকটা “বিন্নি” (খই বিশেষ) আনিয়া দিত।

কখনও বা খাবার আনিতে গিয়া আর ফিরিয়া আসিত না-ছেলে মানুষ ত, ভুলিয়া যাইত। প্রায় চারিদিন আমাকে ঐ অবস্থায় থাকিতে হইয়াছিল। [ ২৪ ] বেহার অঞ্চলে শরীফ ঘরানার মহিলাগণ সচরাচর রেলপথে ভ্রমণের পথে ট্রেণে উঠেন না। তাঁহাদিগকে বনাতের পর্দ্দা ঢাকা পাল্কীকে পুরিয়া, সেই পাল্কীতে ট্রেণের মালগাড়ীতে তুলিয়া দেওয়া হয়। ফল কথা, বিবিরা পথের দৃশ্য কিছুই দেখিতে পান না।

তাঁহারা ব্রুকবণ্ড চায়ের মত ঠধপঁঁস টিনে প্যাক হইয়া দেশ ভ্রমণ করেন। কিন্তু এই কলিকাতার এক ঘর সম্ভ্রান্ত পরিবার উহার উপরও টেক্কা দিয়াছেন। তাঁহাদের বাড়ীর বিবিদের রেলপথে কোথাও যাইতে হইলে প্রথমে তাঁহাদের প্রত্যেককে, পাল্কীতে বিছানা পাতিয়া, একটা তালপাতার হাত পাখা, এক কুজা পানি এবং একটা গ্লাস সহ বন্ধ করা হয়। পরে সেই পাল্কীগুলি তাঁহাদের পিতা কিম্বা পুত্রের সম্মুখে চাকরেরা যথাক্রমে-(১) বনাতের পর্দ্দা দ্বারা প্যাক করে; (২) তাহার উপর মোম-জমা কাপড় দ্বারা সেলাই করে; (৩) তাহার উপর খারুয়ার কাপড়ে ঘিরিয়া সেলাই করে; (৪) তাহার পর বোম্বাই চাদরের দ্বারা সেলাই করে; (৫) অতঃপর সর্ব্বোপরে চট মোড়াই করিয়া সেলাই করে। এই সেলাই ব্যাপার তিন চারি ঘণ্টা ব্যাপিয়া হয়-আর সেই চারি ঘণ্টা পর্য্যন্ত বাড়ীর কর্ত্তা ঠায় উপস্থিত থাকিয়া কাড়া পাহারা দেন।

পরে বেহারা ডাকিয়া পাল্কীগুলি বনাতের পর্দ্দা ঢাকা অবস্থায় রাখিয়া চাকরেরা সরিয়া যায়। পরে কর্ত্তা স্বয়ং বন্দিনীদের অজ্ঞান অবস্থায় বাহির করিয়া যথারীতি মাথায় গোলাপজল ও বরফ দিয়া, মুখে চামচ দিয়া পানি দিয়া, চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়া বাতাস করিতে থাকেন। দুই ঘণ্টা বা ততোধিক সময়ের শুশ্রূষার পর বিবিরা সুস্থ হন। [ ২৫ ] “অবরোধ-বাসিনী”র ১১নং ঘটনায় লিখিয়াছি যে, আমি গত ১৯২৪ সনে আমার দুই নাতিনের বিবাহোপলক্ষে আরায় গিয়াছিলাম। কিন্তু আমি আরা শহরটায় সেই বাড়ীখানা এবং আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাই নাই।

আমার “মেয়েকে” (অর্থাৎ মেয়ের মৃত্যুর পর জামাতার দ্বিতীয় পরে স্ত্রীকে) সেই কথা বলায় তিনি অতি মিনতি করিয়া আমাকে বলিলেন, “আম্মা, আপনি যদি দয়া করিয়া শহর দেখিতে চান, তবে আমরাও আপনার জুতার বরকতে শহরটা একটু দেখিয়া লইব। আমরা সাত বৎসর হইতে এখানে আছি, কিন্তুু শহরের কিছুই দেখি নাই। ” সদ্যপরিণীতা মজু এবং সবুও সকাতরে বলিল, “হ্যাঁ নানি আম্মা, আপনি আব্বাকে বলিলেই হইবে। ” আমি ক্রমান্বয়ে কয়েকদিন বাবাজীবনকে একখানা গাড়ী সংগ্রহ করিয়া দিতে বলায়, তিনি প্রতিদিনই অতি বিনীতভাবে জানাইতেন যে গাড়ী পাওয়া যায় না। শেষের দিন বিকালে তাঁহার ১১ বৎসর বয়স্ক পুত্র আমাদের সংবাদ দিল যে যদি বা একটা ভাড়াটে গাড়ী আসিয়াছে।

কিন্তু তাঁহার জানালার একটা পাখী ভাঙ্গা। মজু অতি আগ্রহের সহিত বলিল, “সেখানটায় আমরা পর্দ্দা করিয়া লইব-আল্লার ওয়াস্তে তুমি গাড়ী ফেরত দিও না। ” সবু ফিস্ফিস্ করিয়া বলিল, “ভালই হইয়াছে, ঐ ভাঙ্গা জানালা দিয়া ভালমতে দেখা যাইবে। ” আমরা যতবারই গাড়ীতে উঠিতে যাইবার জন্য তাড়া দিই, ততবারই শুনিঃ সবুর করুন, বাহিরে এখনও পর্দ্দা হয় নাই। কিছুণ পরে গাড়ীতে উঠিতে দিয়া দেখি, সোবহান আল্লাহ! দুই তিন খানা বোম্বাই চাদর দিয়া গাড়ীটি সম্পূর্ণ ঢাকিয়া ফেলা হইয়াছে।

জামাতা স্বয়ং গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিলেন, আমরা গাড়ীতে উঠিবার পর তিনি স্বহস্তে কাপড় দিয়া দরজা বাঁধিয়া দিলেন। গাড়ী কিছু দূরে গেলে, মজু সবুকে বলিল, “দেখ এখন ভাঙ্গা জানালা দিয়া!” সেই পর্দ্দার এক স্থলে একটা ছিদ্র ছিল, মজু, সবু এবং তাহাদের মাতা সেই দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিতে লাগিলেন, আমি আর সে ফুটা দিয়া দেখিবার জন্য তাহাদের সহিত কাড়াকাড়ি করিলাম না। [ ২৬ ] আমাদের ন্যায় আমাদের নামগুলি পর্য্যন্ত পর্দ্দানশীল। মেয়েদের নাম জানা যায়, কেবল তাহাদের বিবাহের কাবিন লিখিবার সময়। এক মস্ত জমীদারের তিন কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে হইতেছিল।

মেয়েদের ডাকনাম বড় গেন্দলা, মেজো গেন্দলা, এবং ছোট গেন্দলা-প্রকৃত নাম কেহই জানে না। তাহাদের সম্পর্কের এক চাচা হইলেন বিবাহ পড়াইবার মোল্লা। কন্যাদের বয়স অনুসারে তিন জল বরের বয়সেরও তারতম্য ছিল। তিন জন বরই বিবাহ কেন্দ্রে অনুপস্থিত। আমরা পাঠিকাদের সুবিধার নিমিত্ত বরদিগকে বয়স অনুসারে ১নং, ২নং এবং ৩নং বলিব।

মোল্লা সাহেবের হাতে তিন বর এবং তিন কন্যার নামের তালিকা দেওয়া হইয়াছে। তিনি যথাসময় বিবাহের মন্ত্র পড়াইতে বসিয়া ভ্রমণবশতঃ বর ও কন্যাদের নাম গোলমাল করিয়া ১নং বরের সহিত ছোট গেন্দলার বিবাহ দিয়া দিলেন; ৩নং বরের সহিত মেজো গেন্দলার বিবাহ দিলেন। এখন ২নং বরের সহিত বড় গেন্দলার বিবাহের পালা। মেজো ও ছোট গেন্দলার বয়স খুব অল্প-১১ এবং ৭ বৎসর, তাই তাহারা কোন উচ্চ বাচ্য করে নাই। কিন্তু বড় গেন্দলার বয়স ১৯ বৎসর; সে লুকাইয়া ছাপাইয়া মুরুব্বিদের কথাবার্ত্তা শুনিয়া জানিয়াছিল, তাহার বিবাহ হইবে, ১নং বরের সহিত।

আর বরের নামও তাহার জানা ছিল। সুতরাং ২নং বরের নাম লইয়া মোল্লা সাহেব যখন বড় গেন্দলার “এজেন” চাহিলেন, সে আর কিছুতেই মুখ খোলে না। মা, মাসীর উৎপীড়ন সহ্য করিয়াও সাহেবকে বলিলেন, “হাঁম গেন্দলা হুঁ বলেছে; বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি আর কতকণ হয়রাণ হবে। ” তিনি বলিলেন, “আমরা গেন্দলার মুখের “হুঁ” শুনি নাই, তবে কি আপনার “হুঁ” লইয়া আপনারই বিবাহ পড়াইব নাকি?” তদুত্তরে ক’নের মা তাঁহার পিঠে এক বিরাট কিল বসাইয়া দিলেন। অবশেষে গেন্দলা বেচারী “হুঁ” বলিল কিনা আমরা সে খবর রাখি না।

এদিকে যথাসময়ে টেলিগ্রাফযোগে ৩০ বৎসর বয়স্ড়্গা ১নং বর যখন জানিলেন যে, তাঁহার বিবাহ হইয়াছে, (১৯ বৎসর বয়স্কা বড় গেন্দলার পরিবর্ত্তে) সর্ব্বকনিষ্ঠা ৭ম বর্ষীয়া ছোট গেন্দলার সহিত তখন তিনি চটিয়া লাল হইলেন-শাশুড়ীকে লিখিলেন কন্যা বদল করিয়া দিতে; নচেৎ তিনি তাঁহার বিরুদ্ধে জুয়াচুরির মোকদ্দমা আনিবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। [ ২৭ ] প্রায় ১০/১১ বৎসরের ঘটনা। বলিয়াছি ত বেহার অঞ্চলে বিবাহের তিন মাস পূর্ব্বে “মাইয়া-খানায়” বন্দী করিয়া মেয়েদের আধমরা করা হয়। ও তখনও ঐ বন্দিশালায় বসিবার মেয়াদ,-যদি বাড়ীতে কোন দুর্ঘটনা হইয়া বিবাহের তারিখ পিছাইয়া যায় তবে-বৎসর কালও হয়; এক বেচারী সেইরূপ ছয়মাস পর্য্যন্ত বন্দিনী ছিল। তাহার স্নান, আহার প্রভৃতির বিষয়েও যথাবিধি যতœ লওয়া হইত না।

একেই ত বেহারী লোকেরা সহজে স্নান করিতে চায় না, তাহাতে আবার “মাইয়াখানা”র বন্দিনী মেয়েকে কে ঘন ঘন স্নান করাইবে? ঐ সময় মেয়ে মাটিতে পা রাখে না-প্রয়োজনমত তাহাকে কোলে করিয়া স্নানাগারে লইয়া যাওয়া হয়। তাহার নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। সমস্ত দিন মাথা গুঁজিয়া একটা খাটিয়ার উপর বসিয়া থাকিতে হয়; রাত্রিকালে সেইখানেই শুইতে হয়। অপরে মুখে তুলিয়া ভাতের গ্রাস খাওয়ায়, অপরে “আবখোয়া” ধরিয়া পানি খাওয়াইয়া দেয়। মাথার চুলে জটা হয়, হউক-সে নিজে মাথা আঁচড়াইতে পাইবে না-ফল কথা, প্রত্যেক বিষয়ের জন্য তাহাকে পরের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে হয়।

যাহা হউক, ছয় মাস অন্তর সেই মেয়েটীর বিবাহ হইলে দেখা গেল, সর্ব্বদা চক্ষু বুজিয়া থাকার ফলে তাহার চক্ষু দুইটী চিরতরে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। [ ২৮ ] বহুকালের ঘটনা। বহু পুণ্যফলে আরবদেশীয় কোন মহিলা কলিকাতায় তশরীফ আনিয়াছেন। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দ্দু বলিতে শিখিয়াছিলেন। যখন দলে দলে বিবিরা পাল্কীযোগে তাঁহার জেয়ারত করিতে আসিতেন, তিনি পাল্কী দেখিয়া হয়রাণ হইতেন যে এ “আজাব” কেন? একদিন পূর্ব্ববঙ্গের এক বিবি আসিয়াছিলেন।

আরবীয়া মহিলা কুশল প্রশ্ন প্রসঙ্গে আগন্তুক বিবির স্বামীর কুশল জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর দান কালে বাঙ্গাল বিবি মাথার ঘোমটা টানেন আর বলেন, “তানি ত বালই আছেন, তানার আবার কি অনব? তানি ত বালই আছেন। ” বেচারী আরবীয়া বিবি বুঝিতেই পারিলেন না যে, স্বামীর কুশল বলিবার সময় ঘোমটা টানার প্রয়োজন হইল কেন? আরবীয়া বিবি বাঙ্গালায় বিবিদের পাল্কীতে উঠা ব্যাপারটা কৌতুকের সহিত দাঁড়াইয়া দেখিতেন। একদিন এক বোরকা পরিহিতা বিবি পাল্কীতে উঠিলেন, তাঁহার কোলে দুই বৎসরের শিশু, সঙ্গে পানদান, একটা বড় কাঠের বা, একটা কাপড়ের গাঁটরী এবং এক কূজা পানি। পাল্কীটার বেতের ছাউনি ভাঙ্গা ছিল, তাহা পূর্ব্বে কেহ লক্ষ্য করে নাই পাল্কীর দুই পার্শ্বে তুলিল, অমনি মড়মড় করিয়া পাল্কীর বেত্রাসন ভাঙ্গিতে লাগিল। পাল্কীর দুই পার্শ্বে দুই বরকন্দাজ চলিয়াছে-তাঁহারা শিশুটিকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সাহেবজাদা মড়মড় শব্দ করে কি?” কিন্তু পাল্কী হইতে কোন উত্তর আসিল না;- একটু পরে গেট পার হইয়া পাল্কীটা অত্যন্ত হালকা বোধ হওয়ায় বেহারাগণ থমকিয়া দাঁড়াইল।

ওদিকে ভাঙ্গা পাল্কী গলাইয়া বোরকা পরা বিবি ছেলেকে আঁকড়িয়া ধরিয়া মাটীতে বসিয়া পড়িয়াছেন; গাঁটরী, পানদান সব ইতস্ততঃ বিপ্তি। কূজা ভাঙ্গিয়া পানি পড়িয়া তিনি ভিজিয়া গিয়াছেন,-কিন্তু তবু মুখে বলেন নাই-“পাল্কী থামাও!” কলিকাতার রাস্তায় এই ব্যাপার!-বেচারী আরবের বিবি তাড়াতাড়ি চাকরাণী পাঠাইয়া বিবিটীকে আনাইয়া বলিলেন, “বিবি, পাল্কীর এমন তামাসা দেখিবার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না!” [ ২৯ ] একবার আমি কোন একটী লেডীজ কনফারেন্স উপলক্ষে আলীগড়ে গিয়াছিলাম। সেখানে অভ্যাগতা মহিলাদের নানাবিধ বোরকা দেখিলাম। একজনের বোরকা কিছু অদ্ভুত ধরণের ছিল। তাঁহার সহিত আলাপ পরিচয়ের পর তাঁহার বোরকা প্রশংসা করায় তিনি বলিলেন,-“আর বলিবেন না,-এই বোরকা লইয়া আমার যত লাঞ্ছনা হইয়াছে!” পরে তিনি সেই সব লাঞ্ছনার বিষয় যাহা বলিলেন, তাহা এইঃ তিনি কোন বাঙ্গালী ভদ্রলোকের বাড়ী শাদীর নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন।

তাঁহাকে (বোরকা সহ) দেখিবামাত্র সেখানকার ছেলে-মেয়েরা ভয়ে চীৎকার করিয়া কে কোথায় পলাইবে, তাহার ঠিক নাই। আরও কয়েক ঘর বাঙ্গালী ভদ্রলোকের সহিত তাঁহার স্বামীর আলাপ ছিল, তাই তাঁহার সকলেল বাড়ীই যাইতে হইত। কিন্তু যতবার যে বাড়ী গিয়াছেন, ততবারই ছেলেদের সভয় চীৎকার ও কোলাহল সৃষ্টি করিয়াছেন। ছেলেরা ভয়ে থরথর কাঁপিত। তিনি একবার কলিকাতায় আসিয়াছিলেন।

তাঁহারা চারি পাঁচ জনে বোরকাসহ খোলা মোটরে বাহির হইলে পথের ছেলেরা বলিত, “ওমা! ওগুলো কি গো?” একে অপরকে বলে “চুপ কর!-এই রাত্রিকালে ওগুলো ভূত না হয়ে যায় না। ” বাতাসে বোরকার নেকার একটু আধটু উড়িতে দেখিলে বলিত-“দেখবে দেখ। ভূতগুলো শুঁড় নড়ে-! বাবারে! পালা রে!” তিনি এক সময় দার্জ্জীলিং গিয়াছিলেন। ঘুম ষ্টেশনে পৌঁছিলে দেখিলেন, সমবেত জনমণ্ডলী একটা বামন লোককে দেখিতেছে-বামনটা উচ্চতায় একটা ৭/৮ বৎসরের বালকের সমান, কিন্তু মুখটা বয়োপ্রাপ্ত যুবকের,-মুখভরা দাড়ী গোঁফ। হঠাৎ তিনি দেখিলেন, জনমণ্ডলীর কৌতূকপূর্ণ দৃষ্টি তাঁহার দিকে! দর্শকেরা সে বামন ছাড়িয়া এই বোরকাধারিণীকে দেখিতে লাগিল! অতঃপর দার্জ্জিলিং পৌঁছিয়া তাঁহারা আহারান্তে বেড়াইতে বাহির হইলেন; অর্থাৎ রিকশ গাড়ীতে করিয়া যাইতেছিলেন।

“মেলে” গিয়া দেখিলেন, অনেক লোকের ভীড়; সেদিন তিব্বত হইতে সেনা ফিরিয়া আসিতেছিল, সেই দৃশ্য দেখিবার জন্য ভীড়। তাঁহার রিকশখানি পথের একধারে রাঁখিয়া তাঁহার কুলিরাও গেল,-তামাসা দেখিতে। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দেখেন, দর্শকেরা সকলেই এক একবার রিকশর ভিতর উঁকি মারিয়া তাঁহাকে দেখিয়া যাইতেছে। তিনি পদব্রজে বেড়াইতে বাহির হইলে পথের কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিত। দুই একটা পার্ব্বত্য ঘোড়া তাঁহাকে দেখিয়া ভয়ে সওয়ার শুদ্ধ লাফালাফি আরম্ভ করিত।

একবার চায়ের বাগানে বেড়াইতে গিয়া দেখেন, তিনি চারি বৎসরের এক বালিকা মস্ত ঢিল তুলিয়াছে, তাঁহাকে মারিতে!* একবার তাঁহার পরিচিতা আরও চারি পাঁচজন বিবির সহিত বেড়াইবার সময় একটা ক্ষুদ্র ঝরণার ধারে কঙ্করবিশিষ্ট কাদায় সকলেই বোরকায় জড়াইয়া পড়িয়া গেলেন। নিকটবর্ত্তী চা বাগান হইতে কুলিরা দৌড়িয়া আসিয়া তাঁহাদের তুলিল; আর স্নেহপূর্ণ ভৎর্সনায় বলিল, “একে ত জুত্তা পরেছ, তার উপর আবার ঘেরাটোপ,-এ অবস্থায় তোমরা গড়াইবে না ত কি করিবে?” আহা! বিবিদের কারচুপি কাজ করা দো-পাট্রা কাদায় লতড়-পতড়, আর বোরকা ভিজিয়া তর-বতর! কেবল ইহাই নহে, পথের লোক রোরুদ্যমান শিশুকে চুপ করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিত,-“চুপ কর, ঐ দেখ মক্কা মদিনা যায়,-ঐ!”-ঘেরাটোপ জড়ানো জুজুবুড়ী,-ওরাই মক্কা মদিনা!!” * বাঙ্গালী ও গুর্খায় প্রভেদ দেখুন; যৎকালে বাঙ্গালী ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করিয়া দৌড়াদৌড়ি করিয়া পলাইত, সে সময় গুর্খাশিশু আত্মরক্ষার জন্য ঢিল তুলিয়াছে সে ভয়াবহ বস্তুকে মারিতে! [ ৩০ ] কোন একটী কুলে শীলে ধন্য সৎ পাত্রের সহিত এক জমীদারের বয়োপ্রাপ্তা কন্যার বিবাহ ঠিক হইয়াছিল। কি কারণে বরের পিতার সহিত কন্যাকর্ত্তার ঝগড়া হওয়ায় বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। ইহাতে পাত্রী যাহার পর নাই দুঃখিতা হইল। কন্যার পিতা তাড়াতাড়ি অন্য বর না পাইয়া নিজের এক দুরাচার ভ্রাতুস্পুত্রের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে বসিলেন।

সে বেচারী তাহার খুড়তাতো ভাইয়ের কুকীর্ত্তির বিষয় সমস্তই অবগত ছিল,-কত দিন সে নিজেই ঐ মাতালটাকে তেঁতুলের শরবত খাওয়াইয়া এবং মাথায় জল ঢালিয়া তাহার মাতলামী দূর করিতে চেষ্টা করিয়াছে। সুতরাং এ বিবাহে তাহার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু পাত্রী ত মূক,-তাহার বাকশক্তি থাকিয়াও নাই। তাহার একমাত্র সম্বল নীরব রোদন। তাই সে কেবল কাঁদিয়া চক্ষু ফুলাইয়াছে, আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছে।

কিন্তু নিষ্ঠুর পিতামাতার ভ্রক্ষেপ নাই,-তাঁহারা ঐ মাতালের সহিত তাহার বিবাহ দিবেনই দিবেন। এইরূপেই আমাদের কাঠমোল্লা মুরুব্বিগণ শরিয়তের গলা টিপিয়া মারিয়া ইসলাম ও শরিয়ত রক্ষা করিতেছে। বিবাহ-সভায় বসিয়া পাত্রী কিছুতেই “হুঁ” বলিতেছিল না। মাতা, পিতামহী প্রভৃতির অনুনয়, সাধ্য-সাধনা, মিষ্ট র্ভৎসনা,-সবই সে দুই চরে জলে ভাসাইয়া দিতেছিল। অবশেষে একজনে অতর্কিতে কন্যাকে খুব জোরে চিমটি কাটিল; সেই আঘাতে সহসা “উহু-!” বলিয়া সে কাতর ধ্বনি করিয়া উঠিল।

সেই “উহু” কে “হুঁ” বলিয়া ধরিয়া লইয়া তাহার বিবাহ ক্রিয়া সমাপ্ত হইল। সোবহান আল্লাহ্! জয়, অবরোধের জয়! ক্রমশ ...
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।