আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবদুশ শাকুরের 'উর্দু কাব্যে নারীবাদী কণ্ঠ' : একটি তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধ



এই প্রবন্ধটি আমার সম্পাদিত পত্রিকা 'দীপন'-এ প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকনন্দিত এই প্রবন্ধটি এই ব্লগ-এর পাঠকদের জন্য নিবেদিত হল। আশাকরি লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে। উর্দুকাব্যে নারীবাদী কণ্ঠ আবদুশ শাকুর উর্দুসাহিত্যের মতো পুংলিঙ্গপ্রধান আর কোনো সাহিত্য আছে কিনা আমি জানি না। তবে এটুকু শুনেছি যে শিশ্নশাসিত উর্দুকাব্যের অনুরূপ কাব্য আর কোনো ভাষায় নেই।

উর্দুকবিতার চসার বলে কথিত ওয়ালী মোহাম্মদ ওয়ালী (১৬৬৭-১৭০৭) থেকে বরং আরো পূর্বের প্রথম দিককার কবি নুসরাতী, হাশ্মি, ওয়াজ্হি এমনকি ভাষাটির অধুনা স্বীকৃত প্রথম কবি মোহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ কুতুব (১৫৬৫-১৬১১) থেকে ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত উর্দুকাব্য ছিল একান্তই পুংচিহ্নসর্বস্ব। বস্তুত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত উর্দু ভাষায় কবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য কোনো নারীর নামই পাওয়া যায় না। পাওয়া যাবেইবা কীভাবে? উর্দুকাব্যে নারী তো বিষয়ীই ছিলেন না কখনো। তিনি ছিলেন বিষয়মাত্রÑ পুরুষ কবির কামনার তৃষ্ণার ও ক্ষুধার বিষয়। তার অতিরিক্ত নারীর কোনো অস্তিত্বই কল্পিত হয়নি সে-কাব্যে।

রুখসানা আহমেদ তাঁর সম্পাদনায় পাকিস্তানে প্রকাশিত প্রথম নারীবাদী কবিতার অনূদিত সঙ্কলন ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ (১৯৯০) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে উর্দুকাব্যের সিংহভাগ এখনো সনাতন কল্পনা ও বাগ্ধারার প্রেমের কবিতাই। কল্পনাগুলি পেটেন্ট, যেমন পুরুষ কবি হলেন কারক শক্তি আর নাজুক প্রেমাস্পদা হলেন তাঁর ক্রিয়াসামগ্রী। বস্তুটি অপরূপ রূপের আধারÑ মৃগনয়না, কৃষ্ণকুন্তলা ইত্যাদি। এমন আরাধ্য বস্তুর জন্য কবি প্রাণও বিসর্জন দিতে পারেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য যে বস্তুটি কখনো অন্যমনস্ক, কখনো লজ্জানত, কখনো বিনয়াবনত।

কখনো মনে হয় কবির লীলাচঞ্চল প্রেমাস্পদা কেবল খামখেয়ালী আর অনির্দেশ্যই নয়, নির্মম নিষ্ঠুর অবিশ্বস্ত এক ছলনাময়ী। তবে হতে পারে যে কবির এ-প্রিয়া শুধুই রহস্যময়ী এবং সে-সুবাদেও কেবলি জ্বালাময়ী। মোটামুটি এই সনাতন ধারাটির উত্তরাধিকারী ছিলেন তিরিশ ও চল্লিশের দশকের, সামাজিক পরিবর্তন এবং সাম্যবাদে দায়বদ্ধ, প্রগতিবাদী কবিবৃন্দও। এঁদের কবিতায়ও নারী ছিলেন সৌন্দর্যের মূর্তিমতী অনুলিপি এবং পবিত্রতার আধার। এই গোষ্ঠীটির কাব্যে পেলব এ-মানবী প্রায়শই চিত্রিত হয়েছেন উৎপীড়ক সমাজের নিপীড়ক কাঠামোর দুর্বল শিকার হিসেবেÑ যিনি তাঁর সঙ্গিন দুর্দশার হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্য উদারচিত্ত পুরুষকুলের ন্যায়বোধের উপর নির্ভরশীল।

এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি একটি দৃষ্টান্ত কবি সাহির লুধিয়ান্ভীর (১৯২২-১৯৮০) কবিতা ‘চাক্লে’ (গণিকালয়)। কবিতাটিতে যৌনকর্মীর মাংসব্যবসার ভয়াবহ চিত্রটি অঙ্কনকালে কবি মিনতি জানিয়ে বলেন : ‘মদদ চাহ্তি হ্যয় ইয়ে হাওয়া কি বেটি য়াশোদা কি হামজিন্স্, রাধা কি বেটি পয়গাম্বর কি উম্মত, জুলায়খা কি বেটি সানাখানা-এ তাক্দীস-এ মাশরিক কাহাঁ হ্যাঁয়?’ *[সাহায্য চায় এই ইভের কন্যা যশোদার জাতি, রাধার এ কন্যা পয়গাম্বরের উম্মত, জুলায়খার এ কন্যা কোথায় তাঁরা যাঁরা প্রাচ্যের পবিত্রতার গুণগান করে থাকেন?] প্রগতিবাদী কবিগণ কখনোসখনো সমাজসংস্কারকের ভূমিকাও পালন করেছেন, কদাচিৎ নারী নির্যাতনের ইশুটি তুলে ধরে তাঁদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাও ফোকাসে এনেছেন। যেমন কবি ইসরারুল হক ‘মাজায’ তাঁর ‘পর্দা আওর ইসমত’ (পর্দা এবং ইজ্জত)-শীর্ষক কবিতায় পর্দা-প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টীকা-ভাষ্য উচ্চারণ করেন এরকম : ‘জো যাহের না হো, উও লাতাফতি নেহি হ্যায় জো পিনহাঁ রহে, উও সাদাকাত নেহি হ্যায় ইয়ে ফিতরাত নেহি হ্যয়, মাশিয়াত নেহি হ্যায় কোয়ি আওর শায়্ হ্যয়, ইয়ে ইসমাত নেহি হ্যায়’ [যা দৃশ্য নয়, তা অনিন্দ্য হতে পারে না যা অগোচরে থাকে, তা অকৃত্রিম হতে পারে না এটা প্রকৃতি নয়, নয় এটা নিয়তি আর যা-ই হোক, এটা সুকৃতি নয়। ] প্রগতিবাদী কবি ক্কচিৎ কদাচিৎ নারীকে বিপ্লবগর্ভ এবং সমাজ রূপান্তরের সক্রিয় মাধ্যম জ্ঞানও করেছেন, যিনি জনজীবনের মঞ্চে একটা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারেন। যেমন কবি ‘মাজায’ তাঁর ‘নওজোয়ান খাতুন সে’ (‘নব যুবতী রমণীর প্রতি’) কবিতাটিতে লিখেছেন : ‘হিজাবে ফিত্না-পরওয়ার আব্ উঠা লেতি তো আচ্ছা থা তু খোদ্ আপ্নে হুস্ন্ কো পর্দা বানা লেতি তো আচ্ছা থা ইয়ে তেরা র্যাদ্ রুখ্, ইয়ে খুশ্ক্ লব্, ইয়ে ওয়হম্, ইয়ে ওয়াহ্শতি তু আপ্নে র্সা সে ইয়ে বাদল্ হটা লেতি তো আচ্ছা থা তেরে মাথে পে ইয়ে আঁচল বহুত্ হি খুব হ্যায় লেকিন্ তু ইস্ আঁচল সে এক্ পরচ্ম্ বানা লেতি তো আচ্ছা থা।

’ [ভালো হত যদি তুমি এই অশোভন ঘোমটা খুলে ফেলতে ভালো হত যদি তুমি তোমার সৌন্দর্যকেই বোরখা বানিয়ে ফেলতে তোমার পাণ্ডুর মুখাবয়ব, শুষ্ক ওষ্ঠ, তোমার উদ্বেগ আর আতঙ্কÑ এই সমস্ত নীরদপুঞ্জ তোমার মাথা থেকে হটিয়ে দিলে ভালো হত তোমার মাথার ওপর এই আঁচল অতীব সুন্দর বটে তবে এই আঁচল দিয়ে একটা লাল ঝান্ডা বানিয়ে নিলে ভালো হতো। ] ‘মাজাযে’র এই কবিতা নারীকে পর্দার আড়ালে ঠেলে সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার বিরুদ্ধে দৃশ্যত প্রতিবাদ হলেও এর ভেতরে মুরুব্বিয়ানার সুরটিও লক্ষণীয়। পৃষ্ঠপোষকের এই ভূমিকায় পুরুষকে নারীর উপরিক পদটিতে বহালই রাখে। সম্ভবত প্রগতিবাদী কবিগোষ্ঠীর যে-কবিতাটি নারীকে তার স্বাধিকারবলে বিষয়ীর ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করার নিকটতম দূরত্বে পৌঁছে যায়, সেটি হল কাইফি আজমীর ‘আওরত’ (নারী)। দীর্ঘ কবিতাটির প্রথম স্তবক নিম্নরূপ : ‘কাদ্র্ আব্ তক্ তেরি তারিখ নে জানি হি নেহি তুঝ্ মে শোলে ভি হ্যাঁয়, বস্ আশ্ক-ফিশানি হি নেহি তু হাকিকাত্ ভি হ্যায়, দিলচস্প্ কাহানি হি নেহি তেরি হাস্তি ভি হ্যয় এক চীজ, জাওয়ানি হি নেহি আপ্নি তারিখ কা উন্ওয়ান্ বদল্না হ্যয় তুঝে উঠ্ মেরি জান্, মেরে সাথ্ হি চল্না হ্যয় তুঝে।

’ [এখনো পর্যন্ত তোমার গুরুত্ব ইতিহাস বুঝতেই পারেনি শুধু অশ্রুপাতেরই নয়, অগ্নুৎপাতের ক্ষমতাও আছে তোমার মধ্যে কেবল চিত্তাকর্ষক কাহিনীমাত্র নও, তুমি একটি বাস্তবিক চরিত্রও যৌবনের অতিরিক্ত একটি অস্তিত্বও আছে তোমার নিজের ইতিহাসের বিষয়বস্তু বদলাতে হবে তোমাকে উঠে এস প্রাণতমা, আমার সঙ্গেই চলতে হবে তোমাকে। ] সম্পূর্ণ কবিতাটিতে পুরুষের সহযাত্রী হবার উদ্দেশ্যে নারীর আমূল পরিবর্তন কামনা করেছেন কবি। তিনি নারীকে তাঁর গতানুগতিকতার গ-ি থেকে, চারুতা-নাজুকতা, তথা তাঁর তাবত ‘নারী সুলভতা’, এমনকি ভালোবাসার বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে আসার প্রণোদনা দিয়েছেন। তাঁকে সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণাধীনতার যাবতীয় কলকবজা চূর্ণ করে ছুটে আসার পরামর্শ দিয়েছেন কবি। তবু কাইফির এ কবিতাও নারীকে সমান অধিকার দেবার কথা ভাবছে বলে মনে হয় না।

কারণ নারীকে কমরেডের মতো সাথীর পদে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েও কবি তাঁকে বলছেন ‘মেরে সাথ হি চল্ না হ্যায় তুঝে’। এছাড়া নারীর ‘চলতি চরিত্রায়নের’ ধারাটিও কবি সম্পূর্ণ বর্জন করতে পারেননি বলেই অগ্নুৎপাতের ক্ষমতাকে নারীর অশ্রুপাতের বিকল্প না বলে, বলছেন ‘অতিরিক্ত’। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এমনি বিক্ষিপ্ত কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন ছাড়া প্রগতিবাদী কবিদের কেউই দ্ব্যর্থহীনভাবে নারীকে স্বয়ম্ভর সত্তা জ্ঞান করেননি কিংবা আপসহীনভাবে তাঁর স্বাধীন ক্ষমতায়নের কথা বলেননি। উর্দুকাব্যে সেই শুভ সূচনাটির জন্য পাকিস্তানের নারীবাদী কবিদের আগমনের পথ চেয়ে বসে থাকতে হয়েছিল উর্দুসাহিত্যের পাঠকদের। এর কারণ অবধারণের জন্যে এখানে একবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটির দিকে ফিরে দেখতে হবে।

স্বভাবকপট ব্রিটিশ জাতি তার ঔপনিবেশিক স্বার্থ সংরক্ষণকল্পে উপমহাদেশ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম দুটি সম্প্রদায়কে হিংস্র পশুর মতো পরস্পরে লড়িয়ে দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় ঘটে যাওয়া বহুবিধ ট্র্যাজিডির একটি ছিল উর্দুভাষাটির দেশহারা হয়ে যাওয়া। ভাষাকে সাম্প্রদায়িক বিষয় করে তোলার বিষবৃক্ষটির বীজ ইতর ইংরেজ বহু পূর্বে বপন করে সযতেœ লালন করে আসছিলÑ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির অংশ হিসেবে। দখলদার ইংরেজ বিভাজন ও শাসন নীতিটি ভাষার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিল উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে উর্দুসাহিত্যে ‘নিশাতে সানিয়া’ বা রেনেসাঁস-এর সতেজ উদ্ভব দেখে। সেই নবজাগৃতি উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিরক্তি ও বিদ্রোহের সঞ্চার করছিল।

সূচনা হয়েছিল ‘কাওমি শায়েরি’ কিংবা জাতীয়তাবাদী কাব্যচর্চার, যার ফলশ্রুতিতে বিশ শতকের শুরুতে আলতাফ হোসেন হালী ও মোহাম্মদ হোসেন আজাদ উর্দুভাষীদের ‘কাওমি মুশায়েরা’র ধারা প্রবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই জাতীয়তাবোধই ১৯২০ সালের পর থেকে, জাঁ নেসার আখতারের ভাষায়, ‘আওয়ামী বেদারি কি লহর’ অর্থাৎ ‘গণজাগরণের তরঙ্গে’র সৃষ্টি করেছিল। এরই পরম্পরাতেই উর্দুসাহিত্যে ১৯৩০-এর দশকে প্রগতিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যা শোষক-শোষিতের ‘বাইনারি’ ধারার সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। উর্দুসাহিত্যের নবজাগৃতির এই ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী রূপ দেখেই দখলদার ইংরেজ এ-সাহিত্যের আধার উর্দুভাষাটিকেই দুর্বল করে তোলার মিশনে নেমেছিল। ১৮৬০-এর দশকেই তারা ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরুসম্প্রদায়ের মগজধোলাই করার কাজে সফল হয়েছিল এই বলে যে উর্দু বহিরাগত সম্প্রদায়ের ভাষা অর্থাৎ মুসলমানের ভাষা, প্রতিপক্ষে হিন্দীই স্থানীয় সম্প্রদায়ের ভাষা তথা হিন্দুর ভাষা।

সুতরাং সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর উচিত দেবনাগরী লিপির হিন্দী ভাষাকে প্রমোট করা এবং ফার্সী লিপির উর্দু ভাষাকে ডিমোট করা বরং ডিসোন্ করা। এটাই অ্যান্টনি ম্যকডানেলের ‘১৯০০ রেজলুশন’সহ বিবিধ কলোনিয়াল ডিক্রির সার কথা। বিষয়টি সবিস্তার জানার উদ্দেশ্যে পাঠকের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ পাঠ হল নতুন দিল্লীর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত, খ্রিস্টোফার আর. কিং প্রণীত ‘ওয়ান ল্যাঙ্গোয়েজ, টূ স্ক্রিপট্স ঃ দ্য হিন্দী মুভ্মেন্ট অফ দ্য নাইনটীন্থ সেঞ্চুরি’ (১৯৯৪)। একই ‘খারি বোলি’র দুটি সন্তান উর্দু ও হিন্দীকে ব্রিটিশরাজের সরকারী ষড়যন্ত্র বিবদমান ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রকোষ্ঠবদ্ধ করে দেবার পরেও হিন্দীভাষীদের ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ ছিল খারি-বোলিরই ভাষিক উত্তরাধিকারী ‘হিন্দুস্তানী’। উপমহাদেশের ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতেও উর্দু এবং হিন্দীকে আলাদা দুটি ভাষা হিসেবে দেখানো হয়নি।

১৯৬১ সাল নাগাদ ভাষা হিসেবে হিন্দুস্তানীকে চিরতরে বিদায় করে দিয়ে দেশবাসীকে বাধ্য করা হয়েছে হিন্দী কিংবা উর্দুর মধ্যে যে-কোনো একটি ভাষাকে বেছে নিতে। এভাবে যে-উর্দু বা রেখ্তা দিল্লীরই সৃষ্টি, সে-উর্দুকে ভারতের মুখের ভাষা থেকেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। উর্দুর জন্মভূমি ভারত থেকে দেশান্তরী হওয়া উর্দুভাষী পাকিস্তানী এলিট শ্রেণী কর্তৃক তাদের ভাষাটিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পর থেকে ভারতে উর্দু হয়ে গেল বিদেশের ভাষা বা আরো বিশেষ অর্থে ‘শত্রু’র ভাষা। অতঃপর ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদে’র প্রবক্তারা ভাষাটিকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে এবং উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের উর্দু চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্রিক এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা হারাতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় শত শত বৎসরের রাজধানীর ভাষাটি জাতীয় জীবনের প্রান্তিক অবস্থানে চলে যায় এবং একসময় অভিধা পায় ‘মুমূর্ষু ভাষা’র।

সাম্প্রদায়িক মহলবিশেষ প্রচার চালায় যে ভারতে উর্দুর শুধু জানাযা আর দাফনই বাকি। তবে বাস্তবে দাফন তো দূরস্থান, জানাযাকেও অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে দেয় ভাষাটির জন্মভূমির সাধারণ-জনরুচি আর জনপ্রিয় হিন্দী সিনেমার উর্দুকাব্যগীতি-প্রীতি। স্মরণ করুণ মির্জা গালিবের ‘দিলে নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যয়’ (মির্জা গালিব, ১৯৫৪), বাহাদুর শাহ জাফরের ‘লাগ্তা নেহি হ্যয় জী মেরা, (লাল কিলা, ১৯৫৭), ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ‘মুঝ সে প্যহলি সি মুহাব্বাত’ (কয়দী, ১৯৫৭), সাহির লুধিয়ানভীর ‘চলো একবার ফির সে আজনবী বন্ জায়ে হাম দোনুঁ’ (গুমরাহ, ১৯৬৩) কাইফি আজমীর ‘হো কে মজবুর মুঝে উস্নে ভুলায়া’ (হাকিকাৎ, ১৯৬৪), মোহাম্মদ ইকবালের ‘কভি আয় হাকিকাত-এ মুন্তাজার’ (দুলহান্ এক্ রাত কি, ১৯৬৭), মাজরুহ সুলতানপুরীর ‘হাম থে মাতায়ে কুচা ও বাজার’ (দাস্তাক, ১৯৭০), মীর তকী মীরের ‘দিখায়ে দিয়ে ইয়ুঁ, কে বেখোদ কিয়া’ (বাজার, ১৯৮২), ইত্যাদি । জনপ্রিয়তম গণমাধ্যম হিন্দী সিনেমায় এসব পঙ্ক্তিমালার এমনি ব্যাপক অন্তর্ভুক্তি ও সমন্বয় একদিকে জনজীবনে উর্দু ভাষার ভাবগ্রাহিতা ও সুবেদিতা চারিয়ে দিয়েছে এবং জনাদৃত একটি সঙ্গীতশৈলীও তৈরি করেছে। ভাষাটির সাধারণ আভিজাত্যের এবং কাব্যের বিশেষ প্রসাদগুণের কারণে ভারতের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীবিশেষের উর্দুকে কাফন পরানোর আকাক্সক্ষাপূরণ এখনো সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়।

সে-আত্মঘাতী খাহিশটি যেদিন পূরণ হবে, সেদিন অজস্র স্বনামধন্য হিন্দু উর্দুকবিদের বিদেহী আত্মা বিশেষ কষ্টই পাবে। তেমন যে-কয়েকজনের নাম এ-মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে তাঁরা হলেনÑ দিওয়ালী সিং ফরিদাবাদী ওরফে কাতিল্, ব্রিজনারায়ণ ওরফে চাক্বাস্ত্ (১৮৮২-১৯২৬), তিলকচাঁদ ওরফে মাহরুম, (১৮৮৭-১৯৬৫), রঘুপতি সাহায় ওরফে ফিরাক গোরখপুরী (১৮৯৬-১৯৮২), সুরজ নারায়ণ ওরফে মেহের (১৮৫৯Ñ১৯৩১), লাভু রাম মালসিয়ানি (১৮৮৪-১৯৭৬), জগত মোহন লাল ওরফে রাওয়াঁ (১৮৮৯-১৯৩৪), নরেশকুমার ওরফে শাদ (১৯২৭Ñ১৯৬৯) প্রমুখ। তবে দেশভাগের পর থেকে ভারতীয় রাজনীতির অ-বন্ধুসুলভ আচরণের কারণে, গত অর্ধ শতককালের উর্দুকাব্যচর্চার প্রগতিবাদী ধারা এবং নারীবাদী ধারা সম্পর্কে জানতে হলে তাকাতে হবে পাকিস্তানের দিকে। ভারতবর্ষীয় রাজনীতির সাম্প্রদয়িকীকরণের স্বাভাবিক পরিণামস্বরূপ দেশটির শতশত বৎসরের ঐতিহ্যবাহী ভাষা উর্দুরও সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটে গেল সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারাব ধারায় দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে। জন্মভূমি ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিমাতাসুলভ আচরণে ঘরছাড়া উর্দু রেফুজী হয়ে গেল পাকিস্তানে।

সেখানে স্থায়ী আশ্রয় পেলেও সেদেশে সে অভিবাসী। এই প্রক্রিয়ায় জন্মভূমিতে ভাষাটি অপর দেশের ভাষা এবং অপর ধর্মের ভাষা বলে গণ্য হতে থাকে এবং এভাবে প্রকৃতপক্ষে উর্দু অনতিবিলম্বেই দেশহারা হয়ে যায়। এই ট্র্যাজিক সত্যটি থেকেই প্রগতিবাদী কবি সাহির লুধিয়ানভীর ক্ষুব্ধ মন্তব্যটি কাব্যরূপ পেয়েছিল, ১৯৯৭ সালে গালিবের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষে : ‘জিন্ শাহরুঁ মে গুঞ্জী থী গালিব কি নাওয়া বরসুঁ উন্ শাহরুঁ মে আজ উর্দু বে-নাম-ও-নেশাঁ ঠ্যহ্রি আযাদী-এ কামিল কা এলান হুয়া জিস্ দিন মা’তুব্ জবাঁ ঠ্যহ্্রি, গাদ্দার জবাঁ ঠ্যহ্্রি জিস্ আহ্দে সিয়াসাত নে ইয়ে জিন্দা জবাঁ কুচ্লি উস্ আহ্দে সিয়াসাত্ কো মরহুমুঁ কা গম কিউঁ হ্যায় গালিব জিসে কাহ্তে হ্যাঁয়, উর্দু হি কা শায়ের থা উর্দু পে সিতম ঢা কার, গালিব পে কারাম কিউঁ হ্যায়। ’ [যে সব শহর মুখরিত ছিল গালিবের কণ্ঠের রণনে সেসব শহরেই উর্দু আজ অস্বীকৃত, নিশ্চিহ্ন পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা যেদিন হল, সেদিনই উর্দু চিহ্নিত হল অভিশপ্ত ভাষা বলে, গাদ্দার ভাষা বলে যে-রাজনীতি এই জীবন্ত ভাষাটিকে পয়মাল করল সে-রাজনীতিরই আবার মৃতদের জন্য চিন্তা করা কেন। গালিব যাঁর নাম, তিনি কবি ছিলেন উর্দুরই উর্দুর উপর জুলুম করে গালিবের উপর দয়া কেন।

’] পঞ্চাশের দশকের হিন্দী ফিল্মের প্রাণ ছিল উর্দু গান। সে গানের সবচেয়ে কার্যকর অংশটি ছিল প্রগতিবাদী উর্দু কবিদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সুযোগটা জুগিয়েছিল কিছু প্রগতিবাদী হিন্দীফিল্ম-ডিরেক্টার আর হিন্দী সিনেমার অপরিহার্য প্রতিবাদী টাইপ-চরিত্রটি। উদাহরণ : ‘নয়া দাওর’ (‘নবযুগ’ ১৯৫৭), ‘ফির সুবাহ্ হোগি’ (‘আবারও ভোর হবে’ ১৯৫৮), ‘পেয়াসা’ (‘তৃষ্ণার্ত’ ১৯৫৭)। কিন্তু অত জনপ্রিয় প্রগতিবাদ সংস্কৃতি-নিয়ন্ত্রক স্বাধীন ভারত সরকারের সয়নি।

বি. ভি. কেসকার ১৯৫২ সালে তথ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ফিল্ম মিউজিক সম্প্রচার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেন। বাহ্যত হিন্দীগানের লঘুত্বকে দূষলেও মূল কারণটি ছিলÑ ওই মিউজিক উর্দুপ্রধান। ফলে উর্দু প্রোগ্রাম শোনার জন্য শ্রোতাসাধারণও ‘রেডিয়ো পাকিস্তান’ এবং ‘রেডিও সিলনে’র প্রতি ঝুঁকে পড়ে। উর্দু কবিতা হিন্দীফিল্মের সঙ্গে আরেকভাবেও বিজড়িত হয়ে আছে। বিখ্যাত উর্দু কবিতার টুকরো ও শব্দবন্ধ হিন্দীসিনেমার গানের অঙ্গীভূত হয়ে আছে হেথা, হোথা এবং সর্বথা।

কিছু দৃষ্টান্ত। ‘এক দুজে কে লিয়ে’ (‘একে অপরের জন্যে’, ১৯৮১) সিনেমাটির শীর্ষ সংগীতে পেশাদার গীতিকবি আনন্দ বখ্শী গালিবের অমর একটি ফ্রেজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ‘“ইশক পর জোর নেহি”, গালিব নে কাহা হ্যয় ইসি লিয়ে’। ‘লাভ ইন সিমলা (১৯৬০) সিনেমায় গীতিকার রাজিন্দার কিষাণ ‘আয় মেরি শাহে খুবাঁ’-গানে বিরল উদ্ভাবনীশক্তির পরিচয় দিয়ে ব্যবহার করেছেন মোমিন খান মোমিনের অমর শের ‘তুম মেরে পাস হোতি হো গোয়া, জব কোয়ি দোসরা নেহি হোতা’ (মনে হয় তুমি আমার পাশে রয়েছ, যখন দ্বিতীয় কেউ কাছে থাকে না’)। ‘মৌসম’ ফিল্মে (১৯৭৫) গীতিকার গুলজারের একটি গানের মুখড়ারূপে ব্যবহৃত হয়েছে মির্জা গালিবের বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘জী ঢোঁঢ়তা হ্যায় ফির ওহি ফুরসত কে রাত-দিন’ (মন খুঁজে বেড়ায় সেইসব অবসরের দিনরাত পুনরায়’)। এভাবে উর্দুভাষা হিন্দীসিনেমার আশ্রয়ে প্রাণবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে এবং মাধ্যমটিকে নিজের শব্দসম্পদ ও কাব্যিক ঐতিহ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করে চলে।

এর ফলে বাঞ্চাল হতে থাকে উর্দুকে ভারতের জাতীয় চেতনা থেকে নির্মূল করার ভাষাগত মৌলবাদীদের অপচেষ্টা। হিন্দীফিল্মীগানের প্রয়োজনে লালিত এই উর্দুপ্রীতিকে প্রতীকরূপে যথাযথভাবেই উপস্থাপন করেন নিবেদিতচিত্ত গালিবভক্ত গুলজার তাঁর একটি চমকপ্রদ চরণে। দ্বিপদীটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘দিল সে’ (১৯৯৮) ফিল্মের সুপারহিট গান ‘ছাইয়াঁ ছাইয়া’-তে। অতীব সুন্দর সে-উচ্চারণ : ‘উয়ো য়ার হ্যায় জো খুশবু কি তারাহ্ / জিসকি জবান্ উর্দু কি তারাহ’ [ওই বন্ধু যেন একটি সুরভি / যার ভাষা উর্দুর মতো (মিষ্টি)] এভাবে স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলাচলেই ভারতে বেঁচে রয়েছে উর্দু। ভাষাটির মূলধারা বয়ে চলেছে এখন পাকিস্তানে, যেখানে উর্দু দেশভাগ থেকেই অভিবাসী।

তাই এ কালের উর্দু ভাষার প্রগতি ও নারীবাদী কবিদের দেখা মেলে কেবল তার অভিবাসভূমেইÑ যেমন কিশওয়ার নাহিদ, ফাহমিদা রিয়াজ, গুলনার, পারভীন শাকির, আদা জাফরী প্রমুখ। এঁদের কবিকর্মের মূল্যায়নের জন্যে সংশ্লিষ্ট বাস্তবিক ও সামাজিক পটভূমিটি জানা জরুরী। ১৯৮০-র দশকে úাকিস্তানের রাজনীতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপার্শ্ব রচনা করেছে জেনারেল জিয়াউল হকের অত্যুৎসাহী ইসলামীকরণ কর্মসূচি এবং তারই অনুষঙ্গস্বরূপ নারী-অধিকারের ওপর অমানবিক আক্রমণ। অবশ্য জেনারেল হকের নারীবিদ্বেষী নীতিমালা ছিল মূলত কায়েমীস্বার্থের প্রতিভূ মধ্যশ্রেণীর পুরুষদের ক্লাস ও জেন্ডার সম্পর্কিত উদ্বেগেরই প্রতিফলন। পাবলিক লাইফে নারীর ক্রমবর্ধিষ্ণু উপস্থিতি একদিকে করছিল ওই পুরুষকুলটির ক্রোধের উদ্রেক এবং আরেকদিকে করছিল সমাজের ব্যক্তিক ও পারিবারিক জীবনে ‘অপ্রীতিকর’ প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কার সৃষ্টি।

কায়েমীস্বার্থের প্রতিনিধি ওই পুরুষসমাজটির সেই আতঙ্ক বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল সরকার প্রবর্তিত নির্লজ্জ পুরুষ-প্রাধান্যবাদী পলিসিগুলির বিরুদ্ধে পুুরুষ-কবিদের মৌনপালনে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন প্রগতিবাদী কবি হাবিব জালিব। তিনি ছিলেন জিয়াউল হক সরকারের কুখ্যাত ‘ল অফ এভিডেন্স’-এর বিরুদ্ধে সংগঠিত নারী-আন্দোলনের ১৯৮৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির জনসমাবেশে অংশগ্রহণকারী একমাত্র পুরুষকবি। যত লজ্জাজনকই হোক, সত্য তো এই যে নারীজাতির চূড়ান্ত অবমাননাকারী কুখ্যাত সেই আইনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দায়িত্বটা পালন করেছিলেন কেবল নারীকবিগণই। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে মধ্যযুগীয় এ-এভিডেন্স অ্যাক্ট ধর্ষিতার বিচারের অলভ্যতাকে প্রকৃতপক্ষে বিধিসিদ্ধই করে দেয়।

ফেমিনিস্টদের কবিতা শুধু উইমেন-ইশুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁদের কবিতা ছিল পাকিস্তানী সমাজের উপর আরোপিত প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাবৎ পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ঘৃণার তীক্ষè-তীব্র তীরস্বরূপ। তবু যেহেতু পশ্চাতমুখী ইসলামাইজেশন-জনিত পলিসিগুলির মূল আঘাতটা নারী-শ্রেণীটির ওপরই হানা হচ্ছিল, সেহেতু তাঁদের কবিতা সম্বোধন করছিল প্রধানত নারীঘটিত ইশুগুলিকেই, যেমন ‘জেনা অর্ডিন্যান্স’Ñ যে-আইন ধর্ষিতাদের ওপরও জেনা বা ব্যভিচারের চার্জ কিংবা অগম্যগমনের অভিযোগ আরোপ করছিল। উর্দুকাব্যে নারীর লেখা প্রগতি ও নারীবাদী কবিতার চর্চাক্ষেত্রের একপ্রান্তে আছে পারভীন শাকির ও আদা জাফরির বিনীত উচ্চারণ। আরেক প্রান্তে আছে কিশোয়ার নাহিদ এবং ফাহমিদা রিয়াজের সাহসী কণ্ঠস্বর।

প্রথম প্রান্তে খোলাখুলি রাজনীতি বিষয়ক কবিতা ছিল না, বরং গজলের মতো সনাতন শৈলীর চর্চাও ছিল। তবু নারীর গজল লেখাটাই একটা বিনাশী তৎপরতা হিসাবে পরিগণিত হচ্ছিল পাকিস্তানের আবহমান কালের সামাজিক কালচারে। কারণ এর মধ্যেও রক্ষণশীল সামাজিকগণ নারীজাতির ভূমিকাবদলের আদল দেখতে পেতÑ পুরুষের আকাক্সক্ষার ‘বিষয়’ হয়ে থাকার বদলে নারীর নিজের আকাক্সক্ষার ‘বিষয়ী’ হয়ে ওঠা। কায়েমী স্বার্থবাদী পুরুষমহলটির দিক থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হত ফেমিনিস্ট কিংবা নারীবাদী কবিদেরÑ তাঁদের ‘পুরুষালী ভাব’ এবং ‘শিথিল নৈতিকতা’র জন্য। ব্যক্তির কাছ থেকে তো বটেই, রাষ্ট্রের তরফ থেকেও হিংসাত্মক হুমকির মুখেও পড়তে হত তাঁদের।

ফাহমিদা রিয়াজ এবং কিশওয়ার নাহিদ বৈরী রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বারংবার। ফাহমিদা-সম্পাদিত ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে জিয়াউল হক সরকার ১৪টি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিল। একটিতে এই তেজস্বিনী কবির মৃত্যুদ-ও হয়েছিল। এজন্যে ফাহমিদাকে সপরিবারে ভারতে চলে যেতে হয়েছিল। একজন সিভিল সারভেন্ট হিসাবে নারীবাদী কবি কিশওয়ার নাহিদকে তাঁর চাকরিজীবনে বরাবরই হয়রানি ও হুমকির শিকার হতে হয়েছে।

একের পর এক মামলাও ঠোকা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কারণ, তেজী নারীবাদী এসব কবিদের মারাত্মক বিপজ্জনক মনে হয়েছিল কায়েমী স্বার্থের প্রতিনিধি-রাষ্ট্রের কাছে। যেহেতু জিয়াউল হকের ‘মার্শাল ল সরকার’-বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে উল্লেখযোগ্য কোনো পুরুষগোষ্ঠী ছিল না, ছিল নারীসম্প্রদায়েরই এইসব অ্যাক্টিভিস্টÑ সেহেতু কালের সবচেয়ে বেশি রাজনীতি-সচেতন এবং সোচ্চার কবিকুল বলতেও ছিলেন এঁরাই। এঁদের কবিতা থেকেই একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। কবি কিশোয়ার নাহিদের বহুল পঠিত কবিতা ‘হাম গুনাহ্গার আওরতেঁ’ (‘আমরা পাপাচারী নারী’) : ‘ইয়ে হাম গুনাহ্গার আওরতেঁ হ্যাঁয় জো আহ্লে জোব্বা কি তামকিনাত সে না রো’ব খায়েঁ না জান বেচেঁ না সার ঝুকায়েঁ না হাথ্ জোড়েঁ ইয়ে হাম গুনাহ্গার আওরতেঁ হ্যাঁয় কে জিন্কে জিস্মুঁ কি ফাস্ল বেচেঁ জো লোগ্ উও সারফারাজ ঠ্যহ্্রেঁ নায়াবাত-এ ইমতিয়াজ ঠ্যহরেঁ উও দাওয়ার-এ আহ্ল-এ সাজ ঠ্যহ্রেঁ ইয়ে হাম গুনাহ্গার আওরতেঁ হ্যাঁয় কে সাচ্ কা পরচম উঠা কে নিকলেঁ তো ঝুট্ সে শাহ-রাহেঁ আটি মিলে হ্যাঁয় হার এক্ দহ্লিজ পে সাজাউঁ কি দাস্তানেঁ রাখ্খি মিলে হ্যাঁয় জো বোল্ সাক্তি থিঁ উও জোবানেঁ কাটি মিলে হ্যাঁয়’ [এই আমরা যারা গুনাগার নারী তারা জুব্বাধারীর শক্তির কাছে না পায় ভয় না বেচে আত্মা না ঝুঁকায় মাথা না করে করজোড় আমরা-যে পাপিয়সী রমণী আমাদের শরীরের ফসল বেচে যারা তারাই ঠেকে মহিমান্বিত শ্রেষ্ঠত্বের যোগ্য ঠেকে তারাই গণ্য হয় ইহজগতের প্রভু বলে।

] আমরা এই পাতকিনীরা সত্যের পতাকা তুলে বেরুলেই দেখি জনপথ আকীর্ণ হয়ে আছে মিথ্যায় প্রতিটি চৌকাঠেই রক্ষিত দেখি দ-ের কেচ্ছা যে-জিভগুলি বলতে পারত, সবই মেলে কর্তিত। ] এধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ কবিতা একদিকে স্থিতাবস্থার খরিদা-গোলামদের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়, আরেকদিকে নারীর দুর্বল অপ্রতিরোধী ভাবমূর্তিটিকে বদলিয়ে দেয়। সমগ্র কবিতা জুড়ে ‘আমরা পাপাচারী নারী’ শব্দবন্ধটির গানের ধুয়ার মতো ফিরে ফিরে আসা যেন ধর্মীয় গোঁড়ামি আর তার সমর্থক রাষ্ট্রের গালে ফিরে ফিরে চড় মারা। যে-‘জেনা অর্ডিনেন্স’ ধর্ষণসহ (!) সকল যৌন অপরাধের দায়ভার ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীর ওপর চাপায়, সেটির রেফারেন্স আসামী হিসেবে অবিকল্পরূপে শনাক্ত করে রাষ্ট্র ও ধর্মকে। ফাহমিদা রিয়াজের কবিতা ‘চাদর আওর চারদিওয়ারি’ তার শিরোনামটি ধার করেছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের ‘ইসলামিক আইডিওলজি কাউন্সিলে’র একটি অভিযানের নাম থেকে।

অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কাজে নারীর ভূমিকা পরিবারের গ-ির ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখা। কবিতাটির পুরোটাই উদ্ধারযোগ্য : ‘হুজুর, ম্যয় ইস্ সিয়াহ্ চাদর কা কেয়া কারুঙ্গী? ইয়ে আপ মুঝকো কিউঁ বখশ্তে হ্যাঁয়, বসদ্ ইনায়েত! না সোগ্ মে হুঁ কে ইস্কো উড়্হোঁ গম্ ও আলম্ খাল্ক কো দিখাউঁ না রোগ হুঁ ম্যয় কে ইস্ কি তারিকিউঁ মে খাফ্ত সে ডুব যাউঁ না ম্যয় গুনাহ্গার হুঁ না মুজরিম্ কে ইস সিয়াহি কি মোহর আপনি জবীন্ পে র্হা হাল্ মে লাগাউঁ আগার না গোস্তাখ্ মুঝ্ কো সমঝেঁ আগার ম্যয় জাঁ কি আমান পাউঁ তো দা¯্Í-বস্তা কারুঁ গুজারিশ কে বান্দা-র্পওয়ার! হুজুর কে হুজরা-এ মুআত্তার মে এক্ লাশ পড়া হুয়া হ্যায় না জানে কব্ কা গলা সড়া হ্যায় ইয়ে আপ্সে রহম্ চাহ্তা হ্যায় হুজুর ইত্না করম তো কীজে সিয়াহ্ চাদর মুঝে না দীজে সিয়াহ্ চাদর সে আপনে হুজ্রে কি বে-কাফন লাশ ঢাঁপ্ দীজে কে ইস্ সে ফুটি হ্যায় জো উফুনাত্ উও কুচে কুচে মে হাঁপ্তি হ্যায় উও র্সা পাটাখ্তি হ্যায় চৌখাটুঁ পর বুরহান্গি আপনি ঢাঁক্তি হ্যয় সুনেঁ জারা দিল্খারাশ্ চীখেঁ বানা রাহি হ্যাঁয় আজব হাইউলে জো চাদরুঁ মে ভি হ্যাঁয় বারাহ্না ইয়ে কওন্ হ্যাঁয়? জান্তে তো হোঙ্গে হুজুর পহ্চানতে তো হোঙ্গে! ইয়ে লওন্ডিয়াঁ হ্যাঁয়! কে ইয়ারগামালি হালাল শব্ র্ভ রাহেঁÑ দম্-এ সুব্হা দর-বদর হ্যাঁয় ইয়ে বাঁদিয়াঁ হ্যাঁয়! হুজুর কে নুত্ফা-এ মুবারক কে নিস্ফে ভিরাস্া সে মু’তাবর হ্যাঁয় ইয়ে বিবিয়াঁ হ্যাঁয়! কে যাওজেগি কা খিরাজ্ দেনে কাতার আন্দর কাতারবারি কি মুন্তাজার হ্যাঁয় ইয়ে বাচ্চিয়াঁ হ্যাঁয়! কে জিন্ কে র্স পে ফিরা জো হজরত কা দাস্ত্-এ শাফ্কাত্ তো কম-সেনি কে লহু সে রেশ্-এ সফেদ রঙ্গীন হো গ্যয়ি হ্যায় হুজুর কি হুজরা-এ মু’আত্তার মেঁ জিন্দেগি খুন রো গ্যয়ি হ্যয় পড়া হুয়া হ্যয় জাহাঁ ইয়ে লাশা তাভিল্ সাদিয়ুঁ সে কাত্ল-এ ইন্সানিয়াত্ কা ইয়ে খুঁ চুকাঁ তামাশা আব্ ইস্ তামাশে কো খাত্ম কীজে হুজুর আব ইসকো ঢাঁপ্ দীজে! সিয়াহ চাদর তো বন্ চুকি হ্যায় মেরি নেহি আপ কি জরুরত কে ইস জমিঁ পে ওজুদ্ মেরা নেহি ফাকাত্ এক্ নিশান্-এ শাহ্ওয়াত হায়াত কি শাহ-রাহ্ পর জাগ্মাগা রাহি হ্যায় মেরি জাহানাত জমিঁ কে রুখ্ পর জো হ্যায় পসিনা তো ঝিল্মিলাতি হ্যায় মেরি মেহনত ইয়ে চারদিওয়ারিয়াঁ, ইয়ে চাদর, গলি-সড়ি লাশ কো মুবারক খুলি ফিজাউঁ মে বাদবাঁ খোল্ র্কা বড়্হেগা মেরা সফিনা ম্যয় আদম্-এ নও কি হামসফর হুঁ কে জিস্ নে জীতি মেরি ভরোসা-ভরি রিফাকাত!’ [হুজুর এই কালো চাদর দিয়ে আমি কী করব? এত মেহেরবানি করে এ উপহার আপনি কেন যে দেন আমাকে! আমি শোকগ্রস্ত নই যে এ চাদর গায়ে চাপাব আমার দুঃখ কষ্ট মানুষকে দেখাব লজ্জায় এ-চাদরের অন্ধকারে নিমজ্জিত হব তেমন কোনো রোগও নই আমি না গুনাগার আমি, না অপরাধী যে এ কালোর সিলমোহর আমি কপালে মেরে রাখব সারাক্ষণ যদি আমাকে বেয়াদব মনে না করেন যদি আমি প্রাণের অভয় পাই তবে করজোড়ে নিবেদন করি যে বান্দাপালক! হুজুরের সুরভিত প্রকোষ্ঠে একটা লাশ পড়ে আছে কে জানে কবেকার গলিত এ আপনার কৃপা চায় হুজুর এটুকু কৃপা তো করুন কালো চাদরটি আমাকে না দিয়ে এটি দিয়ে নিজের হুজ্রার কাফনহীন লাশটি ঢেকে দিন কারণ এর থেকে ছড়িয়ে পড়া দুর্গন্ধ অলিগলিতে হাঁপাচ্ছে মাথা খুঁড়ছে দুয়ারগুলির চৌকাঠে নিজের নগ্নতা ঢাকছে একটু শুনুন হৃদয়বিদারী চিৎকার আজব সব ছায়ামূর্তি বানাচ্ছে যারা চাদরের ভেতরেও নগ্ন এরা কারা? জানেন তো বটে হুজুর চেনেনও বটে! দেহপশারিণী এরা এইসব জিম্মি রাতভর বৈধ থাকে ঘরে ভোর হতেই ঘরছাড়া হয়ে দোরে দোরে ঘোরে এরা বাঁদিরা! হুজুরের পবিত্র বীর্যের উত্তরাধিকারের অর্ধাংশের চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য এঁরা হন স্ত্রীগণ! দাম্পত্যভূমির কর দিতে দীর্ঘ সারি বেঁধে অপেক্ষায় থাকেন এরা বালিকারা! যাদের মাথায় আপনি আদরের হাত বুলিয়েছেন তো তাদের কুমারী শোণিতে আপনার শুভ্র শ্মশ্রু রঙিন হয়ে গিয়েছে হুজুরের সুরভিত হুজ্রাতে জীবন রক্তের অশ্রু বইয়ে দিয়েছে পড়ে আছে যেখানে এই লাশ, শত শত বর্ষ ধরে মনুষ্যত্ব হত্যার দীর্ঘ এই রক্তঝরা তামাশাÑ এখন এই তামাশাটা শেষ করুন হুজুর এখন এটাকে ঢেকে দিন! কালো চাদর তো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আপনার, আমার নয় এ-জগতে আমার অস্তিত্ব কেবল যৌন কামনার প্রতীকই নয় জীবনের রাজপথে ঝলমলাচ্ছে আমার মেধাপ্রতিভা ভূমির মুখে ঝকমকায় যে-স্বেদবিন্দু, সে আমারি মেহনতের এই চারদেয়াল, এই চাদর, পচাগলা লাশ মোবারকবাদ মুক্ত বাতাসে পাল তুলে ছুটে চলবে তরী আমার নতুন আদমের সহযাত্রিণী আমি যিনি জিতে নিয়েছেন আমার নির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব!] তেজোগর্ভ এই ‘চাদর আওর চারদিওয়ারী’ শীর্ষক কবিতায় কবি ফাহমিদা রিয়াজ নাকচ করে দিয়েছেনÑ যুগপৎ নারীর গায়ে চাপানো স্বঘোষিত জনবিবেকরক্ষকদের চাদর বা মাথাবুকঢাকা ওড়না এবং নারীকে যৌন উপাদানজ্ঞানে ঘরের চারদেয়ালের ভেতর আবদ্ধ রাখার আমানবিক সামাজিক ব্যবস্থা। তীব্র বিদ্রুপভরা কবিতাটিতে আছে সমাজের অভিভাবক পুরুষশ্রেণীর অপরাধের বিস্তারিত তালিকা, বিশেষত পতœী ও উপপতœী নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারী নিপীড়নজনিত পাপের বিবরণ। অন্তে কবি তাঁর স্বঘোষিত সমাজপতিকে বলেন যে কালো চাদরে তাঁর কোনো দরকার নেই, ওটার প্রয়োজন আছে হুজুরের; তাঁর ভ-ামি আর লজ্জা ঢাকার জন্য। ফাহমিদা সরাসরি ইসলামের উল্লেখ করেন না।

তবু বোঝা যায় যে কাব্যে উল্লিখিত না-হলেও ইসলামই তাঁর উদ্দিষ্ট ও সম্বোধিত প্রতিষ্ঠান, যার চাদরের কাভারে নারীকে পদানত করে রাখা হয়েছে শত শত বর্ষ ধরে। এতগুলি বছরের বলি দেওয়া নারী দেহের কঙ্কাল পচনের গন্ধসহ ইসলামী ফতোয়াবাজ ‘হুজুরে’র পবিত্র হুজ্রাতে জমে আছে বলে কবি সেদিকে হুজুরের এবং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কবিতার শেষ স্তবকটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উর্দুকাব্যে অঙ্কিত নারীর চিরাচরিত ভাবমূর্তির ও ইসলামী আদর্শসম্মত নারীত্বের বিপরীতে ফাহমিদা তাঁর কল্পনার আদর্শ নারীটিকে বর্ণনা করেন যৌনক্ষুধা মেটানোর সামগ্রী কিংবা কেবলি যৌনকর্মী হিসেবে নয়। তাঁর আদর্শ নারী বুদ্ধিমতী, অবধারণক্ষম সত্তাবতী একজন সাধারণ কর্মী, শুধু পুরুষের ভোগের ‘বিষয়’টি নয়, জগতের সকল কর্মের ‘বিষয়ী’।

নর-নারীর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও পুনর্নিধারণ করেছেন এ-কবি, সাম্যের ভিত্তিতে জীবনের সমান অংশীদার হিসেবে। এজন্যে তাঁকে পুরুষের সংজ্ঞাটাও পুনরায় নিরূপণ করতে হয়েছে একজন নতুন আদমরূপে, যিনি নারীর আস্থা অর্জন করে তাঁর যোগ্য হতে সক্ষম। নর-নারীর সম্পর্কের বিষয়ে পিতৃতান্ত্।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।