আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ টেলিভিশনে সাংবাদিকতা!

আমি পড়ি, লিখি, মুভি দেখি, ঘুরে বেড়াই আর আড্ডা দেই......:)

বাংলাদেশ টেলিভিশনে সাংবাদিকতা! মোরশেদ আলম সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন বাংলা শিরোনামের শেষে বিস্ময়বোধক চিহ্ণ ব্যবহার করার কারণ খুব স্পষ্ট। সাংবাদিকতা বলতে সাধারণভাবে যা বোঝায়, তার ধারে কাছেও নেই বাংলাদেশ টেলিভিশন। অবশ্য এখানে কোনো মেধাবী লোক চাকরি করেন না, এর মানে কিন্তু তাও নয়। সে যাক, ব্যাপক অর্থে ব্যবহার না করে সাংবাদিকতা বলতে আমি এখানে শুধু রিপোর্টিংকেই বুঝিয়েছি। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে একাধিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে আমি যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে গেস্ট প্রোডিউসার হিসেবে কাজ শুরু করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তখন থার্ড ইয়ার শেষ করে আমি ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস শুরুর অপেক্ষা করছি।

গেস্ট প্রোডিউসার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেও রিপোর্টিং করতে করতে আমি হয়ে যাই রিপোর্টার। বিটিভিতে ক্যামেরা সেকশন থেকে নিউজরুম আর ট্রান্সপোর্ট থেকে আর্কাইভ সব জায়গায়ই কাজ করতে গিয়ে একজন রিপোর্টারকে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সবাই ধরেই নেন, রিপোর্টারকে কেউ কোনো সহায়তা করতে বাধ্য না। বিটিভির পিয়ন, দারোয়ান থেকে শুরু করে অনেকেরই অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড থাকতো, কিন্তু একজন রিপোর্টারের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড তৈরি করার ক্ষেত্রে কারো কোনো তাড়া ছিলো না। রিপোর্টার নির্ধারিত প্রোগ্রামের আগে সচিবালয়ের গেটে ক্যামেরাম্যানের জন্য অপেক্ষা করতেন, তিনি আসলেই কেবল তার গাড়িতে করে রিপোর্টার সচিবালয়ের ভেতরে যেতে পারতাম।

নিজেদের কাজের তাগিদে একজন রিপোর্টারকেই অবশেষে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড তৈরির ব্যপারে উদ্যোগি হতে হতো। এতো গেল কার্ড তৈরির বিষয়। সবার আগে নিউজ প্রচার করার কোনো তাড়াও আমি কখনো বিটিভির কারো মধ্যে দেখিনি। বরং নিউজ কভার করে তাড়াহুড়ো করে অফিসে আসলেও আমার নিউজটি কীভাবে সম্প্রচার হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না, তা নিশ্চিত হতে আমাকে অপেক্ষা করতে হতো অন্তত সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার দিকে রাত আটটার শিফটে কাজ করা কর্মকর্তারা আসবেন, তারা আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা গল্প করবেন, বাদাম চিবুবেন, কিংবা মোগলাই খাবেন, তারপর রানডাউন (বিটিভিতে একে বলা হয় লাইন আপ) তৈরি হলে তবেই জানতে পারবো আমার নিউজটি কোন ফরম্যাটে প্রচারিত হবে কিংবা আদৌ হবে কি না।

মজার ব্যপার হচ্ছে, স্পট ঘুরে আসা রিপোর্টারের সাথে কোনো আলাপ না করেই এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হলো। এবার নিউজটি প্যাকেজ বা রিপোর্ট আকারে করতে হলেতো হয়েছে। প্রথমে স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে। কম্পিউটারে নয়, হাতে! সেই স্ক্রিপ্টটি সিনিয়র কেউ দেখার পর এবার ভয়েস দেয়ার জন্য একটি ক্যাসেট নিয়ে যেতে প্রোগ্রামের ভয়েস রেকর্ডিং রুমে। সেখানে গিয়ে বেশির ভাগই সময়ই দেখা যেতো কোনো অনুষ্ঠানের এডিটিং চলছে।

তাদেরকে অনুরোধ করে ভয়েস রেকর্ড করে নিউজে এসে এবার প্যানেলের জন্য প্রোডিউসারকে খোজাখুজি (নিউজ বিভাগের একটা প্যানেলে ভয়েস রেকর্ডিং-য়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিউজের জন্যই নির্ধারিত ছিলো, বেশিরভাগ সময় তা ফ্রি থাকলেও অন্য কেউ তা ব্যবহার করতে পারতো না)। তারপর দৌড়াদৌড়ি করে কোনোমতে নিউজ ধরানো। বিটিভির এডিটিং প্যানেল লিনিয়ার হওয়ায় রিপোর্টে যাদের ইন্টারভিউ ব্যবহার করা হলো, তাদের পরিচিতমূলক বিবরণ (অ্যাস্টোন) প্যানেলেই জুড়ে দেয়ার সুযোগ বিটিভিতে নেই। তাই এই ব্যস্ততার ফাকেই একবার নিউজ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে একটা কাগজে এসব লিখে দিয়ে আসতে হয়। রিপোর্ট তৈরি হয়ে গেলে তা প্রচারের সময় কন্ট্রোল রুমের প্রোডিউসারের পেছনে ঐ বুলেটিনে যেসব রিপোর্টারের রিপোর্ট(প্যাকেজ) আছে, তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

রিপোর্ট প্রচারের সময় ইন্টারভিউ আসলেই রিপোর্টার নিশ্চিত করলে অ্যাস্টোন (যার ইন্টারভিউ প্রচারিত হয়, তার নাম ও পরিচিতি) পিসিআর থেকে চালানো হয়। আর রিপোর্টার না থাকলে তিনি যতই বিখ্যাত হোন না কেন, অ্যাস্টোন চালানো হয় না। অথচ এই যাদের কাজ, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তারা সপ্তাহে দুই দিন ছুটি নিলেও রিপোর্টাররা ছুটি পান একদিন। অথচ বিটিভির নিউজ বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনো শিফটেই পাঁচ/ছয় ঘণ্টার বেশি অফিস করতে দেখিনি। বিটিভিতে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে মজার যে ব্যপারটি আমার চোখে পড়েছে, তা হলো, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে মন্ত্রী এবং সংসদের গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ এবং তা প্রচারের কাজে যারা ব্যস্ত থাকে, বিটিভির সেসব রিপোর্টারের স্থায়ী নিয়োগের কোনো ব্যবস্থা নেই।

তারা সেখানে কাজ করেন চুক্তিভিত্তিক গেস্ট প্রোডিউসার হিসেবে! কাজ করতে করতে কেউ হয়ে যান রিপোর্টার, কেউ ডেস্কে আর কেউ প্যানেলে। আর তাদের বেতন হয় শিল্পী সম্মানী কোটায়! এবং স্থায়ী নিয়োগ না পাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনার খবর প্রচারে কোনো ধরনের গাফিলতি থাকলে তাদেরকে তেমন কোনো শর্তের বেড়াজালে আটকানোও সম্ভব হয় না। অর্থাৎ বলাই যায়, রাষ্ট্রীয় গুরত্বপূর্ণ নিউজ কভার করা এসব রিপোর্টারের সম্মানী, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যপারে গত কয়েক বছরে কোনো পদক্ষেপতো নেয়া হয়ইনি, বরং তাদেরকে কীভাবে নাজেহাল করা যায়, সে কাজে ব্যস্ত থাকেন বিটিভির অনেকেই। নিউজ কভারেজের পরিকল্পনাতো আরেক নাটক। নিউজ কভার করার ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের অফিস থেকে পাঠানো আমন্ত্রণ পত্র ধরেই শুধু এখানে পরদিনের পরিকল্পনা বা কভারেজ প্ল্যান তৈরি হয়।

সাধারণ মানুষের সমস্যা, ভোগান্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে পরদিনের কভারেজ তৈরির যে রেওয়াজ টেলিভিশন সাংবাদিকতায় আছে, তার ছিঁটেফোটাও নেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে। শুধু তাই নয়, পরদিনের যেসব কভারেজ, তা ঠিক হতে বেজে যায় রাত সাড়ে দশটা বা তারো বেশি। অন্যান্য টেলিভিশনে রাতে রিপোর্টারকে পরদিনের অ্যাসাইনমেন্ট জানিয়ে দেয়ার যে রেওয়াজ, সেক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ টেলিভিশন। এখানে রিপোর্টারকেই রাতে বা সকালে অফিসে ফোন দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জানতে হয়। অন্যদিকে রিপোর্টারদের খুব ভোরে অফিসে পৌঁছা বা বেশি রাতে অফিস থেকে বাসায় যেতে কোনো ধরনের পরিবহন সুবিধার কথা বোধহয় এখন পর্যন্ত কারো মাথায়ই আসেনি।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করতে গিয়ে বিড়ম্বনাগুলোও খুব মজার। এখানে তিনটি ঘটনা বলছি: ঘটনা: ১ বিটিভি অফিস থেকে সচিবালয়ে যাচ্ছি নিউজ কভার করতে। রাস্তায় জ্যামে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গাড়ি। হঠাৎ পাশের গাড়ি থেকে একজন মাথা বের করে বললেন, ‘ভাই, বিটিভিতে কাজ করতে আপনাদের লজ্জা লাগে না’? ঘটনা: ২ রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টগুলোতে গেলে সেখানকার লোকজনের ভাব দেখে মনে হতো, একদিনেই কয়েকবার চাকরি চলে যাবে। যদিও ওটা কোনো চাকারিই ছিল না।

এরকম একদিন এক অনুষ্ঠানের আয়োজক চারদলের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আমাকে বলছিলেন, আপনাদের এখন যিনি মহাপরিচালক। তাকে তো আমিই নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। সাথে সাথেই আমি বললাম, হ্যাঁ, হানিফ ভাই(তখনকার মহাপরিচালক) এটা আমাকে বলেছেন। আমার তাৎক্ষণিক এ জবাবে অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ওই ভদ্রলোক। ঘটনা: ৩ বিটিভিতে পরিবহন বিভাগকে আমার কাছে সবচেয়ে ক্ষমতাধর মনে হয়েছে।

গাড়ির অভাবে কতো যে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট কভার করা যায় না, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ অনেক বড়ো বড়ো কর্মকর্তার আত্মীয় স্বজনকে সার্ভিস দেয়ার জন্য একাধিক গাড়ি তৈরি থাকে। একদিনের ঘটনা, আশুলিয়া গাজিপুর এলাকায় যখন বেতন বোনাসের দাবিতে প্রথমবারের মতো গার্মেন্টস ভাংচুর শুরু হয়। সেখানে জরুরী ভিত্তিতে যাওয়া লাগবে। কিন্তু বেঁকে বসলো পরিবহন বিভাগ।

ঝূঁকি নিয়ে তারা এই অ্যাসাইনমেন্ট কভার করতে যাবে না। ডিজি, প্রধান বার্তা সম্পাদক কারো রেফারেন্স দিয়েই কোনো কাজ হচ্ছে না। পরে অনেক কষ্টে রাজি করানো হলো। উত্তরায় গিয়ে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। শ্রমিকদের ভাংচুর চলছে।

ক্যামেরা দেখে তারা আরো সহিংস হয়ে উঠলো। গাড়ি থেকে নেমে ওভার ব্রিজে উঠে ছবি নিতে নিতে এক পর্যায়ে নিচে তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়ি হাওয়া। আমাদেরকে এই অবস্থায় রেখেই পালিয়েছে। আমার হাতে বিটিভির লোগো। আর ক্যামেরায়তো লোগো আছেই।

আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম। এনটিভির গাড়িতে চড়ে সে যাত্রায় পার পেয়েছিলাম। কিন্তু ওই ড্রাইভারের কিছুই হয়নি। আর শুদ্ধ উচ্চারণতো বিটিভিতে আরেক অসম্ভব ব্যপার। প্রমিত উচ্চারণের ধারে কাছেও নেই, বরং জঘন্য উচ্চারণ করেন, এমন লোকদেরকে বিটিভি কোত্থেকে কীভাবে সংগ্রহ করে, এটা আমার কাছে বরাবরই বিস্ময়ের ব্যপার।

অথচ মজার ব্যপার হচ্ছে, ভুল উচ্চারণ নিয়ে বিটিভির ভেতরেও কিন্তু আলোচনা হয়। এরপরও ভুল উচ্চারণে নিয়মিতই রিপোর্ট প্রচার হয় সেখানে। এমনকি যারা নিউজ পড়েন, তাদের উচ্চারণের অবস্থাও কতোটা ভয়াবহ, তা নাকি আজকাল বাচ্চা ছেলেমেয়েরাই ধরতে পারে। এ কথা অনেক দর্শকই আমাকে বলেছেন। বিটিভির অনেক কর্মকর্তাই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান মন্ত্রী-এমপিদের বাসায় বা তাদের অফিসে।

এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, মন্ত্রী ইন্টারভিউ আনতে তার বাসায় গিয়ে দেখি বিটিভির সিনিয়র কর্মকর্তা মন্ত্রীর বাসায় দর্শনার্থীর মতো বসে আছেন, যা আমাকে বেশ অবাক করে। তবে এত কিছুর পরও বিটিভির আর্কাইভ এবং তা সংগ্রহের ধরন যে কোনো অর্থে প্রশংসার দাবিদার। সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে তা খুব কার্যকর করা যেতে পারে, যা বেশিরভাগ সময়ই করা হয় না। এছাড়া বেসরকারি টিভিগুলোতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদেরকে যে কোনো অর্থে বিটিভির ক্যামেরাম্যান এবং ভিডিও এডিটরদের চেয়ে বেশি দক্ষ মনে করা হয়। কিন্তু বেসরকারি টিভিতে কাজ করে আমার মনে হয়েছে, বিটিভির অনেক ক্যামেরাম্যান এবং ভিডিও এডিটরই আরো বেশি দক্ষতা এবং দ্রুততার সাথে কাজ করতে পারে।

সংক্ষেপে এই হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিটিভি। সাধারণ মানুষের টাকায় যাদের বেতন হয়, দেশের আর দেশের মানুষের কল্যাণে বিটিভির সেসব কর্মকর্তাদের অবদান(?) আমাদের সবারই কম বেশি জানা। অথচ এই বাংলাদেশ টেলিভিশন যে পরিমাণ জায়গা দখল করে আছে, তাতে অন্তত আধুনিক মানের দশটি টেলিভিশন অফিস হতে পারে। শুধু তাই নয়, বিটিভি অফিসের পেছনে নষ্ট গাড়ি রাখা হয় যে জায়গায়, সেখানেও অন্তত কয়েকটি টেলিভিশন অফিস করা সম্ভব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.