আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতা: অভয়ারণ্যে অশ্লীল কনসার্ট

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আমাদের এই ছোট্ট শহর, ছিলো শুধু এক অভয়ারণ্য। এখানে বিকেলের মজা রোদ্দুরের 'পর, হালকা বৃষ্টির রিমঝিম সুর -- যেনো বিশুদ্ধ অর্কেস্ট্রায় দামাল ছেলেমেয়েদের দল দলবেঁধে নেমে যেতো পথে, মাঠে; হৈ হৈ রৈ রৈ, হৈ হৈ রৈ রৈ, বরকণে এলো ঐ। ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, পিস্তল পিস্তল খেলা, আরো কত কি! নিরাপদ এই অভয়ারণ্য -- এখানে মেয়েরা বের হয়ে আসতো অকপটে; বান্ধবীদের খোশগল্প, হাসি, ঠাট্টা মস্করা -- বাতাসের সেতারে তুলতো ঝংকার। অথবা জানালার গ্রীল ভেদ করে বয়ে চলা মৃদু বাতাস আর, আলোর মিছিলের ফাঁকে, অবাক নয়নে থাকতো তাকিয়ে নিষ্পাপ কিশোরী। অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নে ভরা সেই -- ঝকঝকে টলটলে কিশোরীনয়ন।

এখানে বয়স্ক লোকদের দল, হাটবাজারের চায়ের দোকান করে তুলে উন্মাতাল। কত আলোচনা! কত বিশ্লেষণ! হুমকি, ধামকি, হাহাকার!! মাতাল, মাতোয়ারা যেন আকাশ, জমিন, পাতাল। মায়েরা ব্যস্ত সন্ধ্যার নাশতায়, এদিক ওদিকে বহুবিধ হেঁশেলের ধারে, অগুণতি অজস্র সব অদ্ভুত ঘ্রাণ। সবই ছিলো আমাদের, সবই ছিলো, ছিলো এ এক অভয়ারণ্য। আমরা আমাদের বাবা-মা, ভাই, বোন, চাচা-খালা, ফুপা, খালু, আত্মীয়স্বজন আর, ছেলেদের আর মেয়েদের নিয়ে, ভালোই ছিলাম, বেশ সুখেই ছিলাম সেই অভয়ারণ্যে।

আমাদের অর্থ ছিলোনা, সম্পদ ছিলোনা, অথবা পেশীর জোর ছিলোনা, মানলাম। তবু নিজহাতে আঁকা বৃত্তের মাঝে আমাদের, হয়তো দারিদ্র্যের কুয়াশায় ঘেরা, অথবা নয়। এই শহরের, অভয়ারণ্যের আঁচলে ঢাকা পড়ে, আমরা ভালোই ছিলাম, সুখেই ছিলাম। হঠাৎ একদিন কুয়াশার আঁচল খসে পড়ে, আমাদের ছোট্ট শহরটির সম্ভ্রমহানির আয়োজন শুরু হয়, এক ভোরে অথবা দ্বিপ্রহরে! খবর আসে, আমরা কান পেতে শুনতে পাই, "ওরা আমাদের আক্রমণ করবে" -- ওরা কারা? আমরা জানিনা, আমরা চিনিওনা! আমরা শুধু জানি শব্দটি -- "ওরা"। আর জানা যায়, ইথারের প্রসারণে শোনা যায়, আকাশ থেকে আসবে উড়ে, পড়বে এসে পাতাল ফুঁড়ে, বিশাল বিশাল সব, ধাতব দানবের দল।

দাউ দাউ করে জ্বলবে আগুন, অথচ সে আগুনে রোদ পোহানো যাবেনা। সে আগুনে মৃত্যু হবে, আর, আর সেই একেকটি মৃত্যুর দরে কেনা হবে "ওদের" মানে, একদল মহামনাবের চিরকালীন "নিরাপত্তা"র নিশ্চয়তা। আহা! নিরাপদে চা-কফি-বিস্কুট-আপেল-কমলা-নাশপাতি খাবে, বড় বড় মানুষেরা সব, ঠিকঠাক, নিরাপদ হয়ে যাবে। আমাদের বলা হলো, আমাদের ছেলেদের আর খেলতে হবেনা, কারণ, দুচারটা বা কয়েকডজন হাত-পা উড়ে যেতে হবে; আমাদের মেয়েদের আর তাকিয়ে থাকার দরকার নেই, কারণ, কিছু চোখের কোটর শূণ্য হতে হবে ক্লাস্টার বোমায়; আমাদের মায়েদের আর উনুনে হাঁড়ি না বসালেও চলবে, কারণ, হেঁশেল থেকে মরা বারুদের গন্ধ বের হওয়া চাই। আর আমাদের বাবাদের কি হলে চলবে, সেটা না জানলেও আমাদের চলবে।

"নিরাপত্তা"র অব্যর্থ প্রেসক্রিপশন আকাশে ওড়ে -- আমাদের জীবন থেকে খেলাধুলা, প্রেম, আহার, নিদ্রা,আলোচনা, সমালোচনা, আর ভালোবাসা -- সব চলে যায়, দুর হয়, হেঁশেলের জানালার গ্রীল ধরে। আমরা এখন একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকি, (যদিও তেমন শীত নেই আশপাশে)। আর অপেক্ষায় থাকি, প্রতীক্ষায় মাতি (যদিও শব্দহীন মাতোয়ারা) কখন আসবে উড়ে, আকাশ-পাতাল ফুঁড়ে, সেইসব মহান ধাতব দানবের দল, এসে একটানে, ফুটো করে দেবে শহরের বিনীত আঁচল। প্রতিটি দিনের প্রতিটি সময়, নিরাপদ আমাদের এই অভয়ারণ্যে, আমরা এখন তাই, মৃত্যুর অপেক্ষায় আকাশপানে চেয়ে থাকি, প্রতীক্ষায় কাতর হই, এক অশ্লীল ধাতব কনসার্ট শুরুর জন্য। :::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::: ২০০১ সালের অক্টোবরের ৮ তারিখ -- ইউএনএইচসিআরের এক বন্ধুর ফরোয়ার্ড করা একটি ইমেইল পেলাম।

জানতে পেলাম, কাবুলে ইউএনএইচসিআরের জাপানীজ যে টিমটি ছিলো, তার প্রধান মিস চিবা পদত্যাগ করেছেন। ফরোয়ার্ড করা মেইলটি ছিলো মিস চিবার লেখা মেইল। তার আগেই ছয় তারিখ থেকেই তালিবান নিধনের নামে আফগানিস্তানের আকাশ বাতাসে ছুটে বেড়াচ্ছে অসংখ্যা মৃত্যদূত -- ক্লাস্টার বোমা। মিস চিবার মেইলে জানতে পারলাম কিভাবে আকাশের দিকে চোখ মেলে মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষগুলো, যাদের কেউই জানেনা তাদেরকে কেন মরতে হবে। ইমেইলটি পড়ার আগে আমার ধারনাই ছিলোনা একটা জায়গায় যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন সেখানকার সাধারণ নাগরিকেরা কতটা অসহায় হয়ে পড়ে।

আমার মনে পড়ে যায় মায়ের বলা একাত্তরের কথা, তাঁরা শংকিত থাকতেন এই ভেবে যে যেকোন সময় শুনতে পাবেন "পাঞ্জাবীরা বাজারে এসে পড়েছে!" খবরের কাগজে বা সিনেমায় যখন দেখেছিলাম ফিলিস্তিনের শিশুরা, দারফুরের হাড়সর্ব্স্ব মানুষেরা অথবা রুয়ান্ডার হতভাগাদের দল -- আমার মিস চিবার লেখা সেই ইমেইলের আর্তনাদের একটা লাইন সবসময় মনে পড়ে যায় -- "অজানা কারনে আমাদের কেন মরতে হবে? কেন?" সেইসব মানুষদের সবাইকে উৎসর্গ করে এই কবিতা। ফুটনোট: মিস চিবার ইমেইলের বাংলা অনুবাদের অনুমতি চেয়েছিলাম আমি, বাংলাদেশের সংবাদপত্রে দেবো বলে। ইউ এন এইচ সিআর থেকে নিষেধ করা হয়েছিলো। ঐসব চুদির পুতেরা আবার জোরগলায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে!!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.