ঘাস ফড়িং এর স্বপ্নমালা
১ম বেলার গল্প
মধ্যাহ্নের গল্প
এল ডোরাডো
সিবোলা এবং কুইভিরা যখন ব্যর্থতার কাব্য শুনাচ্ছিল আপনার আমার মত রহস্যপ্রিয় মানুষদেরকে ঠিক তখনই আশার প্রদীপ নিয়ে রহস্যের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটল এল ডোরাডোর। এমনকি নগরীটির ভৌগলিক সীমারেখা খুঁজে পাওয়া গেল বর্তমান ইকুয়েডরে। আপনাদেরকে এক বিলুপ্ত দক্ষিণ আমেরিকান আদিবাসীদের গল্প বলি...... নাম ‘মুইস্কা’। মুইস্কা সম্প্রদায়ের অনেক অদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান ছিল...... না ভয় পাবার কোন কারণ নেই আমি এখন সেইসব নিয়ে প্যাচাল পাড়তে বসবো না। শুধু তাদের একটা রীতির কথা বলব যেটা এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক।
মুইস্কা সম্প্রদায়ে নতুন মোড়ল নির্বাচিত হলে সূর্যদেবের ঊদ্দেশ্যে বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান পালিত হত। নব নির্বাচিত মোড়ল চার জন পার্ষদকে সঙ্গে করে চলে যেতেন পর্বতের চূড়ার সেই লেক গুয়াতাভিটার ঠিক মধ্যিখানে...... তার সারা শরীর আবৃত থাকত স্বর্ণ ধূলি (গুড়া অর্থে) দ্বারা (!!!!!)। শুধু তাই না...... মোড়লকে বহণকারী নৌকাও বোঝায় থাকত সোনা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি দ্বারা (বুঝতে পারছি অনেক সাধু ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে ...... এটা আসলে আমার উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ)। চিন্তা করতে পারেন ঐ সব জিনিসগুলোর গন্তব্য কোথায় হতো??... গুয়েতাভিটা লেকের বুকে। মোড়ল নিজের হাতে ওগুলো সব ছুড়ে ফেলতেন লেকের বুকে...... ঊদ্দেশ্য সূর্যদেবকে সন্তুষ্ট করা।
তারপর মোড়ল ডুব দিতেন সেই লেকের জলে... তার শরীরের সব স্বর্ণ কণা ধুয়ে যেত লেকের জলে। সব আচার শেষে মোড়ল সাঁতরে ফিরে আসতেন তীরে।
মুইস্কা আদিবাসী
লেক গুয়েতাভিটা
ষোড়শ শতাব্দির মাঝামাঝিতে স্পেনিশ লিপিকাররা যখন একমনে লিপিবদ্ধ করে চলেছেন এই অবিশ্বাস্য কাহিণীটি...... ততদিনে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য আদিবাসীদের ভাগ্যই বরণ করে নিয়েছে মুইস্কারা। এর কিছুদিন আগেই মুইস্কারা আবিস্কৃত হয়েছে দুঃসাহসিক স্পেনিয়ার্ডদের দ্বারা। আর উপরের প্যারায় আমি যে আচারটার কথা বলেছিলাম সেটা তখন তাদের কাছে হয়ে গিয়েছে ঠাকুম্মার ঝুলির মত ব্যপার।
কিন্তু জহুরীর চোখ যে ছাই থেকেও সোনা বের করে আনতে পারে। সেই রুপকথাটাই এনে দিল স্পেনিশদের স্বর্ণাভিযানের পালে হাওয়া। অভিযাত্রী ফ্রান্সিস্কো ডি অরলেনার (১৪৯০-১৫৪৬) রিও নেগ্রোর তীরে অভিযানের স্পন্সরশীপ যোগাড় করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না।
ফ্রান্সিস্কো ডি অরলেনা (১৪৯০-১৫৪৬)
১৫৪১ এবং ১৫৪২ সালের মধ্যেই অরলেনা চষে ফেললেন দক্ষিণ আমেরিকা...... গেঁথে ফেললেন আমাজান অভিযানের সূত্র। অন্য অভিযাত্রীদের মত তাঁর প্রচেষ্টাও সফলতার মুখ দেখেনি......কিন্তু তিনি কিছু বড় পরিত্যক্ত শহর এবং কৃষিক্ষেত্রের সন্ধান দেন।
তাঁর বিশ্বাস জায়গাগুলো ছিল প্রাচুর্যে ভরপুর। অথচ সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝিতে কয়েকশ মিশনারী যখন অরলেনার বর্ণিত পথে অভিযান চালান তাঁরা কিছু শিকারী জনগোষ্ঠির বাসস্থান ছাড়া আর কোন কিছু খুঁজে পাননি। অরলেনা ইতিহাসের পাতায় মিথ্যুক হিসেবে জায়গা করে নিলেন। আর স্বপ্নের এল ডোরাডোও হয়ে যেতে লাগল ফ্যাকাসে।
জাগো বাহে... এসেছে এল ডোরাডো
এল ডোরাডো ও মিথ্যে হয়ে গেল...!! তাহলে আমার মত বেকুব মানুষগুলো হবেটা কি?? আমরা যে রহস্যময় পৃথিবীটাকে স্বর্গের চেয়েও বেশি ভালবাসি।
সেসব মানুষের ঊদ্দেশ্যেই আমার এই ভাগটা...... তাদের বলছি জাগো বাহে......
সময়টা বিংশ শতাব্দি... সায়েন্টিস্টরা কিছু একটা পেয়েছে যা সোনালী আলোয় রাঙিয়ে তুলছে ফ্যাকাসে এল ডোরাডোকে। সন ১৯৬৯, মুইস্কো বসতির কাছাকাছি এক গুহায় পাওয়া গিয়েছে একটা সোনার ভেলা... হ্যাঁ হ্যাঁ সোনার তৈরির ভেলা লম্বায় ৭ ইঞ্চি (১৮ সেমি)। বলা হচ্ছে এল ডোরাডোর সোনার ভেলাটি আসলে একটা স্থির চিত্র সেই ঘটনাটার যেটা বলেছিল মুইস্কোরা। হুম্মম এটা সেই লেক গুয়েতাভিটাকে ঘিরে বেড়ে উঠা নবনির্বাচিত মোড়লের সূর্যদেবকে দেওয়া নৈবদ্যের ঘটনা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধানের ফলাফল।
তারা রিও নেগ্রোর তীরবর্তি জঙ্গলের তলদেশে কিছু লাইন এবং প্যাটার্ন দেখতে পান...... যাকে এক কথায় বিশাল এক মৃত্তিকা চিত্রশিল্প বলা যেতে পারে। সুক্ষ নিরিক্ষার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে এগুলো ছিল কৃষিক্ষেত্রে সেচের জল নিয়ে যাবার খাল। সুতরাং কি মনে হচ্ছে...... একদম ঠিক ভেবেছেন বিশাল এক জনগোষ্ঠির চিহ্নই বহণ করছে ওসব।
এল ডোরাডো'র স্বর্ণ ভেলা
এত অভিযানের পরও কিন্তু এল ডোরাডো চিহ্নিত করতে পারিনি আমরা। দ্যা টেরা প্রেটা (লাতিন শব্দ), কয়েক সহস্র একর শক্ত কালো ভূমি এখন আমাদের মূল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে।
বিশ্লেষন থেকে দেখা যায় ঐ জায়গার মাটি ঠিক স্বভাবিক নয়...... অর্থাৎ প্রাকৃতিক মাটির মত নয় বরং সেটা বালু, শিলা এবং কয়লার একটা মিশ্রণ। এই অদ্ভুত মিশ্রণটাই এ জায়গাটাকে বিশেষ করে তুলেছে...... কারণ এটাই মাটির উর্বরতাকে ধারণ করে রেখেছে সহস্র বছর ধরে। এ মাটির উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছিয়েছেন যে এ মাটিই আসলে এল ডোরাডোর সত্যিকারের সোনা। মুইস্কাদের সোনার যে বিশাল ভান্ডার ছিল তা ছিল মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত সোনা আর তাদের মূল বাণিজ্য পণ্য ছিল কৃষিপণ্য।
কোন এক অজানা কারণে অরলেনার অভিযানের ১০০ বছরের মধ্যেই মুইস্কা জাতিটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ধারণা করা হয় শেতাঙ্গ অভিযাত্রীরা ওদের জন্য উপহার হিসেবে বয়ে এনেছিলেন মহামারী... যার ধাক্কাতেই এই পরিণতি।
তাহলে অপেক্ষার আর কি আছে??... চলুন বেরিয়ে পড়ি ঐ স্বর্ণভূমির খোঁজে... কেউ যদি বের হন আওয়াজ দিয়েন...... আমি আছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।