আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাঁসীর রায় কার্যকর হওয়ার তিন দিন আগে ১৮ জুলাই ১৯৭৬ ইং তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নিজ পরিবারের উদ্দেশ্যে লেখা শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম এর শেষ চিঠি। এই চিঠিটা তাঁর পরিবার সংরক্ষণ করেছেন। নীচে চিঠিটা হুবহু তুলে দেয়া হলো।

শ্রদ্ধেয় আব্বা, আম্মা, প্রিয় লুৎফা, ভাইজান ও আমার ভাইবোনেরা- গতকাল বিকালে ট্রাইব্যুনালের রায় দেয়া হল। আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে । ভাইজান ও মেজর জলিলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত । আনোয়ার, ইনু, রব ও মেজর জিয়াউদ্দিনের দশ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা । সালেহা, রবিউলের ৫ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা ।

অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদী কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে । ডঃ আখলাক, সাংবাদিক মাহমুদ ও মান্নাসহ তেরো জনকে এ মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়েছে । সর্বশেষে ট্রাইব্যুনাল আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়া করে বিচার কক্ষ পরিত্যাগ করলো। হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো । আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলে তিনি বললেন- ‘আমার কান্না এ জন্য যে একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে পারলো!’ বোন সালেহা হঠাৎ টয়লেট রুমে গিয়ে কাঁদতে শুরু করলো ।

সালেহাকে ডেকে এনে যখন বললাম- ‘তোমার কাছ থেকে দুর্বলতা কখনোই আশা করি নি । ’ সালেহা বললো- ‘আমি কাঁদি নাই; আমি হাসছি । ’ হাসি কান্নায় এই বোনটি আমার অপূর্ব । জেলখানায় এই বিচারকক্ষে এসে প্রথম তার সঙ্গে আমার দেখা । এই বোনটিকে আমার ভীষণ ভাল লাগে সমস্ত সাথীদের শুধু একটাই বক্তব্য কেন আমাদেরকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো না ।

মেজর জিয়াউদ্দিন বসে আমার উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখলো । জেলখানার এই ক্ষুদ্র কক্ষে হঠাৎ আওয়াজ উঠল, ‘তাহের ভাই লাল সালাম । ’ সমস্ত জেলখানা প্রকম্পিত হয়ে উঠল । জেলখানার উঁচু দেওয়াল এই ধ্বনিকে কি আটকে রাখতে পারবে ? এর প্রতিধ্বনি কী পৌঁছবে ন আমার দেশের মানুষের মনের কোঠায়। রায় শুনে আমাদের আইনজীবীরা হতবাক হয়ে গেলেন ।

তারা এসে আমাকে বললেন যদিও এই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না তবুও তারা সুপ্রিম কোর্টে রিট করবেন । কারণ বেআইনিভাবে এই আদালত তার কাজ চালিয়েছে ও রায় দিয়েছে । সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করবেন বলে বললেন । আমি তাদেরকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিলাম প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করা চলবে না । এই প্রেসিডেন্টকে আমি প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছি, এই বিশ্বাসঘাতকের কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারিনা।

সবাই আমার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শুনতে চাইলো । এর মধ্যে জেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সরিয়ে নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো । বললাম, আমি যখন একা থাকি তখন ভয়, লোভ-লালসা দূরে চলে যায় । আমি সাহসী হই, বিপ্লবের সাথী রূপে নিজেকে দেখতে পাই । সমস্ত বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করার এক অপরাজেয় শক্তি আমার মধ্যে কাজ করে ।

তাই আমাদের একাকীত্বকে বিসর্জন দিয়ে আমরা সবার মাঝে প্রকাশিত হতে চাই । সে জন্যই আমাদের সংগ্রাম। সবাই একে একে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে । অশ্রুসজল চোখ । বেশ কিছু দিন সবাই একত্রে কাটিয়েছে ।

আবার কবে দেখা হবে । সালেহা আমার সঙ্গে যাবে । ভাইজান ও আনোয়ারকে চিত্তচাঞ্চল্য স্পর্শ করতে পারেনি । কিন্তু তাদেরকে তো আমি জানি । আমাকে সাহস যোগাবার জন্য তাদের অভিনয়; বেলালের চোখ ছলছল করছে ।

কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায় । জলিল, রব, জিয়া, আমাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো । এই আলিঙ্গনে আমরা গোটা জাতির সঙ্গে আবদ্ধ । কেউ তা ভাঙ্গতে পারবে না। সবাই চলে গেলো ।

আমি আর সালেহা বের হয়ে এলাম । সালেহা চলে যাচ্ছে সেলের দিকে । বিভিন্ন সেলে আবদ্ধ কয়েদি অ রাজবন্দীরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বন্ধ সেলের দরজা জানালা দিয়ে । মতিন সাহেব, টিপু বিশ্বাস ও অন্যান্যরা দেখালো আমাকে বিজয় চিহ্ন । এই বিচার বিপ্লবীদেরকে তাদের অগোচরে ঐক্যবদ্ধ করলো।

ফাঁসীর আসামীদের নির্ধারিত জায়গা ৮ নম্বর সেলে আমাকে নিয়ে আসা হলো । পাশের তিনটি সেলে আরো তিন জন ফাঁসীর আসামী। ছোট্ট সেলটি ভালোই, বেশ পরিষ্কার । মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন জীবনের দিকে তাকাই তাতে লজ্জার কিছুই নেই । আমার জীবনের নানা ঘটনা আমাকে আমার জাতির ও জনগণের সাথে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে ।

এর চাইতে বড় সুখ, বড় আনন্দ আর কী হতে পারে? নীতু, যীশু ও মিশুর কথা- সবার কথা মনে পড়ে । তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি । কিন্তু আমার গোটা জাতি রয়েছে তাদের জন্য আমরা দেখেছি শত সহস্র উলঙ্গ মায়া-মমতা-ভালোবাসা বঞ্চিত শিশু । তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি। বাঙালী জাতির উদ্ভাসিত নুন সূর্য ওঠার আর কত দেরী! না, আর দেরী নেই, সূর্য উঠল বলে ।

এদেশ সৃষ্টির জন্য আমি রক্ত দিয়েছি । আর সেই সূর্যের জন্য আমি প্রাণ দেব যা আমার জনগণকে আলোকিত করবে, উজ্জীবিত করবে- এর চাইতে বড় পুরস্কার আমার জন্য আর কী হতে পারে । আমাকে কেউ হত্যা করতে পারে না । আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত । আমাকে হত্যা করতে হলে সমগ্র জাতিকে হত্যা করতে হবে ।

কোন শক্তি তা করতে পারে? কেউ পারবে না। আজকের পত্রিকা এলো । আমার মৃত্যুদণ্ড অ অন্যান্যদের মেয়াদী কারাদণ্ডের খবর ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায় । মামলায় যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা । রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতৃত্বেই ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব ঘটে ।

আমার নির্দেশেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়, আমার প্রস্তাবেই বর্তমান সরকার গঠিত হয় । সমগ্র মামলায় কাদেরিয়া বাহিনীর কোন উল্লেখই ছিল না । এডভোকেট আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী ও অন্যান্য যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটির সত্য বিবরণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন । আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না । কিন্তু বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারী জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে ।

দায়িত্ব পালনে তাঁরা ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদেরকেও ক্ষমা করবে না। তোমরা আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আদর নিও । বিচার ঘরে বসে জিয়া অনেক অনেক কবিতা লিখেছে, তারই একটির অংশ- জন্মেছি, সারা দেশটা কাঁপিয়ে তুলতে কাঁপিয়ে দিলাম । জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে ভেঙ্গে দিলাম । জন্মেছি, মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে করেই গেলাম ।

জন্ম আর মৃত্যু দুটি বিশাল পাথর রেখে গেলাম । পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের কবর দিলাম । পৃথিবী-অবশেষে এবারের মত বিদায় নিলাম । তোমাদের তাহের ঢাকা সেন্ট্রাল জেল ১৮ জুলাই ১৯৭৬ ­­­­­­­­­­­­­। Courtesy : Colonel Taher's Web Site http://www.col-taher.com ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.