আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘আমরা কথা বলি না, ভাষা আমাদের ভিতর দিয়ে কথা বলে।’

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

ফার্দিনান্দ সাস্যুর। এঁর ভাষাসংক্রান্ত চিন্তাভাবনার ওপরই আধুনিক ভাষাবিদ্যার ভিতটি গড়ে উঠেছে। জাতে সুইস সাস্যুর-এর জন্ম ১৮৫৭ সালের ২৬ নভেম্বর।

সংস্কৃত ও ইন্দোইউরোপীয় ভাষায় ছিল অসামান্য দখল- জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। জীবদ্দশায় তেমন সম্মান পাননি সাস্যুর। এই নিয়ে ক্ষোভ ছিল মনে। গবেষনার পান্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন তীব্র হতাশায়। ১৯১৩ মালে মারা যান সাস্যুর।

ভাগ্যিস ছাত্রদের কাছে সাস্যুরের ক্লাস লেকচার ছিল। সেই ক্লাস লেকচারই পরে ছাপানো হল ‘কোর্স ইন জেনালের লিঙ্গুষ্টিক’ নামে। সে বই প্রকাশ পাওয়ার পর পরই সাস্যুরকে বলা হল আধুনিক ভাষাবিদ্যার জনক। কুড়ি শতকের প্রারম্ভে কাঠামোবাদী ধ্যানধারনা ইউরোপের বিদ্যান মহলে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকে। এই কাঠামোবাদী ধ্যানধারণার পিছনে সাস্যুর এর গভীর অবদান ছিল।

আসলে সাস্যুরই ছিলেন প্রথম কাঠামোবাদী। সাস্যুর ভাবতেন, ভাষার সঙ্গে যা যা জড়িত ভাষাকে সে সব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ভাষাকে কাঠামো হিসেবে গন্য করতে হবে। সাস্যুর-এর মতে, আমরা কথা বলি না। ভাষা আমাদের ভিতর দিয়ে কথা বলে। এক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তাসম্পন্ন ব্যাক্তির ভূমিকা খুবই নগন্য।

কাজেই শব্দের অর্থের বিষয়ে এতদিন যে আলোচনা চলছিল সে সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গেল বদলে। সাস্যুর বিশ্বাস করতেন, ব্যাক্তিমানুষ ভাষার উপর মানে আরোপ করে না-শব্দের সঙ্গে শব্দের যে সম্পর্ক তাই ভাষার মানে নির্ধারন করে। মানুষ কথা বলার আগেই শব্দগুলির মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছে এবং শব্দের সঙ্গে যা যা জড়িত বা সংশ্লিস্ট সেসবের সঙ্গে শব্দের মানের কোনও সম্পর্ক নেই। কাজেই, একজন ভাষাবিজ্ঞানী পৃথিবীর যে কোনও ভাষা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে পারেন। যে কোনও ভাষা-সে ভাষার সঙ্গে মন কি বিশ্বের সম্পর্ক-ইত্যাদি বিষয় গবেষনায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে না।

এই রকম যুগান্তকারী ধারনার কারণে সাস্যুরের ভাষাভিত্তিক ধ্যানধারনা অপরাপর শাখায় যেমন: নৃতত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাহিত্যসমালোচনা ও মনোবিশ্লেষনেও প্রয়োগ করা হল। আশাতীত ফল ফল। উত্তরাধুনিক যুগের পথ খুলে গেল। ফার্দিনান্দ সাস্যুর ভাষাকে দেখেছেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ন পদ্ধতি হিসেবে। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব, এখানেই তাঁর বিপ্লব।

তাঁর মতে, ভাষার এই পদ্ধতিটির যে কোনও অংশই গুরুত্বপূর্ন-এই কারণে নয় যে সেটি সিসটেমের বাইরে সংশ্লিস্ট; আসলে সে পদ্ধতির ভিতরেই সর্ম্পকিত। সাস্যুর বললেন, দুটি পৃথক বিষয়ের সঙ্গে শব্দের অর্থ জড়িত। ক) Signified এবং খ) Signifier সিগনিফায়ার হল যে কোনও ভাষার যে কোনও শব্দ। আর, সিগনিফায়েড হল সেই শব্দের সঙ্গে জড়িত বস্তু। যেমন, সিগনিফায়ার হল গাছ।

আর, সিগনিফায়েড হল সত্যিকারের গাছ। সিগনিফায়ার দিয়ে ভাষা তৈরি হয়। সিগনিফায়েড দিয়ে নয়। মানে সত্যিকারের বস্তু ভাষায় কোনওই কাজে আসে না। সাস্যুরের মতে, সিগনিফায়েড এবং সিগনিফায়ার-এর সম্পর্ক কখনেই সুস্থির বা ধ্রুব নয়।

বরং, তা নির্ভর করে প্রথার ওপর। যেমন, বাস্তব (সিগনিফায়েড) আম-এর সিগনিফায়ার আম ছাড়াও অন্য যে কোনও কিছু হতে পারত। যেমন: আলাপি। তেমনি বাস্তব (সিগনিফায়েড ) বেড়ালের সিগনিফায়ার বিড়াল ছাড়াও অন্য কিছু হতে পারত। যেমন: আড়াল।

তাতে কোনই অসুবিধে ছিল না। কেননা, এই বিষয়টি অর্থাৎ, সিগনিফায়ার ঠিক করে সমাজের প্রথা। যে কারণে বাঙালি সমাজে গাড়ি হতে পারত আড়ি। আর, আমরা বলতাম; আড়ি করে বাড়ি যাব। সাস্যুরের এই আবিস্কারই বদলে দিয়েছে সমকালীন ভাষাবিজ্ঞান।

সাস্যুর তাঁর ‘কোর্স ইন জেনালের লিঙ্গুষ্টিক’ গ্রন্থে আরও বললেন, যে কোনও ভাষার মানে বুঝতে সেই ভাষার ঐতিহাসিক বিকাশের অধ্যয়ন কোনওই কাজে আসবে না। ভাষা কীভাবে কাজ করে- সেটি ভাষা কী ভাবে সময়ের হাত ধরে বদলে গেল- তা নীরিক্ষা করে লাভ নেই! এ বিষয়ে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ক) diachronic. এবং খ) synchronic. ডায়াক্রোনিক দৃষ্টিভঙ্গি হল -ভাষাকে সময়ের সঙ্গে বদলানো একটি বিষয় মনে করা । সিনক্রোনিক দৃষ্টিভঙ্গি হল-ভাষা এমনই এক পদ্ধতি যা বরাবরই একইরকম ছিল। বলাবাহুল্য, সাস্যুর সিনক্রোনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক ছিলেন।

সাস্যুর বিশ্বাস করতেন, কোনও শব্দের ধ্বনি তখনই অর্থবোধক হবে যখন সেটিকে অন্য শব্দের ধ্বনির সঙ্গে তুলনা করা হবে। শব্দের ধ্বনির পার্থক্য নির্ভর করে ফোনেমের ওপর। Phonemes হল-শব্দের সেই ধ্বনি যার এমনিতে মানে নেই কিন্তু অন্য শব্দের ধ্বনির চেয়ে আলাদা। অন্য শব্দের সঙ্গে তুলনীয় হলেই কেবল একটি শব্দের মানে বোঝা যাবে-নইলে নয়। মানুষের মুখের কথা ও ভাষাপদ্ধিতর পার্থক্য দেখিয়েছেন সাস্যুর।

তাঁর মতে ভাষার পদ্ধতি হল langue এবং মানুষের মুখের ভাষা হল parole.প্যারোল তখনই অর্থবোধক হয়ে ওঠে যখন এটি langue-এর সঙ্গে সর্ম্পকিত হয়। এর মানে, ভাষার অর্থ কোনও মানুষের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে কী ভাবে ভাষার সিসটেম কাজ করে তার ওপর। উপরোন্ত, যে কথা বলছে সে -সে ভাষার সিসটেমের সম্পর্কে সেভাবে নাও জানতে পারে। তবে তার বলা কথার অর্থটি অবশ্য তারই এবং সেটি সর্ম্পূন ভাষার পদ্ধতিটির অংশ।

যে কারণে বলা হয়েছে: ভাষাই বক্তাকে বা ভাষার ব্যাবহারকারীকে সংজ্ঞায়িত করে। নিজেকে জানতে হলে পৃথকভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই কিংবা লাভ নেই ভাষার থেকে দূরে থেকে নিজের সম্বন্ধে কিছু বলে। বরং ভাবা উচিত, কী করে অন্যের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় এবং কীভাবে নিজস্ব বিশ্বাস ও ধারণা প্রকাশ করা যায় যা সম্পূর্ন ভাষাপদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। মানে, আমাদের ধারণা ও বিশ্বাস প্রকাশ করতে আমাদের ভাষাপদ্ধতির উপর নির্ভর করতে হয়। এখানেই উত্তাধুনিক ভাবনার সূচনা।

যা আগেকার সব ভাবনাছে ছাপিয়ে গিয়েছে। যে ভাবনার সূচনাবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ সাস্যুর-জীবদ্দশায় যিনি উপেক্ষিত হয়েছিলেন। যিনি বিশ্বাস করতেন; আমরা কথা বলি না। ভাষা আমাদের ভিতর দিয়ে কথা বলে। Roger Scruton রচিত A Short History of Modern Philosophy অবলম্বনে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.