আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাথী

~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~
পৃথিবীতে কিছু কিছু মানূষ আছে, যাদের জন্মই হয় ঝামেলায় পড়ে যাবার জন্যে। তারা যেখানেই যাক না কেন, ঝামেলা তাদের সাথে সাথে যায়। সে হলো তেমনই একজন মানূষ। ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কোন কাজ তার ঝামেলা ছাড়া শেষ হয়নি। প্রতিটা কাজ শুরু করার আগেই সে ভেবে নেয় কি কি ঝামেলা হতে পারে, কিন্তু তার কল্পনার সীমাবদ্ধতা প্রমাণ করতেই যেন নতুন নতুন ঝামেলা সৃষ্টি হয় প্রতিবার।

ঝামেলায় থাকতে থাকতে তার মধ্যে একটা ঝামেলা প্রীতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন সে কেবল নিজেই ঝামালায় জড়িয়ে পরে না, বরং অন্যদের ঝামেলাও নিজের ঘাড়ে তুলে নায়। তিথীকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই এই কথাটা আমার সবার আগে মনে হয়। কেন যেন ঝামেলা ছাড়া সে চলতে পারেনা। এমনই এক ঝামেলায় পড়ে সে আমার কাছে গেছিলো।

তিথীর বান্ধবী শম্পার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের একটা পার্টে ছিল একটা সার্ভে। গ্রামে গিয়ে কমপক্ষে ২৫০ জন মানুষের মতামত নিয়ে একটা থিসিস করতে হয় তাদের। দুইটা মেয়ের পক্ষে বদ্ধ গ্রামে গিয়ে ২৫০ মানুষের সার্ভে করা সহজ কথা না। সে কারনেই শম্পা আমার সাহায্য চায়। আমি আগেও অনেকজনকে এমন হেল্প দিয়েছি, তাই সেবারেও কোন চিন্তা ছিলনা আমার।

কিন্তু সমস্যা হলো যে সেইবার গ্রামের কিছু লোকের সাথে আমাদের কিছু ছেলের একটা ঝগড়ার মত হওয়ায় কেউই ওদের সাথে যেতে রাজি হচ্ছিলনা। বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হয় ওদের সাথে। শম্পার ঝামেলা কাঁধে নিয়ে তিথিও যথারিতি আমাদের সাথী হয়। সার্ভের কাজ করতে গ্রামে যেতে হয় মোট ৫ দিন। তারপর ডাটা এনালাইসিস করতেও শম্পা আমার স্বরনাপন্য হয়।

আমি ছাড়া আর কোন গাধা বিনা পয়শায় সেই বিরক্তিকর কাজটা করে দেবে। এই জন্য আরও সাতদিন শম্পা আর তিথী আমার হলে নিয়মিত যাতায়াত করে। সব মিলিয়ে ১৫ দিনে আমি তিথীকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাই। অত্যন্ত ফ্রেন্ডলী আর কেয়ারিং একটা মেয়ে তিথী। সবার সব প্রয়োজনে তিথী আছে সবসময়, কিন্তু তিথীর প্রয়োজনের সময় কেউ নেই।

আমিও সবার সব প্রয়োজনে থাকি, কিন্তু আমার সাথে ওর এই একটা জায়গাতেই অমিল, নিজের কাজে সে কাউকে ডেকে নিতে পারেনা। আমার তখন অনার্স ফাইনাল শেষ, রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি, এই সময় এমন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হলো, যাকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বাঁধার সপ্ন দেখা যায়। না, তিথীকে আমি কখনই বলিনি “তোমাকে ভালবাসি”, বলেনি সে নিজেও। কিন্তু আমরা দুজনেই বুঝে গিয়েছিলাম যে সময় এসেছে, আমাদের দুজনকেই দুজনার জীবনে দরকার। অনার্সের রেজাল্ট বের হবার পর আমি মা’কে তিথীর কথা বলি।

মা আমাকে নিয়ে ওদের বাসায় যান, কথা বলেন সবার সাথে। বাসায় ফিরে বাবার সাথে কথা বলে কয়েকদিন পর আমাকে গ্রীন সিগনাল দিয়ে দেন মা। আমি রাজশাহিতে ফিরে যাই ৪ মাসের একটা কন্ট্রাক্ট জব নিয়ে। সেই ৪ মাস আমরা প্রায় প্রতিটা বিকেল এক সাথে কাটিয়েছি, আর ছুটির দিন গুলোতে সারাটা দিন। আমি তিথীকে বলতাম যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলো কাটাচ্ছি আমরা।

এর পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে যায়। ঢাকায় ফিরে এসে বাবার আদেশে থিসিস কমপ্লিট করতে আমি ময়মনসিংহে চলে যাই। এর মাঝে আমার বিয়ের দিন ক্ষন ঠিক হয়। থিসিসয়ের বাস্ততা আর নতুন ব্যাবসা নিয়ে ঝামেলায় থাকায় আমি আমার বিয়ের আগের দিন রাত ০১.৫৬ মিনিটে বাসায় পৌছাই। পরদিন বিয়ে, তারপর দিন বৌভাত, এবং তারপর দিন আমি যথারিতি ময়মনসিংহে।

তিথীকে ঢাকায় রেখে আমি থাকতাম ময়মনসিংহে। প্রতি সপ্তাহে যেতে পারতামনা ঢাকায়, হয়তো ১৫ দিনে একবার গিয়ে ২/৩ দিন থেকে চলে আসতাম। কথা হতো সেল ফোনে। ২০০৩’এ জুন মাসে আমার থিসিস শেষ হয়। আমি ফিরে আসি ঢাকায়।

শুরু হয় আমার সংসার। সে এক অন্যরকম জীবন। রোজ সকালে ওর মুখ দেখে ঘূম থেকে ওঠা। খুব সকালে তিথীকে উঠতে হতো, আমার বাবা ফজরের নামাজ পরে চা খেয়ে মর্নিং ওয়াকে যান, তিথী সাথে যেত, আমি যেতামনা কখনই। ফিরে এসে তিথী ব্যাস্ত হয়ে পরতো সকালের নাস্তা বানানোর জন্য।

আমি উঠে তৈরী হতাম অফিসে যাব বলে। নাস্তা করে আমি আর বাবা একসাথে বেরিয়ে যেতাম। সন্ধায় ফিরে এসে কোন কোন দিন বেড়াতে যাওয়া, কোনদিন এমনি গল্প করতেম বাসায় বসে। দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো ভালোই। ২০০৩ এর শেষ দিকে একটি সকাল।

তিথী তখন তার বাবার বাসায়। ছুটির দিন, আরাম করে ঘুমুচ্ছিলাম। ভোর ৬ টায় ঘুম ভেঙ্গে যায় তিথীর কল পেয়ে। “হ্যালো” ......... ওপাশ থেকে শুধুই হাসির শব্দ। আমি জানতে চাই কি হয়েছে, তিথী কিছুই বলেনা, শুধু হাসে।

অনেক্ষন পর সে বললো, “কি চাও তুমি আমার কাছে? আমি তোমাকে একটা গিফট দেবো”। সাত সকালে এমন কথা শুনে একটু বিরক্ত হই, আমি মেয়েদের ঠিক বুঝি না, তবে এতটুকু জানি যে ওরা খুব ইমোশনাল। আমাকেও মানিয়ে নিতে হয় মাঝে মাঝে। বিরক্তি প্রকাশ না করে কারন জানতে চাই, ওপাশ থেকে আবারও হাসি। মহা যন্ত্রনা! একটু পরে ফোন কেড়ে নেয় তিথীর ছোট বোন, “ভাইয়া, আপনি আর মানূষ হলেন না, কনগ্রেচুলেশনস, আপ বাপ বাননে ওয়ালে হো” !!! মিনিট দুয়েক চুপ করে ছিলাম, কোন কথা বলতে পারিনি।

আমি, মানে এই আমি, বাবা হবো, একটা তুলতুলে ছোট্ট বাবু, নরোম তুলোর মত, আমার বুকের ওপর ঘুমাবে, সমস্ত হাতের তালু দিয়ে আকড়ে ধরবে আমার একটা আঙ্গুল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসবে, আমার, আমার নিজের একটা বাবু, কেউ নিয়ে যাবে না ............। তিথীকে শুধু বলেছিলাম আমি আসছি। গাড়ী নিয়ে যাইনি, কারন আমার ড্রাইভ করার মত অবস্থা ছিলনা। আমার অষ্ট্রেলীয়ায় আসার কথা ছিলো ২০০৪ এর এপ্রিল মাসে। ডেট পিছিয়ে নভেম্বরের ৭ তারিখে নিয়ে যাই।

বাবু হবার ডেট ছিলো জুন মাসের ২৯ তারিখ। জুনের ১৮ তারিখে তিথীর জন্মদিন। আমি ১৬ তারিখ সকালেই কি মনে করে যেন তিথীদের বাসায় গিয়ে হাজির হই। সেদিন রাত ১১.১০ এ তিথীর পেইন ওঠে, বাবু হয় ১৭ তারিখ সকাল ৭.৫৩ মিনিটে। বাবু হবার আগে ৮টা ঘন্টা খুব কষ্ট পেয়েছিলো তিথী, খুব।

ওর কষ্ট দেখে আমি এতই উদ্বিগ্ন ছিলাম যে অপারেশন থিয়েটারের দরজায় দাঁড়িয়েও আমি প্রথমেই আমার বাচ্চার কান্না শুনতে পাইনি। সবাই যখন বলছিলো – বাবু কাঁদছে – তখন আমার মনে পরে, তাইতো, আমার তো একটা বাবু পাবার কথা !!! ১৭ই জুনের সেই বৃষ্টি ভেজা ভোরে একটা আশ্চর্য রকম ছোট্ট বাবুকে যখন আমার কোলে দেয়া হলো, আমি সেই মূখটার দিকে তাকিয়ে কেন যেন কেঁদে ফেলেছিলাম। বাবু কাঁদছিলোনা, কাঁদছিলাম আমি। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো তিথীর ছোট বোনেরা। বাবু ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষনে।

আমি ওর কানে কানে আজান দিলাম, সুরা পড়লাম, দোয়া পড়লাম। তারপর বাবুকে ওরা নিয়ে গেল পরিষ্কার করবে বলে। তিথী তখনও অপারেশন থিয়েটারে। ডাক্তার আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একগাদা ঔষধের লিস্ট। ব্যাস্ত হয়ে গেলাম আবারও।

বাবু হবার পরেও ৪ মাস ঢাকায় ছিলাম। সেই সময়ের প্রতিটা দিন এক একটা স্বপ্ন। নভেম্বর মাসে চলে আসি সিডনীতে। শুরু হয় আমার অন্য জীবন, একঘেয়েমি আর একাকিত্ত্বে ভরা যান্ত্রীক জীবন। মাঝে দু’দুবার ওদের নিয়ে আসার চেস্টা করেছিলাম, ভিসা দেয়নি অষ্ট্রেলীয়ার হাইকমিশন।

এখন এখানে শুধুই বেঁচে থাকা, শুধুই বেঁচে থাকা।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।