আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপ্রকাশিত (সপ্তম পর্ব)

মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত। তা হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রন

আজ রঞ্জনের ছুটি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে ডাক্তার। বেশ কয়েকদিন পর গত রাতে আমি ওর সাথে ছিলাম। শেষ রাতে হঠাৎ কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই।

ঘুম থেকে উঠে দেখি কেবিনে একটা উৎসব উৎসব ভাব। সুমী এসেছে। রঞ্জন আর সুমী দুজনই কি নিয়ে যেন খুবই আনন্দিত। আমি ঘুম থেকে উঠে চোখ বড় বড় করে ওদের দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। তখনই সুমী সুসংবাদটা দিল।

আমি বিছানা ছেড়ে নামলাম। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম রঞ্জনের দিকে। “ তোর মুক্তি। সাথে আমারো মুক্তি। শুভ হোক এই আনন্দ উৎসব।

” রঞ্জন হাসতে লাগলো। “ মাঝে মাঝে তোর এই ধরনের বইয়ের ভাষায় কথা বলাটা মন্দ লাগে না। ” সুমী হাসছে। ওদেরকে পাশাপাশি দেখতে বেশ লাগছে। আমি সরে এলাম ওদের কাছ থেকে।

কেবিনের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে চলে গেলাম। সকালটা খুব সুন্দর হয় সব সময়। সুন্দর সকাল দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি অনেক লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম। রঞ্জনের অসুখটা বড় অদ্ভুত।

আসলে অদ্ভুত না। অসুখটা বলে বোঝানো কঠিন। ওর সমস্যাটা মানসিক। অনেক দিন ধরেই ও যুদ্ধ করছে। কিছুটা নিজের সাথে, কিছুটা পারিপার্শ্বিকের সাথে আর বাকিটা বোধহয় ভাগ্যের সাথে।

রঞ্জন আমার ছোট বেলার বন্ধু। স্কুল থেকেই আমরা একসাথে বড় হয়েছি। আমাদের আরেকজন খুব কাছের বন্ধু ছিল, সৌমেন। অনেক অনেক দুরন্তপনার মাঝে একটা বিশাল স্মৃতি হলো আমার এই বন্ধুদের সাথে অসম্ভব সুন্দর সময় গুলো। আমরা প্রচুর খেলাধুলা করতাম।

ক্রিকেট ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। ওরা দুজনই আমার চেয়ে অনেক ভালো খেলত। যখন কোথাও খেলার জন্য ডাক আসত তখন আমাকে না নিলে ওরা খেলত না। এ এক অন্যরকম বন্ধুত্ব। এরকমই একদিন আমরা খেলতে গিয়েছিলাম ধারে।

যথারীতি ওদের দাপটে আমিও টিমে আছি। হঠাৎ কি নিয়ে যে গন্ডগোলটা লাগলো। কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এটুকু বুঝেছি পালাতে হবে। আমি রঞ্জন আর সৌমেন কে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে আসছিলাম।

কিন্ত সৌমেনের কি যে হলো হঠাৎ? বোধহয় কেউ টিপ্পনি কেটে কিছু বলেছিল। আমার হাত ছেড়ে ছুটে গেল। জটলার মাঝে ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে ফেললাম ওকে। তারপর যখন খুজে পেলাম, যেন অন্য কেউ। মাথা ফেটে গল গল করে রক্ত ঝরছে।

অনেকদিন আগের কথা। আমার এখনো মনে আছে স্পষ্ট। এর ঠিক দুই দিন পর। সৌমেন চলে গেল অনেক অনেক দূরে। এই সত্যিটা বিশ্বাস করতে অনেক দিন লেগেছিল।

আমার চিন্তা শক্তি থেমে গিয়েছিল। ওর চোখ দুটো যখন বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে, আসলে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। কেমন একটা অনুভূতি যে আমার হয়েছিল। বুকটা প্রচন্ড খালি খালি লাগতো। একটা ভয়ংকর কষ্টবোধ হত।

সামান্য সময়ের জন্য একা থাকলেও কান্না পেত। কত যে কেদেঁছি। জলজ্যান্ত মানুষটা হারিয়ে গেল হঠাৎ করে। আর একটা বিশাল শুন্যতা গড়ে দিল কিছু মানুষের বুকে। সৌমেন আমার খুব কাছের মানুষ ছিল।

তারপরো এই শুন্যতা হারিয়ে যেতে কিন্ত আসলেই খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র কয়েকটা বছর। শুন্যতাটা সেই সময়ের মতন টের পাইনা। কিন্ত তাই বলে একেবারে ভুলে যাইনি সৌমেনকে। ভাবতে অবাক লাগে।

রঞ্জনের সমস্যাটা সৌমেনকে ঘিরে। এটা আমার বাস্তবিক অভিজ্ঞতার আরেকটি অধ্যায়। সৌমেন মারা যাবার দুদিন পরের ঘটনা। উদভ্রান্ত রঞ্জন দৌড়ে আমাদের বাসায় এল। আমি ওকে দেখে খুব অবাক হলাম।

ওর চোখ দুটো বলছিল ও ঠিক নেই। আবোল-তাবোল কথা বলছিল। সব কথার মাঝেই সৌমেন আর ক্রিকেট। ঠিক আমার চেনা রঞ্জন নয়। মনে হচ্ছিল অন্য কেউ।

অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষ। তখন থেকে ওর এই সমস্যার শুরু। এমনিতে পুরোপুরি ভালো মানুষ। মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যায়। সৌমেনকে খুব বেশি মিস করে বোধহয়।

এরকম সময়টা ও ঠিক ওর মাঝে থাকে না। মনে হয় অন্য কোনো স্বত্তা এসে ভর করে ওর মাঝে। এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই সমস্যা। যদিও এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। মাঝে মাঝে হিংসে হয় রঞ্জনকে।

কি ভয়ংকর ভালোই না বাসতো সে সৌমেনকে। হয়তো সৌমেনও পারেনি উপেক্ষা করতে এই ভালোবাসা। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। গভীর ভাবে ভালোবাসার মতন সহজ কাজটাও আমি করতে পারিনি। মনে হয় আসলে কাজটা ততটা সহজ নয়।

“কিরে এত সকাল সকাল কোথায় ডুবে গেলি? ” কখন যে রঞ্জন আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে টের পাইনি। ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওর চোখ মুখ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হয়তো হাসপাতাল ছাড়ার আনন্দে এই উজ্জ্বলতা। আমি কোনো উত্তর দিলাম না।

একটু হাসলাম। “নাহ্‌। তেমন কিছু না। সকালটা সবসময় সুন্দর হয়। মনে হয় একটু ছুঁয়ে দেখি।

হাত দিয়ে তো ছোঁয়া যায় না। তাই সৌন্দর্য অনূভব করার চেষ্টা করছিলাম। ” “হা হা হা। তুই কি জানিস যে তুই একটা অসম্ভব সুখী মানুষ। ” “তা জানিনা।

তবে আমি অসুখী নই এটা ঠিক। ” “দুটোর মধ্যে পার্থক্য কি হলো? ” “অনেক পার্থক্য। মানুষ হিসেবে তুই ভালো আর মানুষ হিসেবে তুই খারাপ না এই বাক্য দুটোর মধ্যে যেই পার্থক্য এখানেও একি পার্থক্য। ” “এই দুটোর মধ্যে কি পার্থক্য? ” “ তুই মানুষটা খারাপ না মানে হলো তুই কারো ক্ষতি করিস না কিংবা তুই খারাপ কোনো কাজ করিস না। আর তুই মানুষটা ভালো মানে হলো, তুই খারাপ কাজতো করিস না উপরন্তু ভালো ভালো কাজ করিস।

বুঝলি? ” “ হম্‌ম। বুঝলাম। আমি এখন পর্যন্ত খুব কম বিষয় পেয়েছি যেই ব্যাপারে তুই বিজ্ঞের মতন মতামত দেসনি। আবার এটাও সত্য তোর কথা গুলোতে যুক্তি আছে। তুই এত সব বিষয় নিয়ে এত গবেষণা করিস কেন? ” “ এই যুক্তি দিতে কিন্ত খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না।

যেমন ধর আমার জায়গায় এই যুক্তিটা যদি তুই দিতি তবে আমি কি বলতাম জানিস? ” “কি? ” “ আমি বলতাম, একটা কথা সত্য আর মিথ্যা না, এই দুটো বাক্যের পার্থক্য কিভাবে হবে তাহলে? ” রঞ্জনের চোখ মুখ হঠাৎ শক্ত হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে আমার দ্বিতীয় যুক্তি শুনে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ও এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলছে না। ওর মেজাজ বিগড়ে দিতে পেরে কেমন যেনো আনন্দ লাগছে। তবে একটু খারাপও লাগছে।

ওর মন মেজাজ বেশ ভালো ছিল। তাই ওকে শুধু শুধু আর না ক্ষেপানোটই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমিই কথা শুরু করলাম। “ হাসপাতাল থেকে কখন বের হবি? ” “ এইতো। দুপুরের পরে।

তুই থাকবি ততক্ষন? ” “দেখি। ঠিক নেই। ” “ আচ্ছা চল ভেতরে যাই। সুমী একা একা বসে আছে। ” “ তুই যা।

আমি আসছি। ” রঞ্জন ভেতরে চলে গেল। আমি আগের মতন ঠায়ঁ দাঁড়িয়ে রইলাম। সকালের সুন্দর অনুভূতিটা এত দ্রুত হারাতে ইচ্ছে করছে না। রঞ্জনের কেবিনটা তৃতীয় তলায়।

হাসপাতালের পেছন দিকে একটা মাঠ আছে। কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছে মাঠে। আমি দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করছি খেলাটা কি? ছেলে বেলায় যে কত রকম খেলা খেলতাম। কিন্ত তারপরো বুঝতে পারছি না এটা কি খেলা? বোধহয় এই দশকের যুগপযোগী গতিশীল কোনো খেলা যেটা আমার অজানা। সকালের স্নিগ্ধতা কমে আসছে আস্তে আস্তে।

আর কিছু সময়ের মাঝে শুরু হয়ে যাবে ব্যস্ত সময়ের চলাচল। যদিও তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তারপরো আমার দিনের চলাচলের এটাই শুরু। সূচনা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই, তা ভালোই হোক আর মন্দ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।