আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সারমেয় মানব

শ্রদ্ধা আর মমতাই তোমাকে জয়ী করতে পারে; তুমি তোমার জ্ঞান প্রয়োগ কর।

শেষ ফাল্গুনের এক মনোরম অপরাহ্ন। গাছদের ছায়া দীর্ঘ হয়ে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে গাঁয়ের সীমা, ছোট নদীটির উপর দিয়ে আলোড়িত ফসলের মাঠে। রবি শস্যের রঙ-গন্ধ প্রজাপতি আর পাখির ডানায় ভেসে চলে যায় দূর-দিগন্তে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে এক পশলা; ঝকঝকে পরিপাশ, আকাশে শুভ্র মেঘের পায়চারি আর হালকা শীতের একটা আমেজ ছড়িয়ে।

মনোরম এই অপরাহ্নে ফুল, পাখি আর মেঘদের গল্প বলার জন্য দূরদূরান্ত থেকে এসেছে কবি, কথক ও চিত্রকরের দল। শুরু হয় গল্পের আসর, আর মেঠোপথ ধরে গল্প ভেঙে হঠাৎ সামনে এগিয়ে যেতে থাকে এক বেখাপ্পা বুড়ো; এটি তারই কাহিনী। কুঁজো বুড়ো, হাড় জিরজিরে শরীর। আজকাল অনুভূতিগুলিও নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই তার। শুধু একটা প্রচণ্ড খিদে তাকে জাগিয়ে রাখে সারাক্ষণ, আর সব অনুভূতি এখন একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

অবশ্য একসময় তার দেহ ছিল ঋজু সুঠাম, ছিল অনেকগুলি স্বতন্ত্র অনুভূতি, তীক্ষ্ণ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ, যা শ্রদ্ধা ও সমীহ জাগাত মানুষের মনে। বুড়ি মারা গেছে বহু দিন। ছেলে আর মেয়েদের হয়েছে নিজেদের সংসার। নাড়ির বাঁধন ছিঁড়েই যাওয়ার মত, কিন্তু মা-বাবা যেহেতু একটি সত্য, বাঁধন একেবারে ছিঁড়ে না। সন্তানদের কাছে বুড়ো এখনো তাই কুঁজো একজন মানুষের চেয়ে সামান্য একটু বেশি।

আর এজন্য বুড়োর অনুভূতির অগভীরতা নিয়ে আমাদের মোটেও দুঃখ করা উচিত না। তিন ছেলের ঘরে পালা করে খায় বুড়ো। কিন্তু সমস্যা তার খিদে। ছেলেবউরা যখন তাদের ভবিষ্যত জীবনের ছবি আঁকে, তখন বারবার বুড়োর খিদে বড় হয়ে এসে দাঁড়ায় তাদের সামনে। অবশ্য মানুষকে তার নিজের ছবিই এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সামনে আর বুড়ো আদিকালের মানুষ, তার খিদে দিন দিন তাই বেড়েই চলে।

খিদের জ্বালায় বুড়ো একদিন ভিক্ষা শুরু করে, একটু দূরে গঞ্জে। কিন্তু একদিন ধরাও পড়ে যায় পৃথিবীর সৌন্দর্য্য রক্ষায় নিয়োজিত নিষ্ঠাবান এক সমাজ অধিপতির কাছে, যিনি বুড়োর ছেলেদের কাছে জানতে চান বড় লোক হওয়ার জন্য নিজের বাবাকে ভিক্ষায় নামিয়ে দিতে তাদের বেঁধেছিল কি না? সেদিন রাতে, না সেটি শুক্লপক্ষের রাতই ছিল, বুড়োকে মারধোর করে তার ছেলেরা। দুবলা মানুষ অল্পতেই গুঙিয়ে উঠে। সহ্য করতে পারে না ছেলেদের চড়-থাপড়, মুখ দিয়ে হালকা গাঁজলা বের হতে থাকে। ব্যাপারটা আরো কষ্টের হতে পারত, কিন্তু বুড়োর অনুভূতির গভীরতা ছিলনা।

এরপর থেকে বুড়ো সাবধানে চলতে লাগল। ভিক্ষা করত আরো দুরে, পথ চলতি দূরান্তের অপরিচিত মানুষের কাছে অথবা দূরের কোন গাঁয়ে--কারো বাড়িতে পার্বণে, গোপনে। আজকে এই চমৎকার অপরাহ্নে বুড়ো যাচ্ছে গঞ্জে, খবর পেয়েছে সেখানে বড়ো ঘরের এক মেয়ের বিয়ে। আহ, কতদিন মাংশ খাওয়া হয় না, বুড়ো ভাবে, আর এটা বড়ো ঘরের ব্যাপার। বুড়ো উৎসাহে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।

বড়ো ঘরটি ছিল বেশ দূরে, পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য ডুবে যায় আর কুয়াশার একটা চাদর জমতে থাকে। বুড়ো হাত দুটো ভাঁজ করে পেটের উপর রাখে, এছাড়া তার কোন গরমের কাপড় নেই। বড়ো ঘরটি সেজেছে অনেক আলোর রোশনাইয়ে আর ঝালর কাগজে, একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বড় ঘরের উপযুক্ত জাঁকজমক কাজ হয়েছে, সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো; তারপর তারা বড় ঘরের অনেক প্রশংসা করতে লাগল। বুড়ো বাড়ির পেছন দিকে চলে যায়।

দেখতে পায় রাজ্যের যত মানুষ, তার মতই। আর বাড়ির বাইরের কোণে একপাল কুকুর ঘেঁটে যাচ্ছে নোংরা ময়লা। বুড়ো বেশ দমে যায় কারণ তার কুঁজো দুর্বল শরীর। সবাই অপেক্ষা করতে থাকে বরের জন্য। বড় আসবে সোনালী রথে চড়ে, দেবদূতের মত নামবে আকাশ থেকে।

এইসব স্বর্গমানবদের আপ্যায়নের পরই কেবল ভাবা যেতে পারে নোংরা ভিখিরিদের কথা। জগতের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এটি একটি যথার্থ সুন্দর নিয়ম, যা কারো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়। সোনালী রথটি আসে বেশ অনেক পরে, গভীর রাতে স্থলপথ হয়ে। আকাশের রথটি কেন আসল না এ ব্যাপারে অনেক জ্ঞানের আলোচনা চলতে থাকে, আর সে আলোচনা বড় ঘরের রোশনাইকে আরো বাড়িয়ে দিতে থাকে। বরযাত্রীদের খাওয়া শুরু হয়।

তারা যে খুব ভদ্র আর অভিজাত, তাদের প্রচুর খাবার উচ্ছ্বিষ্ট দেখে আবারো প্রমাণ হয়। উচ্ছ্বিষ্ট খাবার একটি বড় পাত্রে করে নিয়ে যাওয়া হয় ভিখিরি দলের কাছে; মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পড়ে, ভিখিরিদের চাপাচাপি আর কোলাহলে সৃষ্টি হয় ভয়ানক বিশৃঙ্খলা, একজন সভ্য-শিক্ষিত মানুষের মতে নরক গুলজার। ভিখিরিদের আওয়াজ পৌঁছে যায় অভ্যাগতদের কাছে। বর ও কনে পক্ষের তরুণ তরুণিরা এক মনোজ্ঞ বিতর্কে মেতে উঠে, যার বিষয়বস্তু কনেদের এলাকায় ভিখিরি আর বরদের এলাকায় অভিজাত মানুষের বাস। কনের ছিল অনেকগুলি বোন, সুশ্রী আর সেদিন তারা সেজেছিল বেশ; তাই উভয়পক্ষের জন্য এরূপ একটি ঐকমত্যে পৌঁছা কঠিন হয় না যে ভিখিরির দল সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য অভিশাপ এবং এদের জন্য বিশেষ করে নগরীগুলোতে গা বাঁচিয়ে ভদ্রভাবে চলা দায়।

কনেপক্ষের এক যুবক এলাকার সুনাম নষ্ট হওয়ায় ভিখিরির দলকে হুংকার দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ভিখিরির দল ভয় পেয়ে বিশাল বাড়ির এককোণে চুপ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একটু আগে তারা মেতে উঠেছিল কোলাহলে, কিন্তু এখন কেউ আওয়াজ করলে সাথে সাথে অন্যেরা চুপ করিয়ে দিচ্ছে। ফলে ভিখিরি মায়েদের সাথে আসা শিশুদের খাওয়া ও কান্না অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছিল। তারপর আরো পরে অনেক চেষ্টার পর বুড়ো দুইটুকরো উচ্ছ্বিষ্ট মাংশ ও কিছু পোলাও পায়।

আহ, বাঁচা গেল, বুড়ো ভাবে, খুব সহজ ছিল না ব্যাপারটি। তার চোখ চকচক করে, গোগ্রাসে খেতে থাকে খাবার। সীমাহীন ক্ষুধার কাছে এটি যথেষ্ট না, তবু আজকের দিনটা তার ব্যর্থ বলা যাবে না। চাপকল থেকে পানি খেয়ে বুড়ো বেরিয়ে পড়ে বড়ো বাড়ি থেকে। আবারো সেই মেঠো পথ।

আকাশে নবমীর চাঁদ। ম্লান আলোতে ভরে গিয়েছে চরাচর। কবি, কথক আর চিত্রকরগণ ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। দখিন থেকে বইছে ঝিরঝির হাওয়া। বুড়ো হাঁটতে হাঁটতে চমকে তাকায় পেছনে।

দেখতে পায় একটি কুকুর পায়ে পায়ে তার পেছনে এগিয়ে আসছে। বুড়ো খুব ভয় পেয়ে যায়, কিন্তু ভয়টা স্থায়ী হয়না। বহুদিন পর তার হৃদয়ের তন্ত্রীতে হারানো সুর বাজতে থাকে, তীক্ষ্ণ হতে শুরু করে তার অনুভূতি। ধীরে ধীরে কুকুরটাকে মনে হয় খুব আপন, একজন মানুষের মতই। চুকচুক শব্দ করে বুড়ো, আর লেজ নাড়তে নাড়তে কুকুরটি বুড়োর পাশে চলতে থাকে।

সেই নৈশ চরাচরে, চারদিকে জনমানবের সাড়া নেই, বন্ধুর মত হেঁটে যেতে থাকে দুইটি প্রাণী। বুড়োর অবশ্য জানার কারণ নেই লোম উঠা নেড়ি কুকুরটিরও আজকের দিনটি কেটেছে বেশ চমৎকার। সেও দুই টুকরা মাংশ জোগাড় করতে পেরেছে আজ। বড়ো বাড়ির সবল কুকুরদের ভীড়ে একটি লোম উঠা নেড়ি কুকুরের জন্য এটি সহজ ব্যাপার ছিল না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।