আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহ নাকি গনহত্যা। নৃশংসতা হার মানিয়েছে হানাদার বাহিনীকেও, উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধ বিষয়টিকে আড়াল করা



বিডিআরের কিছু উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান বাংলাদেশের ইতিহাসের যে নৃশংসতম ঘটনা ঘটিয়েছে সেটাকে নিন্দা জানানোর কোন ভাষা আমাদের জানা নেই। বুধবার সকালে যখন বিডিআর সদরদপ্তরে গোলাগুলি শুরু হয় তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। প্রথমটায় ভেবেছিলাম এটা হয়তো মহড়া। কিন্তু টানা গুলি চলার পর মনে হলো সামথিং রং। অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম জোয়ানদের বিদ্রোহের কথা।

এরপর সকালের নাস্তা নিয়েই আমি সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটলাম বিডিআর সদরদপ্তরের দিকে। নিউমার্কেটের গেটে গিয়ে গুলির মুখে থামতে হলো। বুধবার সেই সকাল থেকে টানা তিনদিন আমি বিডিআরের চারপাশে। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি। বুধবার আমি যখন ৩ নং গেটে গিয়ে জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলেছি তখন তাদের কথা, চোখে মুখের অভিব্যাক্তি দেখে মনে হয়নি ভেতরে এতো বড় হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে।

তাদের কাছে জানতে চাইলে তারাও বলতে পারেননি ভেতরের হত্যাকাণ্ডের কথা। বেশিরভাগ জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলে ও কয়েকদিনের ঘটনা পর্যবেক্ষন করে আমার মনে হয়েছে, ৩০-৩৫ জনের একটি দল (বেশিও হতে পারে) পুরো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারাই নৃশংসভাবে গুলি করে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেছে সেনা কর্মকর্তাদের। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বেশিরভাগ জওয়ানদেরই কিছু জানানো হয়নি। তাদের বলা হয়েছে এটা বিদ্রোহ।

তারাও সেটি বিশ্বাস করে বিদ্রোহ চালিয়ে গেছে। অন্যদিকে এই গ্রুপটি যারা বিদ্রোহের নামে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাদের পেছনে নিশ্চয়ই কারো ইন্ধন ছিলো এবং পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত। কেবল দাবি আদায়ের জন্য বিদ্রোহ হলে তারা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখতে পারতো, তাতে তারা বরং দাবি আদায়ের জন্য আরো কিছু সময় পেতো। কিন্তু তা না করে ঘটনার পর পরই যেভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে একটি বিষয় পরিস্কার এই দলটি কোন বিদ্রোহ নয়, স্রেফ হত্যাকাণ্ড চালাতেই এসব করেছে। তারাই বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে নির্যাতন চালিছে নারী ও শিশুদের।

পুড়িয়ে মেরেছে নিরস্ত্র মানুষকে। যেভাবে এই হত্যকাণ্ড চালানো হয়েছে সেটি ৭১-এ হানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে। জীবন্ত মানুষকে পুড়েয়ে মারা, নারী নির্যাতন, নির্বিচারে হত্যা করা, মৃতদেহগুলোকে নগ্ন করে ম্যানহোলে ফেরে দেওয়া এসব কোন বিদ্রেহের কথা বলে না। আর তাই সাধারন ক্ষমা ঘোষনা করার পরেওই এই গ্রুপটি অস্ত্র সমপর্ন করেনি। তারা বরং ব্যস্ত ছিলো লাশগুলোকে আড়াল করতে, গনকবর দিতে।

একাত্তরে এভাবেই হানাদার বাহিনী এই দেশের মাটিতে বাঙ্গালিদের গনকবর দিয়েছিলো হত্যা করে। আমার কাছে মনে হয়, বেশিরভাগ জওয়ান এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়,কাজেই তাদের শাস্তি না দিয়ে কারা সেদিন মূল ঘটনা ঘটিয়েছিলো সেটি খুঁজে বের করা দরকার। এরপর তাদের কাছ থেকে জানা উচিত সেদিন কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছিলো। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, জামায়াতসহ প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী বারবার বলে আসছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে চাইলে দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। আমার কাছে মনে হয় সারাদেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্বে মামলা, গ্রেপ্তার এসব প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো।

আমার এই সন্দেহ ভুল হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু কেন যেন বেশিরভাগ সময়েই আমি খুশি হতে পারি না। সেদিন কয়েকজন জওয়ান যেই হত্যাকাণ্ড চালাল তারা কাদের হত্যা করলো। তারা তো আমাদেরই স্বজন। সারা দেশে আজ যে কান্নার রোল সেই কান্নার শেষ কোথায়? প্রতিদিন সকালে এই পরিবারের ঘুম ভাঙ্গবে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে।

যেসব কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেককে আমি ব্যাক্তিগতভাবে চিনি। সেনাবাহিনীতে হয়তো খারাপ কর্মকর্তাও আছে, কিন্তু মারা যাওয়াদের মধ্যে এমন অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন যারা দেশের জন্য সারাজীব্ন কাজ করেছেন। এদের একজন মেজর আজহার। খুলনা বিডিআরের ২৩ রাইফেল ব্যাটেলিয়নের উপ-অধিনায়ক এই মানুষটি দীর্ঘদিন ছিলেন টেকনাফে। সার পাচারকারীদের ধরতে তিনি রাতের পর রাত সাগরে কাটিয়েছেন।

যুদ্ধ করেছেন নাসাকা বাহিনীর সঙ্গে। কর্নেল গুলজার। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে তিনি ছিলেন সাহসী এক নাম। এমন অসংখ্য কর্মকর্তাদের কথা বলা যাবে। এমন দক্ষ কর্মকর্তাদের আমরা আর কখনোই ফিরে পাবো না।

যে ক্ষতি হয়ে গেলো আমাদের সেটি পূরনে কতোদিন লাগবে কে জানে? আর একটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। বিডিআরের জোয়ানেদর কিছু দাবি হয়তো ন্যায্য ছিল। এমন কিছু দাবি হয়তো বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত অন্যান্য সৈনিকদেরও রয়েছে। তাদের সেসব দাবিও বিবেচনা করা উচিত। তবে যারা এই হত্যকাণ্ড বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টানমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার।

তবে অযথা যেন কাউকে হয়রানি না করা হয় সেটিও মনে রাখতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।