আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'একটি দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিস্স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে'



'একটি দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিস্স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে' ইংরেজি দৈনিক নিউএজের ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সংখ্যার শেষ পাতায় প্রতিবেদক দিলশাদ হোসেন আক্ষেপ করে 'একটি দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিস্স্মৃতির গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে' শিরোনামে লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা তো জানেই না (তাদের কেউ কেউ '৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে কারা শহীদ হয়েছিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে ভালোবাসার প্রতীক ভ্যালেন্টাইনের আত্মোৎসর্গের কথা তুলে ধরেছে), এমনকি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র অভ্যুত্থান ও শহীদদের কথা বলতে পারেননি। কী ঘটেছিল সেদিন? ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তদানীন্তন সেনাপ্রধান লে. জে. হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। অবৈধ ক্ষমতা দখলের প্রথম প্রহরেই ছাত্রসমাজ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় ক্ষমতা জবরদখলকারী এরশাদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন থেকে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, জাসদ- ছাত্রলীগ (মুনীর-হাসিব) ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় সামরিক শাসনবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

১৯৮২ সালের ৮ নভেম্বর ছাত্রলীগ (মুনীর-হাসিব) আয়োজিত মিছিলে পুলিশ হামলা করলে সব ছাত্র সংগঠনের মিলিত প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ম্বে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে। মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্র বন্দিদের মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রসমাজ সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে যাত্রা শুরু করে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীরা। কার্জন হল ও শিক্ষা ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলটি পৌঁছামাত্রই অপেক্ষমাণ পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় ছাত্রছাত্রীদের ওপর।

শহীদ হন জয়নাল, জাফর, দীপালী সাহাসহ অনেক নাম না জানা ছাত্রছাত্রী। বিকেলে বটতলায় শহীদ জয়নালের জানাজা শুরু হওয়ার মুহৃর্তে হাজার হাজার পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী পুরো ক্যাম্পাস ঘেরাও করে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর নজিরবিহীন বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্যাতনে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী পঙ্গুত্ম্ব বরণ করে এবং হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করে সেনানিবাস ও বিডিআর সদর দফতরের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। আন্দোলন দমনের জন্য সামরিক জান্ত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে কারফিউ জারি ও গণগ্রেফতার চালালেও ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে রাজপথে নেমে পড়ে। হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ হরতাল আহ্বান করে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। এদিন শহীদ হন চট্টগ্রামে মোজাম্মেল কাঞ্চন, ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের মোজাম্মেল আইউবসহ আরো অনেক নাম না জানা ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রনেতাদের মধ্যে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন খ ম জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম নোমান, আশরাফুল হক মুকুল, লেনিন আজাদ, জালাল আহমেদ, শামসুজ্জামান দুদু প্রমুখ। এমনকি মধুর কেন্টিনের শহীদ মধুদার ছেলে অরুণকেও হামলাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে চরম নির্যাতন চালায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি '৮৩ পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যা-নির্যাতন উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে আসে।

পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, তিতুমীর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হল-হোস্টেল ঘেরাও করে হাজার হাজার ছাত্রকে পাইকারি গ্রেফতার করে বেইলী রোড, হেয়ার রোডের সামরিক আদালত প্রাঙ্গণে জমা করে। গ্রেফতারের সময় ও পরে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা চালায় চরম নির্যাতন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রনেতা বাকীসহ অনেক ছাত্রের চোখ ল্ক্ষ্য করে বাহিনীর সদস্যরা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ নষ্ট করার চেষ্টা করে। বাকী ভাইয়ের চোখ বেঁচে গেলেও অনেকের চোখ এতে স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। হাত-পা তো অনেকেরই ভেঙেছে।

খ ম জাহাঙ্গীরসহ যাদের সামরিক বাহিনীর বন্দিখানায় ও সামরিক গোয়েন্দা দফতরের 'সেইফ হোল নামক অন্ধকূপে আটকে রাখা হয়েছিল তাদের এমন চরম নির্যাতন করা হয় যে, গুজব ওঠে জাসদ-ছাত্রলীগ নেতা মুশতাক হোসেন (ডাকসু জিএস)কে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের ছাত্র অভ্যুত্থানের মতো আরেকটি ছাত্র অভ্যুত্থান ঘটে ২০০৭-এর আগষ্টের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ গোটা দেশে। এবারো ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে অগণতান্ত্রিক শাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তবে এবার কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও সামরিক বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা। আগষ্ট বিক্ষোভের অনন্য দিক ছিল ছাত্র নেতৃত্বের শিক্ষক সমাজের পাশে দাঁড়ানো।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের নীরবতার মুখে শিক সমাজের ভূমিকা গণতন্ত্রকামী মানুষকে আশান্বিত করেছে। জেনারেল জিয়ার শাসনামলেও সামরিক বাহিনী ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের চরম নির্যাতন করে। তবে ২০০৭-০৮ সালে সামরিক নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এ সময় বন্দিদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্ত্রী-সন্তান এমনকি নাবালক সন্তানদেরও বন্দি করা হয় এবং তাদের জিম্মি করে, নিরাপত্তার হুমকি দিয়ে বন্দিদের শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গে সঙ্গে চরম মানসিক নির্যাতনও করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় না বলে পারছি না।

আশির দশকে যে নেতৃত্ব সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন লড়াকু, তাদের কেউ কেউ ২০০৭-০৮ সময়সীমায় নির্যাতনকারী রাষ্ট্রশক্তির মাঝে 'ইতিবাচক' উপাদান খুঁজে পেয়েছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.