আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুক্তি নিয়ে আগে খোলামেলা আলোচনা জরুরী

ভাবনার কথা

ট্রানজিট বা টিফা নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকেই অনেক বেশি সক্রিয় মনে হচ্ছে। পররাষ্ট্র সচিব বলছেন অনেক রেখে ঢেকে- না, গোপনে দেশের স্বার্থবিরোধী কোন চুক্তি আমরা করব না। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী যেভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন- অবশ্যই এই চুক্তি হবে- তেমনটা আর কেউই বলেন না। দারুন প্রত্যয় নিয়ে তিনি বললেন, চুক্তি হবে; কেবল মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। দেশীয় ‘এক্সপার্টদের’ কাছে যাওয়ার কথা একবার উল্লেখ করলেও তাদের মতামত যদি চুক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক হয় তাহলে কি করবেন সেটা তিনি বলেননি।

বলার দরকারও বোধহয় নেই। কারণ যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েই নিয়েই রাখা আছে সেটা নিয়ে আর আলোচনার কি আছে! জনগণের সামনে চুক্তি প্রকাশেও তিনি আগ্রহী নন। কিন্তু বলছেন, গোপনে নাকি কিছু করবেন না। বাংলাদেশের জন্য এরকম ঘটনা মোটেও নতুন নয়। অতীতে এমন বহু চুক্তি হয়েছে জনগণকে অবহিত করার কোন রকম প্রয়োজন বোধ না করে; দেশের বিশেষজ্ঞদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে।

এই আচরণের মধ্যে প্রকাশ পায় সরকারি দলের আত্মবিশ্বাস আর সিদ্ধান্তে দৃঢ়তার মনোভাব। এ মনোভাব যদি দেখা যেত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, নিজেদের দলের সন্ত্রাসীদের দমনের ক্ষেত্রে, এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে তাহলে আরও ভাল লাগত। কিন্তু ‘দূর্ভাগ্যজনকভাবে’ এ মনোভাব সব জায়গায় দেখা যায় না; দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে টিফা চুক্তি করায় মরীয়া আচরণের ক্ষেত্রে। মন্ত্রী যদি ভেবে দেখেন, তার এ মরীয়া আচরণটা কেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তাহলে হয়ত আরেকটু সংযত হতে পারেন। যদি বলা হয় এ ধরণের চুক্তিগুলোকে আমরা দূর্ভাগ্যজনকভাবে স্পর্শকাতর করে ফেলেছি সেটা আরেকটি দুঃখজনক মন্তব্য হয়।

বাণিজ্যমন্ত্রীই এ দুঃখজনক কথাটি বলে ফেললেন। এখানে ‘আমরা’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বাংলাদেশ পক্ষকে। পেছনের দিকে তাকিয়ে যদি এ মন্তব্যের পক্ষে যুক্তি খুঁজি তাহলে মুশকিলে পড়তে হয়। বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে দেশের জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধান আর উত্তোলন নিয়ে যত চুক্তি হয়েছিল একটাও দেশের জনগণ জানতে পারেনি। তারপরে দেখা গেল, সে এমনই চুক্তি যাতে বিদেশী কোম্পানি জ্বালানি তুলে ৮০ ভাগ এর মালিকানা পারে আর বাকি ২০ ভাগ দিয়েও আমাদেরই সাথে ব্যবসা করবে।

তাদের ভুলের কারণে আমাদের খনি চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেলেও এক টাকাও ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাবে না। আমেরিকার সাথেই ১৯৮৬ সালে এমন চুক্তি করে রাখা হয়েছে যাতে আমাদের দেশে তাদের অবাধ বাণিজ্য অধিকার থাকবে কিন্তু তাদের দেশের নির্দিষ্ট খাত সংরক্ষিত থাকবে। ভারতের সাথে করা চুক্তি অনুযায়ী আমাদের পদ্মায় পানি পাওয়া যায়নি, ফারাক্কা বা সীমান্ত বিরোধের কোন সুরাহা হয়নি। অতীতের এমন অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা যায় যেগুলো বোধ করি স্পর্শকাতরতা তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। বিএনপিসহ বিগত সরকারি দলের লোকজনকেও দেখা যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে চুক্তি করার বিরুদ্ধে কথা বলছে।

তাদেরও দেখা যাচ্ছে চুক্তি নিয়ে অনেক আশংকা রয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল তারা মতায় থাকার সময়েই টিফা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে তিন দফা বৈঠকও হয়ে গিয়েছিল। শেষ বৈঠকে তো চুক্তি চূড়ান্তই হয়ে যাচ্ছিল। সে সময় তারা জনগণকে কিছু জানিয়েছেন সেরকম কোন নজির নেই। বরং তারা যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই বর্তমান সরকার ধরেছে।

অবশ্য এটাও ঠিক বিএনপি টিফা চুক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। তারা শুধু তাড়াহুড়োর বিপক্ষে আর সোচ্চার কেবল ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া প্রসঙ্গে। ভারতের ট্রানজিট চুক্তির প্রস্তাব অবশ্য অনেক পুরনো। আওয়ামী লীগের এর আগের মেয়াদের সরকারের আমলেই এ নিয়ে কথাবার্তা এগিয়েছে জোরে সোরে। তার পরে হঠাৎ করেই আলোচনা ঝুলে গেল।

তার কারণ অবশ্যই দেশের ভেতর এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সমালোচনা-আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলন বিএনপিও করেছিল কিন্তু এর পরে তারা মতায় এস পাঁচ বছরে কখনো স্পষ্ট করে বলেনি, ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে তারা ভারতের সাথে চুক্তি করবে কি করবে না। ভারত তার খসড়া চূক্তির প্রস্তাব পাঠিয়েছে ২০০৭ এর আগস্টে। যে কোন চুক্তির শর্ত যদি কাল সমস্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করে দেন তাহলে ক্ষতিটা কার হবে? দৃশ্যত কারও কোন ক্ষতি দেখা যাচ্ছে না। টিফা চুক্তি নিয়ে তিন দফা আলোচনা শেষে এখন চতুর্থ দফায় এটা চূড়ান্ত করতে যাচ্ছেন।

আমেরিকান কর্তৃপকে যদি বলা হয়, ‘একটু অপেক্ষা করেন। আমাদের দেশের জনগণ এখনও জানে না এ চুক্তিতে তাদের কি লাভ হতে যাচ্ছে বা কি ঝুঁকি থাকছে। আগে তাদের জানাই। নির্বাচনে আমাদের প্রতিশ্র“তি ছিল স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার। আগের কোন সরকার সেটা করেনি।

আমরা এটা করতে চাই। আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে বৈঠক করি, পত্রিকায়-ইন্টারনেটে বা অন্য মাধ্যমে জনগণের মতামত নিই। তারপরে সংসদে আলোচনা করি। এর পরে আপনাদের সাথে বৈঠকে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। ’ এটা শুনলে কি আমেরিকান কর্তৃপক্ষ কি অনেক রুষ্ট হবে! হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ দেখা যাচ্ছে না।

একই কথা প্রযোজ্য ভারতের ক্ষেত্রে ট্রানজিট চুক্তি সম্পর্কে। এবং এমন একটা খোলামেলা পরিবেশে যদি দেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হয় তাহলে একটা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেয়া যায়। কিন্তু এটা করার কোন রকম আগ্রহ না দেখিয়ে ‘চুক্তি করতেই হবে, এটা ভাল’ বলে অতীতের ধারাবাহিকতা টানার মধ্যে তো কোন কৃতিত্ব নেই। চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে এদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ কথা বলেছেন, বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। অনেকেই সমালোচনা করেছেন টিফা ও ট্রানজিট চুক্তির।

যারা বলেছেন তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জেনে শুনে বলেছেন। এখন তাদের মতামত গ্রহণ করা হবে কি হবে না সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু বিবেচনায় তো নেয়া যেতে পারে! অন্তত খোলা মঞ্চে তাদের যুক্তি খন্ডন করতে পারে, যদি সত্যিই চুক্তিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে সরকার আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.