আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৃতীয় ব্যক্তি

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। তৃতীয় ব্যক্তি মোহাম্মদ ইসহাক খান পার্কটা অনেক জায়গা নিয়ে। অনেক পার্ক আছে, কয়েক বর্গফুট জায়গায় গাছ লাগিয়ে আর গোটাকয়েক বেঞ্চ বসিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে, এখানে তেমন নয়।

চারিদিকে যতদূর দেখা যায়, ততটা জায়গাই পার্কের। বোঝাই যাচ্ছে, এটা অনেক পুরনো জায়গা, এবং অনেক যত্ন নিয়ে বানানো হয়েছে। গাছপালার সংখ্যা নেই। ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ছায়াবতী বিশাল সব বৃক্ষ। সব মিলিয়ে একটা শান্তিময় পরিবেশ।

মানুষ এখানে আসে একটু শীতলতা আর নীরবতার জন্য। কপোত-কপোতীদের জন্যও জায়গাটা আদর্শ। ছায়াঢাকা বেঞ্চে তারা পাশাপাশি বসে, হাতে হাত এবং চোখে চোখ রেখে, একজন আরেকজনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে, একজনের কাঁধের ওপর আরেকজন মাথা রেখে গল্প করতে করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়। আপত্তিকর কিছু দৃশ্যের অবতারণা যে হয় না তা নয়। সেসব দেখলে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়।

মানুষটি বসে আছে একটা বেঞ্চে। গাছের পাতা কয়েকটা পড়ে ছিল বেঞ্চের ওপরে, সে সরিয়ে দিয়েছে। বেঞ্চের কাঠ অনেক পুরনো, একটা ভেজা ভেজা গন্ধ আসছে। সে এখন তাকিয়ে আছে সোজাসুজি, অনেকটা দূরে আরেকটা বেঞ্চের দিকে। ওখানে বসে আছে এক যুগল।

মেয়েটাই কথা বলছে, হাত নেড়ে নেড়ে। নিশ্চয়ই হাসির কিছু হবে, নিজেই একটু পর পর হেসে গড়িয়ে পড়ছে। অবশ্য তেমন হাসির কথা না-ও হতে পারে। তরুণী মেয়েদের অনেকগুলো অভ্যাসের মধ্যে একটি হল নিজের কথায় নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়া। একজন তরুণী মেয়ে যখন কৌতুক বলে, তখন অন্য সবার আগে সে নিজে হেসে ফেলে, এবং হাসির দমকে কৌতুকটি শেষ করতে পারে না।

ছেলেটি তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, কিছু বলছে না। হাসিমুখে দেখছে গোলগাল মেয়েটির হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলা। অনেক দূর থেকেও মানুষটি দেখতে পাচ্ছে ছেলেটির মুখের এক পাশ, তাই হাসিটিও দেখতে পাচ্ছে। ছেলেটি আনন্দিত। প্রিয়জনের মুখের হাসি দেখার মধ্যে আনন্দ আছে।

মানুষটি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ওরা ওদের মতো থাকুক, আনন্দ করুক। তার চোখ পড়লো নিজের পাশে। জায়গাটা খালি। আহা, এখানে তো কেউ একজন থাকতে পারতো, ঐ বেঞ্চটার মতোই।

কিন্তু খালি জায়গাটা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ পড়েছে জায়গাটার ওপর, যেন উজ্জ্বল হয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, এই দ্যাখো, তোমার পাশের জায়গাটা খালি। মানুষটির বুক ভেঙে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু সে গোপন করলো। এতবড় দীর্ঘশ্বাস ফেলার শক্তি তার নেই। *** ট্রেনের বগিটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

বিকট আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছে না। বিকট আওয়াজের উৎস দুটি। এক, ট্রেনের ইঞ্জিনের আওয়াজ। দুই, একঝাঁক তরুণ-তরুণীর হৈচৈ। তারা পিকনিকে যাচ্ছে।

গন্তব্য কক্সবাজার, পিকনিকের জন্য দূরে কোথাও যেতে হলে সবাই যে জায়গাটার নাম সবার আগে বলে। তারা চট্টগ্রামে পতেঙ্গা দেখবে, কক্সবাজার সৈকতে নেমে পানি ছিটিয়ে সবাই সবাইকে ভেজাবে, টেকনাফ যাবে, সেন্টমার্টিন গিয়ে নীল পানি দেখবে। অনেক প্ল্যান তাদের, কারো খুশির অন্ত নেই। আনন্দিত মানুষজন চুপচাপ বসে থাকতে পারে না, আনন্দের ধর্মই হল নিজেকে প্রকাশ করা। তাই তারা যাত্রার শুরু থেকেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, বেসুরো গলায় গান গাইছে, আনাড়ি ভঙ্গীতে পরিচিত "ধুমধাড়াক্কা" গানের সাথে নাচানাচি করছে।

তাদের চিৎকারের চোটে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এখুনি ট্রেনের বগিটা আলাদা হয়ে যাবে, কিংবা ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যাবে! বাইরের কেউ দেখলে ভেবে বসতে পারে এখানে ভীষণ মারামারি চলছে! শহুরে ছেলেমেয়ে তারা, ইট-কাঠের খাঁচা ছেড়ে বাইরে যাবার সুযোগ বড় একটা হয় না, কাজেই একটা ফুরসৎ পেলে তারা জান দিয়ে পড়ে, পুরোটা নিংড়ে নিতে চায়, একটুও মিস করতে চায় না। হই-হুল্লোড় আর হাসি-আমোদে ভরা বগির কোণায় চুপচাপ বসে ছিল মানুষটি। খুব আক্ষেপ হচ্ছিল তার, সবাই কত আনন্দ করছে, সে কিছু করতে পারছে না। তার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে, উঠে গিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বলে, আমি তোমাদের সাথে একটু গান গাই? একটু হৈচৈ করি? ভাবতে ভাবতে তার মাথা আরও নিচু হয়ে এলো। সে জানে, এটা পারবে না, কখনোই পারবে না।

ভীষণ লজ্জা করে তার। কেন যেন মনে হয়, সে মুখ খুললেই সবাই হেসে উঠবে, বিদ্রূপাত্মক কোন মন্তব্য ছুঁড়ে দেবে, যেটা সে সহ্য করতে পারবে না। কেন সে সবসময় একা, কেন সবসময় সে তৃতীয় ব্যক্তি হয়েই থাকে; কেন তাকে শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয়, কেন কখনো "সক্রিয় ভূমিকায়" আসতে পারে না - এই ভেবে ভেবে তোলপাড় করে ফেলেছে, কোন কিনারা করতে পারে নি। তার মতো কয়েকজন সবখানেই থাকে, তারা বড় হতভাগ্য। তারা সবার মধ্যেই থাকে, কিন্তু তবুও সবার থেকে আলাদা, বিচ্ছিন্ন।

তারা তৃতীয় ব্যক্তি। কেন একা থাকার নিয়তি নিয়ে তারা এসেছে, জানে না। ভীষণ ইচ্ছে করে তাদের, মানুষের সাথে মিশতে, সাধারণ মানুষগুলোর মতোই জীবনকে উপভোগ করতে, উঁচু গলায় হাসতে, ভীষণভাবে আবেগ প্রকাশ করতে। কিন্তু পারে না। দিনের পর দিন বুকের ভেতরের বোঝা ভারী হতে থাকে, আর তারা ছটফট করতে থাকে।

নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার কষ্ট বড় ভয়ংকর। (২৬ মে, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।