আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহার তৃতীয় পদ

আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।

২১ জুলাই, ২০১০। প্রৌঢ় দুজন আমার অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকলেন যখন, তখন শেষ বিকেলের শুরু। এসময়টা কাজ কম থাকে।

তাই বসে বসে নির্মলেন্দু গুণের ভ্রমণকাহিনী পড়ছিলাম। উনাদের দেখে বইটা ভাঁজ করে রেখে সালাম দিলাম। একজনকে ক্লান্ত মনে হল খুব। একটা পা নেই। অথচ ক্রাচে ভর করে তিনি এই ক্লান্তিতেও যে প্রত্যয় নিয়ে ঢুকলেন, আমি হলফ করে বলতে পারি-অনেক দু'পেয়ে মানুষেরই আমি এর থেকে ঢের কম আত্মবিশ্বাস দেখেছি।

আমি একটু প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছু জিগ্যেস করার আগেই একজন বললেন, -ভাতিজা, তোমার এখানে একটু বসতে পারি? আমরা দুই বন্ধুই খুব ক্লান্ত। -আমি সম্মতি জানালাম, 'অবশ্যই'। -'কি নাম তোমার? তুমি করে বললাম, কিছু মনে করোনা। তুমি আমার থেকে অনেক ছোট।

আর তোমাদের এ যুগের ফর্মালিটি আমার ভালো লাগেনা। আন্তরিকতা থেকে ডেকেছি, অবজ্ঞা থেকে নয়। ' খুব সুন্দর করে কথাগুলো বললেন তিনি। আর শেষের কথাটুকু না বললেও আমি বুঝতাম উনার আন্তরিকতাটুকু। মানুষ আর কিছু বুঝুক আর না বুঝুক, অন্তত আন্তরিকতা আর অবজ্ঞা খুব সহজেই বুঝতে পারে।

হয়তো সিক্সথ সেন্সের একটা বড় ভূমিকা আছে এতে। সে যাই হোক, উনার কথাগুলো মনযোগ কাড়ার মত। আমি আমার নাম, পরিচয় বললাম। তারপর বললাম, 'চা খাবেন?' প্রশ্নটা দুজনকেই করেছি। জবাব দুজনেই দিলেন, অথচ আমি শুনলাম একটা।

অদ্ভুত কোরাস! -'হ্যাঁ। কিন্তু চিনি ছাড়া। চা চলে এল। এর ফাঁকে উনারা নিজেদের নাম বললেন। আমার বাড়ি কোথায়, এখানে কতদিন চাকরি করছি...ইত্যাদি সামাজিক আলাপ।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দ্বিতীয় জন প্রথম মুখ খুললেন। -'বাবা, তোমাকে ডিস্টার্ব করছি নাতো! আমরা বৃদ্ধ মানুষ। বেকার। তার মধ্যে আবার একটা পা নেই। ' -'লেংড়া বাবা', প্রথমজন ফোড়ন কাটলেন।

-'দুই পা নিয়ে মনে হয় তুই আমার থেকে ১০ বছর বেশি বাঁচবি! ব্যাটা পেসমেকার! আমি বেশ উপভোগ করছি এই দুই প্রৌঢ়ের খুনসুটি। মিটিমিটি হাসছি। উনারা একটু থামতেই আমি কৌতুহল বশতঃ জিগ্যেস করলাম, -'আপনার পায়ে কি হয়েছিল? এ্যাকসিডেন্ট?' -'না বাবা, গুলি লেগেছিল'। -'কিভাবে?' উত্তর দিলেন দ্বিতীয়জনঃ ৭১ সালে আমরা খুব দুষ্ট ছিলাম তো, তাই যুদ্ধে গিয়েছিলাম। ও হারালো পা, আর আমি হারালাম হার্ট।

আমার হার্টে পেসমেকার লাগানো। ' দুজন হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি হতভম্ব হয়ে বসে আছি। এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদেঁর দেখলেই আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়! ভাবি, আমরা কত সৌভাগ্যবান। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়তো এঁদের স্বচক্ষে দেখার সুযোগই পাবেনা; আমরা যেমন কখনো দেখিনি একজন ভাষাবিপ্লবীকেও।

আর আমার সামনে বসে আছেন জ্বলজ্যান্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধাহত। আমি বললাম, 'চাচা, আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা'। -'নাম কি তোমার বাবার?' -'রুনু, কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিল। বিচ্ছুরা উনাকে 'গুঠু' বলে ডাকতো।

' -'রুনু, মানে তেলেঙ্গাপাড়া অপারেশনে যে ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছিল?' দ্বিতীয়জন বললেন, 'পিচ্চি রুনু'। -আমি বললাম, চেনেন? -'চিনবনা মানে? এখনো কথা হয় মাঝে মাঝে। তোমার আব্বার যুদ্ধের গল্প আমরাই অনেক ভালো বলতে পারব। ' সত্যি বলতে কি, গর্বে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। 'আমি বললাম, চাচা যুদ্ধের গল্প শোনাবেন?' -'আজ নারে বাবা।

পরিচয় যখন হল, অবশ্যই শোনাব। আজকে তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি। আর না। ' -চাচা, আপনারা যুদ্ধ করেছিলেন বলেই তো স্বাধীন দেশে বুক ফুলিয়ে চাকরী করছি। ডিস্টার্ব করার কথা কেন বলছেন? চাঁদ-তারার পতাকার চেয়ে আমাদের পতাকাটা অনেক সুন্দর।

আপনারা না থাকলে, পরাধীন দেশে মাথা নিচু করে থাকতে হত। সেটা কি ভালো হত?' এক নিঃশ্বাসে বললাম কথা গুলো। কিভাবে বললাম জানিনা, কিন্তু এটুকু জানি, এটা আমার একান্ত অনুভূতির কথা-হয়তো এতোদিন অনুক্ত ছিলো বলেই আজ সুযোগ পেয়ে মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল। দ্বিতীয় জনের গলাটা একটু আর্দ্র মনে হল। বললেন, 'তোমার কথাটা শুনে মনটা ভরে গেলো বাবা।

এই স্বীকৃতিটুকুই দেহের পঙ্গুত্বকে আড়াল করে দেয়। মনে হয়, আমরা যাদের জন্য যুদ্ধ করেছি, তোমরাই সেই ছেলে। অনেক বড় হও বাবা। আশীর্বাদ করি। ' চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন দুজনেই।

আমিও দাঁড়ালাম। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে গেছে। খুব সামান্য সময় কাছে থেকে, এই অসামান্য মানুষ দু'জন আমাকে যা দিয়ে গেছেন, তার হিসাব টাকা-আনা-পাই দিয়ে হয়না। হৃদয় দিয়ে হয়। অনুভূতি দিয়ে হয়।

তিনি অভ্যস্ত হাতে ক্রাচ নিয়ে দাঁড়ালেন। এতোই সাবলীল, আমার মনে হচ্ছিল; যে মাটির জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন, সেই মাটিই যেন অদৃশ্যভাবে উনার হারানো পা'র দায়িত্ব নিয়েছে। মানুষের পক্ষে প্রতারণা করা সম্ভব, কিন্তু মাটি কখনো এই সূর্যসন্তানদেঁর সাথে প্রতারণা করবেনা। কক্ষনো না। জীবিতাবস্থায় আগলে রাখবে, আর জীবনাবসানে পরম মমতায় টেনে নেবে নিজের কোলে।

তিনি হাত বাড়ালেন ফৌজী স্টাইলে। হাত মেলালেন আমার সাথে। তারপর প্রথম জনও। ষাটোর্ধ্ব এই দুজন মুক্তিযোদ্ধার হাতের প্রত্যয় আমাকে দেখালো একাত্তুরের সেই জোয়ানদের। এখনো হাতে অসুরের মত শক্তি।

দৃঢ়। প্রত্যয়ী। উনাদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যুদ্ধের সারথী দুজন-যারা নিজেদের অঙ্গের বিনিময়ে এই পতাকা-মাটি আমাদের করে দিয়েছেন। উনারা হেঁটে যাচ্ছেন দুই হিন্দু-মুসলমান। কিসের হিন্দু-মুসলমান? উনারা মুক্তিযোদ্ধা।

এটাই উনাদের পরিচয়। আজ আমরা স্বার্থপরের দল দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ছি, তর্ক-মারামারি করছি, অথচ উনাদের মধ্যে আজো অটুট রয়েছে সেই সৌহার্দ্য, যা ছিল সেই ৩৯ বছর আগে। আমরা বড় বেশি অকৃতজ্ঞ। উনাদের কাছে এখনো আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। অন্তত মানুষ হবার শিক্ষাটা আমরা এখনো নেয়া বাকী।

উনাদের দুজনের প্রত্যয়ী প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল সেই পুরানো কথাটাঃ 'অস্ত্র জমা দিছি, ট্রেনিং জমা দেইনাই'! হে বাংলার সূর্য সন্তানেরা, তোমাদের না জমা দেয়া ট্রেনিংটা আজ আমাদের খুব প্রয়োজন! আমরা বড্ড কাপুরুষ হয়ে পড়ছি দিনদিন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।