আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচীন মিশরের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া এক রানী হাটসেপসুটস

পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
রানী হাটসেপসুটস সাত হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশর ভ্রমন আমার সারা জীবনের একটি স্বপ্ন ছিল। ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন বইতে পড়া সেই নীল নদ, প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য্যের মধ্যে দুনিয়ার বুকে আজ পর্যন্ত টিকে থাকা সেই রহস্যময় পিরামিড, যার ভেতরে ফারাওদের মমি আর তাদের অভিশাপ নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনার ডানা মেলা কাহিনী, বিখ্যাত ফারাও র‌্যামেসিস, আমেনহোটেপ, টুটেনখামুন এর বৈচিত্রময় জীবন, সেই দেশ যেখানে আজ তক সারা বিশ্বে আদর্শ বিশ্বসুন্দরীর প্রতীক হিসেবে চিনহিত রানী ক্লিওপেট্রা। রোমান সেনাপতি মার্ক এন্টনীর উন্মাদনাময় জগতবিখ্যাত কিন্ত ইতিহাস কুখ্যাত তার প্রেমকাহিনী। এছাড়াও আছে সেই প্রাচীন মিশরীয় দেব-দেবীদের নিয়ে কত পৌরানিক উপাখ্যান, কত ঐতিহাসিক কাহিনী পরতে পরতে গাথা আছে বুরুন্ডি থেকে আনুমানিক ৬,৬৯৫ কিলোমিটার পথ দুরন্ত বেগে পাড়ি দিয়ে আসা নদ নীলের বুকে, তার খবর আমরা কজনই বা রাখি! আজ আর কারো গল্প নয় আজ আমার এই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু একজনকে ঘিরেই, আর তিনি হলেন সেই অনেকের চেনা না চেনার এক রানী হাটসেপসুটস। বিখ্যাত দের এল বাহারীর মন্দিরের পিলারের সাথে রানীর সারিবব্ধ মুর্তি প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে ফারাওদের রাজত্বকালগুলো বিভিন্ন রাজবংশের শাসনে ভাগ করা।

সে ইতিহাসের আঠারোতম রাজবংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম টুথমিস । খৃষ্টপুর্ব ১৫০৮ অব্দে তার ঔরষে প্রধান মহিষী আহমেস এর কোল আলো করে পৃথিবীতে আসেন তাদের কন্যা হাসেপসুটস। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী এই কন্যাটি ছিল রাজার সবচেয়ে প্রিয়। রাজমহিষী আহমেসের গর্ভজাত দুই ছেলে যারা টুথমিসের রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন তারা দুজনই রাজার জীবিত অবস্থায় অল্প বয়সে মারা যায়। ফলে ভগ্নস্বাস্থ্য টুথমিস রাজকাজে সাহায্যের জন্য তার প্রিয় কন্যা হাটসেপসুটসকে বেছে নেন।

তিনি মনে প্রানে চাইতেন তার এই বুদ্ধিমতী কন্যাটি দেশের হাল ধরুক। কিন্ত সে সময় মিশরে নিয়ম ছিল কোন মহিলা এককভাবে সিংহাসনে বসতে পারবে না, যা আমরা পরবর্তীতে রানী ক্লিওপেট্রার সময়ও দেখেছি। রাজা প্রথম টুথমিস ফলে রাজা প্রথম টুথমিস তার রাজত্বের প্রায় শেষ দিকেএসে তার রক্ষিতা মূটনেফার্টের গর্ভজাত ২১ বছর বয়সী পুত্র ২য় টুথমিসের হাতে চব্বিশ বছর বয়সী কন্যা হাটসেপসুটসকে সম্প্রদান করতে বাধ্য হন। সাধারন রমনীর ঘরে জন্ম নেয়া ২য় টুথমিসেরও এছাড়া আর কোনভাবেই সিঙ্গহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়া সম্ভব ছিলনা। এর ফলে কন্যা হাটসেপসুটের রানী হওয়া যেমন নিশ্চিত হলো সেই সাথে নীলরক্তবিহীন দ্বীতিয় টুথমিসও সিংহাসনে বসার অধিকারী হলো।

এর দশ সপ্তাহ পরে রাজা মারা গেলে দ্বীতিয় টুথমিস তার তার তিন বছরের বড় সৎ বোন তথা স্ত্রী হাটসেপসুটের সাথে যৌথ ভাবে মিশরের সিংহাসনে আরোহন করেন। দ্বীতিয় টুথমিস শারিরীক ভাবে পিতার চেয়েও লম্বা চওড়া হলে কি হবে প্রকৃতিগতভাবে ২য় টুথমিস ছিল মেয়েলী স্বভাব এবং দুর্বল চিত্তের অধিকারী। যোগ্যতা বলতে উল্লেখ করার মত তার কিছুই ছিলনা। ফলে সমস্ত রাজকীয় দায়িত্ব আর প্রশাসনিক কাজকর্মের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তার সৎ বোন ও দৃঢ়মনা স্ত্রী হাসেপসুটসের হাতে । দু একটি ছোট খাটো বিদ্রোহ দমন করা ছাড়া রাজা ২য় টুথমিস তার সুদীর্ঘ যৌথশাসন কালে বড় কোনও যুদ্ধে নেতৃত্ব দেননি যা ছিল সে সময় ফারাওদের জন্য এক ব্যাতিক্রমী ঘটনা।

দেবী হাথরের সাথে হাটসেপসুটের এই একটি ছবি যা ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এছাড়া রানী হাটসেপসুট আর দ্বীতিয় টুথমিসের মধ্যে সম্পর্কও খুব একটা ভালো ছিল না। ক্ষমতার লড়াই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগীতা আর দ্বন্ধের কথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ এবং কুশলী রাস্ট্রনায়কোচিত চরিত্রের অধিকারী স্ত্রী হাটসেপসুটকে স্বামী ২য় টুথমিস মনে প্রানে অপছন্দ করতেন। এদিকে হাটসেপসুটসও সবসময় বলতেন তার পিতার ইচ্ছা ছিল তার মৃত্যুর পর সেই হবে সিংহাসনের একমাত্র অধিকারী। হাটসেপসুটের বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলের কাছে বয়সে ছোট ২য় টুথমিস অনেক পেছনে পরে থাকতেন।

শারিরীক সামর্থেও হাটসেপসুট তার স্বামীর থেকে অনেক শক্তিশালী ছিলেন। এটা বলা হয় এ কারনে যে একবার তিনি একটি রাজকীয় উৎসবে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন । ২য় টুথমিস দুর্বল চরিত্রের কারনে অনেকেই তাকে পছন্দ করতোনা বলে মনে করা হয়ে থাকে। এ ধারনা করার কারন হল সে সময় একবার রাজ্যের প্রধান অমাত্যরা তার বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করেছিল। লুক্সরে হাটসেপসুট নির্মিত মন্দিরের একটি চিত্রকলা রাজত্বের সতেরতম বছরে রানী হাটসেপসুট নিজেকে মিশরের প্রকৃত শাসক প্রচার করার জন্য সেড নামে এক বিশাল জাকজমকপুর্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

এই অনুষ্ঠানের পর তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এক সমঝোতা হলো যে তাদের ভবিষ্যত পুত্রই হবে মিশরের পরবর্তী ফারাও। কিন্ত দুর্ভাগ্যবশত তাদের ঘরে পুত্র সন্তানের বদলে দুটি কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে। একটি মেয়ের নাম ছিল নেফেরুরে যার অর্থ সৌন্দর্য্যময় সূর্যদেবতা। এতে সব পুরুষের মত ২য় টুথমিসেরও সকল বাৎসল্যরস ধাবিত হয় সাধারন ঘরে জন্ম নেয়া তার ২য় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র মেনখেপরের প্রতি। যে কি না খুব অল্প বয়সেই কার্নাকের আমন রা এর মন্দিরের একজন পুরোহিত দলে নিযুক্ত হন ।

চৌদ্দ বছর হাটসেপসুটের সাথে যৌথ রাজত্ব পরিচালনার পর দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী তিরিশ বছর বয়সী রাজা দ্বীতিয় টুথমিস ১৪৯১ অব্দে মৃত্যুবরন করেন। রাজাদের উপত্যকায় তার বাবার কবরের কাছেই গোপনে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। লুক্সরে ফারাওদের শেষ আশ্রয়স্থল রাজাদের উপত্যকা ২য় টুথমিসের মৃত্যুর পেছনে হাটসেপ্সুটস এর হাত আছে বলেও অনেকে সন্দেহ করে থাকে। টুথমিস ২য় চেয়েছিল তার প্রিয় পুত্র মেনখেপরকে এককভাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে। এজন্য তিনি কার্নাকের মন্দিরের পুরোহিতদেরও এই ষড়যন্ত্রে কাজে লাগিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

এটা রানী ও তার প্রিয়ভাজনদের মনে রোষের সৃষ্টি করে। যেভাবেই দ্বিতীয় টুথমিস মারা যাক ৩৭ বছর বয়সী রানীর সাথে রাজত্ব পরিচালনার একমাত্র দাবীদার ছিল এই মেনখেপরে। কুশলী হাটসেপসুট চিন্তা করলেন তিনি যদি তার মৃত স্বামীর নয় বছরের এই নাবালক পুত্র সন্তানের সাথে কন্যা নেফেরুরের বিয়ে দেন তবে তার নিজের সিংহাসন নিশ্চিত থাকলো। এমন অল্প বয়সী মেয়ের জামাই উপর খবরদারি করা তার জন্য সহজ হবে। এই চিন্তার ফসলই হলো মেনখেপরের সাথে তার প্রিয় কন্যার বিয়ে।

রাজা তৃতীয় টুথমিস মেনখেপরে তৃতীয় টুথমিস নাম নিয়ে তার সৎ মা অর্থাৎ ফুফু তথা শাশুড়ির সাথে যৌথ ভাবে রাজ্য পরিচালনায় সহভাগী হলেন। বুদ্ধিমতী রানী হাটসেপসুট অত্যন্ত চতুরতার সাথে তাকে জনগনের সামনে রেখে আড়াল থেকে শক্ত হাতে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। ৩য় টুথমিস যখন আস্তে আস্তে একটু বড় হয়ে উঠতে লাগলো তখন রানীর এই কতৃত্বপরায়নতা তাকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলতে লাগলো। এদিকে হাটসেপসুট রানী হলেও যে সে একজন মহিলা এটা তাকে সব সময় স্মরণে রাখতে হতো। বিভিন্ন ধরনের আকস্মিক বাধা আর প্রতিকুলতা মোকাবেলার জন্য তিনি সবসময় তৈরী থাকতেন।

হাটসেপসুটসের আরেকটি আশংকা ছিল জেদী এবং প্রতিহিংসাপরায়ন ভাতিজার অতর্কিত বিদ্রোহের সন্মুখীন হওয়ার। আর এসব প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য তিনি গ্রহন করেছিলেন নানারকম কূটকৌশল আর প্রচারনার। এর একটি ছিল জনগন যাতে মহিলা হিসেবে তাকে দেখে যেন অসন্তষ্ট না হয় তার জন্য সে তাদের সামনে আসতো পুরুষের পোশাক পরে, এমনকি সে নকল দাড়িও ব্যবহার করতো। তার বেশিরভাগ মুর্তি ছিল পুরুষের পোশাক আর নকল দাড়ি লাগানো। সেগুলো দেখে মনে হয় তার শারিরীক গঠনও ছিল অনেকটা অল্প বয়স্ক পুরুষের মত।

পুরুষের বেশে রানী হাটসেপসুট ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে হাটসেপসুটসের দীর্ঘ চব্বিশ বছর রাজত্বকালে কখনোই তিনি এককভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করার সুযোগ পাননি । তিন তিনবারই তাকে প্রথমে তার বাবা, পরে স্বামী এবং সবশেষে ভাইয়ের ছেলের সাথে যৌথ ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে হয়েছে। বাবার সাথে কয়েকমাস রাজত্ব করলেও তিনি স্বামী তথা সৎ ভাই ২য় টুথমিস এর সময়ের পুরোটা এবং ৩য় টুথমিসের রাজত্বকালের কিছু অংশ জুড়ে সর্বময় কর্ত্রী হিসেবে দোর্দন্ডপ্রতাপের সাথে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। রানী হাটসেপসুট নুবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ ছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশের সাথে ব্যাবসা বানিজ্যর উপর জোর দেন।

এ উদ্দেশ্যে তিনি পান্ট বর্তমান সোমালিয়া পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি আটটি জাহাজ ভরে মুল্যবান হাতির দাত, পশু, মশল্লা মুল্যবান ধাতু যেমন সোনা ছাড়াও মিশরীয়দের প্রিয় সুগন্ধী গাছ নিয়ে এসেছিলেন। তার এই সুদুর প্রসারী চিন্তা ভাবনা দেশের অর্থনীতিতে প্রবল উন্নতির জোয়ার নিয়ে এসেছিল, তার প্রজারাও যুদ্ধ বিগ্রহ না থাকায় সুখে শান্তিতে দিন কাটাতো। দের এল বাহারি মন্দিরের গায়ে আঁকা চিত্রকলা এই অগাধ সম্পদ রানী হাটসেপসুট ব্যাবহার করেন তার রাজত্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সৌধ নির্মানে। তার মত এত সৌধ সে সময় আর কোন রানীর আমলে দেখা যায় নি।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নীল নদের অপর তীরে থিবসের এক পাহাড়ের ঢালে দের এল বাহারীর মন্দির। গেটের কাছ থেকে তোলা হাটসেপসুট নির্মিত বিখ্যাত দের এল বাহারির মন্দির বিশাল জায়গা জুড়ে তিন স্তর বিশিষ্ট অপুর্ব সুন্দর এই মন্দির যা নান্দনিকতায় একমাত্র গ্রীসের পার্থেননের মন্দিরের সাথেই তুলনীয়। রানীর প্রিয়ভাজন, প্রধান অমাত্য সেনমাটের করা নকশায় তৈরী এই মন্দির দেখতে হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন ভীড় জমায় । মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রধানত দেবতা আমন রা এবং হাথরের উদ্দেশ্যে যাদের হাটসেপসুট তার পিতা মাতা বলে মনে করতেন। এর কিছুটা অংশ দেবতা আনুবিসকেও উৎসর্গিত ছিল।

এগিয়ে যাচ্ছি তিন ধাপে তৈরী মন্দিরের দিকে আমরা রাতের ট্রেনে কায়রো থেকে রওয়ানা দিয়ে ভোরে পৌছাই লুক্সর। গাইড আমাদের ষ্টেশন থেকে পিক আপ করে নিয়ে গেল প্রথমেই বিলাশবহুল প্রমোদতরী এটনে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আগুনে ঝাপ দিয়ে আরো বিদেশী পর্যটকদের সাথে রওনা হোলাম কার্নাকের মন্দির আর কিংস আর কুইনস ভ্যালী দেখতে সাথে বিখ্যাত দের এল বাহারির মন্দির। যেতে যেতে গাইডের মুখে শুনছিলাম হাটসেপসুটের কাহিনী। কি ভাবে এই কঠিন নামটা মনে রাখতে হবে তাও বুঝিয়ে দিচ্ছিল সে।

ডান দিকে আমাদের গাইড মন্দিরে প্রবেশের আগে বুঝিয়ে দিচ্ছে সব এই মন্দিরের এর দেয়ালে দেয়ালে আঁকা আছে তার রাজত্বকালের স্মরনীয় ঘটনাগুলো। এর মধ্যে নুবিয়াতে যুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে সোমালিয়া যাবার ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে। রানীর মুর্তির পেছনে আকা রয়েছে কি ভাবে তিনি সোমালিয়া থেকে বিপুল সম্পদ এনেছিলেন তার বর্ননা। এখানে দেখা যাচ্ছে আটটি জাহাজ আর একটি নৌকাতে পান্ট অর্থাৎ সোমালিয়া থেকে পাওয়া জিনিসগুলো জাহাজে তোলা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সুগন্ধী গাছের গুড়ি, প্রচুর জিনিসপত্র এবং কিছু বেবুনের পাল।

লোহিত সাগরের কিছু বৈচিত্রময় মাছের চিত্রও আঁকা রয়েছে এখানে। মন্দিরের দেয়ালে আঁকা অপুর্ব চিত্রকলা রানী হাটসেপসুটের উল্লেখযোগ্য নির্মা্নের মধ্যে আরো রয়েছে লুক্সরের কার্নাকের মন্দির আর মধ্য ইজিপ্টের বেনী হাসানে দেবী পাখেট এর উদ্ধেশ্যে উতসর্গ করা দুটি মন্দির। তবে এর একটির কাজ শুরু করলেও শেষ করতে পারেনি। যা পরবর্তীতে ৩য় টুথমিস শেষ করেন। সুতীক্ষ শিলালিপি এ ছাড়াও তিনি কার্নাকের সুউচ্চ স্তম্ভের আকারের শিলালিপি যাকে ইংরাজীতে ওবেলিস্ক বলা হয়ে থাকে সেগুলো তৈরী করান।

শিল্পকলার এক চুড়ান্ত নিদর্শন সবচেয়ে বড় ওবেলিস্কটি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তৈরী হয়েছিল তার রাজত্বের ছয় বছরের সেড উতসব উদযাপনের সময়। সে সময় প্রাচীন মিশরের ফারাওরা তাদের বিভিন্ন ঘটনাকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য এই উতসবের আয়োজন করে থাকতো। হাটসেপসুটের ভগ্ন মন্দির কূটনৈতিক জ্ঞ্যনসম্পন্না এক প্রজ্ঞাবান রাজনিতীবিদ রানী হাটসেপসুট সিংহাসনের উপর তার দাবী বা কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি দুটি পথ বেছে নিয়েছিলেন । প্রথমটি ছিল তিনি হচ্ছে জনপ্রিয় রাজা প্রথম টুথমিসের অন্যতম প্রিয় সন্তান। কেননা বাকী তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে তার বাবা তাকেই সহকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।

তবে তার দ্বীতিয় দাবীটি ছিল খুবই রহস্যময়। সে দেবতা আমনকে তার পিতা বলে দাবী করতেন। তার মতে এক রাতে দেবতা আমন টুথমিসের বেশে তার মা আহমেস এর কাছে এসেছিলেন। তাদের ভালোবাসার ফসল হলো হাটসেপসুট। তিনি এই ঘটনাটিকে মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন বলেই ধারনা করা হয়।

যার জন্য তার নির্দেশে দের এল বাহারীর মন্দিরের দেয়ালে হেইরোগ্লিফিক ভাষায় ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরন উতকীর্ন করা আছে। দেবতা আমনের কন্যা হিসেবে নিজেকে প্রচার করায় হাটসেপসুটের অবস্থান শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত হয়েছিল তৃতীয় টুথমিসের নির্দেশে ভেঙ্গে চুড়ে দেয়া দেয়া কার্নাকের মন্দির তৃতীয় টুথমিস যৌবনে পা দেয়ার সাথে সাথে তার উপর সৎ মায়ের অভিভাবকত্ব এবং কর্ত্রিত্ব অসহনীয় হয়ে উঠলো। বিশেষ করে চক্ষুশুল হয়ে উঠলো তার সৎ মা এর প্রধান উপদেষ্টা সেনমাট। আসওয়ানের শিলালিপি থেকে জানা যায় সাধারন ঘরে জন্ম নেয়া সেনমাট ছিলেন হাটসেপসুটের আশীর্বাদপুষ্ট । লিপিতে আরো লেখা আছে তিনি ছিলেন রাজকন্যা নেফেরুরের শিক্ষক ,রানীর প্রিয়পাত্র, আমেনের মন্দির রক্ষক এবং আমেনের প্রধান স্থপতি, রাজকীয় সীল মোহর বহন কারী।

সেনমাটকে রানীর হৃদয়রক্ষক বলেও এই লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই স্থপতি সেনমাট রানীর অনেকগুলো শিলালিপি তৈরী করেন। আসোয়ানের একটি শিলালিপিতে তাকে রানী হাটসেপসুটের সামনে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায় যা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। মাটিতে পরে থাকা হাটসেপসুট এর নির্মিত ২য় শিলালিপি যা প্রতিহিংসার বলি এদিকে দক্ষ এবং শান্তি প্রিয় শাসক হিসেবে রানীর জনপ্রিয়তা চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে লাগলো যা ছিল টুথমিসের কাছে অসহ্য। যুদ্ধ বিগ্রহ না থাকায় টুথমিসের অনুগত সৈন্যরাও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো।

এ সময় সিরিয়ায় বিদ্রোহ দেখা দিলে রানী হাটসেপসুট ৩য় টুথমিসকে এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করলেন। ১৪৭১ খৃষ্ট পুর্বে ৩য় টুথমিস প্রথম সিরিয়া অভিযান শুরু করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রায় সাতবার তিনি এই সিরিয় বিদ্রোহ দমন অভিযান পরিচালনা করেন। খৃষ্টপুর্ব ১৪৫৮ তে ৩য় টুথমিস যখন সিরি্যা অভিযানে ব্যাস্ত সে সময় মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ৬০ বছর বয়সী রানী হাটসেপসুটস মৃত্যু্র খবর তার কাছে এসে পৌছায়। ।

রানী হাটসেপসুটের মমি তার মৃত্যুর খবর পেয়ে টুথমিস দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসেন। অত্যন্ত বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়ে ৩য় টুথমিস রানীর স্মৃতিতে গভীর সন্মান দেখান এবং তার নির্মিত সমাধি সৌধে তাকে সমাহিত করেন। এর একদিন পরেই তিনি নিজেকে মিশরের সার্বভৌম রাজা হিসেবে ঘোষনা দিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিন্ত তিনি মৃত রানীর প্রতি সন্মান দেখালেও তার প্রিয়ভাজনদের ক্ষমা করেন নি। কিছু সংখ্যক পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বেশিরভাগই তার হাতে মৃত্যু বরন করেছে বলে প্রচারিত রয়েছে।

সিংহাসনে বসেই তিনি প্রথমেই রানীর প্রিয় অমাত্যদের নাম বিভিন্ন শিলালিপি থেকে মুছে দেয়ার নির্দেশ দেন। বিশেষ করে রানীর প্রিয়ভাজন সেনমাটের । প্রায় ১২০০ শ টুকরো করা ছিন্নভিন্ন হাটসেপসুটের হৃদয়রক্ষক সেনমাটের কারুকাজ খচিত শবাধারটির অবস্থা দেখে বোঝা যায় তার উপর টুথমিস ৩য় এর কি পরিমান ক্ষোভ ছিল। টুথমিসের ক্ষোভের পরিনতি হাটসেপসুটের নির্মিত মন্দির ব্যাক্তি জীবনে অত্যন্ত দয়ালু এবং সু -শাসক হিসেবে পরিচিত ৩য় টুথমিস ৫৩ বছরের দীর্ঘ রাজত্বকালের শেষ প্রান্তে এসে হঠাত তার মৃত সৎ মা ও তার সহভাগী রানী হাসেপসুটসের উপর প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে উঠেন। হয়তো তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো নষ্ট করার জন্য সবসময় হাসেপসুটসকে দায়ী করতেন।

যার ফলে তার খড়গহস্ত নেমে আসে রানীর নির্মিত বিভিন্ন নিদর্শনের উপর । তার ধ্বংসলীলায় ভেঙ্গে পড়েছে অন্যতম স্থাপত্য কলার নিদর্শন কার্নাকের মন্দির, অপরুপ শিল্পকলা সমৃদ্ধ সুউচ্চ শিলালিপিগুলো উপর টুকু ছাড়া বাকি অংশে যেখানে ধর্মের বানী খোদাই করা থাকায় সেগুলো আস্তর দিয়ে ঢেকে দেয়ার দেন। কিছু কিছু ভেঙ্গেও ফেলা হয়। করেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হাটসেপসুটের মুর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুড়ে বিকৃত করা হয় তার নির্দেশে।

দের এল বাহারের মন্দির এমনকি তার এই বিলম্বিত প্রতিহিংসার হাত থেকে রেহাই পায়নি পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্য্যময় দের এল বাহারের মন্দিরটিও। এই মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হাটসেপসুটের নাম মুছে সেখানে তার এবং তার বাবা ২য় টুথমেসের নাম লেখা্র নির্দেশ দেন। তিনি চেয়েছিলেন ইতিহাস থেকে হাসেপসুটসকে চির জনমের মত মুছে ফেলতে। আর তার জন্য তিনি বিভিন্ন শিলালিপিতে রাজাদের নাম লেখার সময় টুথমিস ১, ২ ৩ পর পর লিখেছেন। হাসেপসুটসের নামের চিনহ রাখেন নি কোথাও।

মনে হয় পুরুষশাসিত রাজবংশের মধ্যে এক রানীর অনুপ্রবেশ তার জন্য লজ্জাজনক ছিল হয়তো। এমনকি দের এল বাহারের মন্দিরের বাইরে পুরুষের বেশে নকল দাড়ি লাগানো হা্টসেপসুটের মুর্তিগুলোকে তার বাবার মুর্তি বলে প্রচার করেন। নকল দাড়ি লাগানো হাটসেপসুটের বিখ্যাত ভাস্কর্য্য তার প্রতিহিংসার হাত থেকে এমনকি রেহাই পায়নি হাটসেপসুটসের সমাধি সৌধ পর্যন্ত। রানীর ইচ্ছে ছিল রাজকীয় উপত্যকার ২০ নম্বর সৌধে এ তার পিতার যে সমাধি আছে সেখানেই হবে তার শেষ আশ্রয়স্থল। এ উদ্দেশ্যে তিনি এই সমাধি সৌধের আয়তন কিছুটা বড় করেন যাতে দুটি শবাধার রাখা যায়।

কিন্ত হাটসেপ্সুটের মৃত্যুর পর ৩য় টুথমিস প্রথম তাকে সেখানে সমাহিত করলেও তার পিতার শবাধার সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে রাখেন ৩৮ নম্বর সৌধে। ক্ষুদ্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ ৩য় টুথমিস যখন সবকিছু থেকে রানীর নাম মুছে দিচ্ছিলেন সেসময় তিনি ২০ নম্বর সৌধ থেকে তার মমিটিও সরিয়ে ফেলেন । সেখানে শুধু থেকে গিয়েছিল তার আভ্যন্তরীন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভরা কিছু পাত্র। যার একটিতে পাওয়া যায় হাটসেপসুটের যকৃত। হাটসেপসুটের মমি পরীক্ষা করছেন বিশিষ্ট ইজিপ্টোলজিষ্ট জাহি হাওয়াস হাটসেপসুটের প্রকৃত মমি নিয়েও কম বিভ্রান্ত হয়নি মানুষ।

২০০৭ সালের জুন মাসে কিছু কিছু প্রত্নতাত্বিকরা ঘোষনা করলেন যে ৬০ নম্বর সমাধির মাটিতে অযত্নে অবহেলায় পরে থাকা মমিটিই হাটসেপসুটের। তবে বিশিষ্ট পুরাতত্ববিদ, ইজিপ্টোলজিষ্ট জাহি হাওয়াসের মতে রাজকীয় উপত্যকার ৬০ নম্বর সমাধির শবাধারে রাখা মমিটিই রানী হাটসেপ্সুটের । মমিটি দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন মৃত্যুর সময় হাটসেপসুট ছিল স্বাস্থ্যবতী, মধ্যবয়স্কা, বিগতযৌবনা এক রমনী। ভাস্কর্যেরগুলোর মত মোটেও বালকোচিত শরীরের অধিকারী নয়। আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মমিটি পরীক্ষা নীরিক্ষার পর তাদের ধারনা রানী সম্ভবত ডায়বেটিস রোগে ভুগছিলেন সেই সাথে যকৃতের ক্যান্সারে।

জার্মান বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা করছেন হাটসেপসুটের লোশন সাফল্য আর দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনা করা রানী হাটসেপসুটের মৃত্যুও কিছুটা রহস্যে ঘেরা। কারো মতে ৩য় টুথমিসের হাতেই সেনেমাট আর নেফেরুরের সাথে হাটসেপসুটও নিহত হয়েছিলেন। কেউ বলছেন তিনি হাড়ের ক্যান্সারে মারা গেছেন। শেষ পর্যন্ত এই বিতর্কের অবসান ঘটালেন জার্মানীর বিখ্যাত বন ইউনিভার্সিটির দুজন প্রফেসর । আর এই বিতর্কের সমাপ্তি টানলো রানী হাটসেপসুটের ব্যাবহার করা একটি লোশনের পাত্র যা কিনা দীর্ঘদিন ধরে সেন্টের শিশি বলেই সবার ধারনা ছিল।

জার্মান প্রফেসর দুজন দুবছরের গবেষনার মাধ্যামে এটাই প্রমান করলেন যে এই লোশনটি ততকালীন ইজিপ্টে চর্ম রোগ বিশেষ করে একজিমা বা সোরাইসিস চিকিতসার ব্যাবহার করা হতো। এর উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বাদামের তেল, ফ্যাটি এসিড ছাড়াও রয়েছে ক্যন্সার সৃষ্টিকারী টার নামে তামাকজাত একটি উপাদান যা কিনা আলকাতরার মত কালো রঙের ঘন আঠালো একটি পদার্থ। এই টার সিগারেটের মধ্যেও রয়েছে। জার্মান বৈজ্ঞানিক দুজন রানীর ব্যাবহার করা এই লোশন পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত প্রমান করতে সক্ষম হলেন যে এই কারসেনোজিনিক উপাদানে নির্মিত লোশন ব্যবহারের মাধ্যামেই তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর ফলে রানী হাটসেপসুটকে হত্যা করার মিথ্যা অভিযোগ থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করলেন তার সহরাজত্বকারী ভ্রাতুষ্পুত্র ৩য় টুথমিস।

হাটসেপসুটের নির্দেশে তৈরী অসাধারন কারুকার্য্যময় একটি ওবেলিস্ক কিছু ছবি নেট আর কিছু ছবি আমাদের তোলা
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৫৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।