আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারতের ৯/১১: পেছনে কারা, হোতা কারা? মোসাদ-সিআইএ-আইএসআই কানেকশন_মাইকেল চসুদোভস্কি

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

ইওরোপ ও আমেরিকার গণমাধ্যমের বিশ্বাস মুসলিম মৌলবাদীরাই মুম্বাই সন্ত্রাস ঘটিয়েছে। ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ তত্ত্বের দর্পণ দিয়ে তারা একে দেখছে ‘সভ্যতার বিরুদ্ধে জঙ্গি ইসলামের যুদ্ধ হিসেবে’।

বহুসংখ্যক মানুষের নাটকীয় মৃত্যু পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম বিরোধিতাকে আরো জোরদার করেছে। গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী ‘রহস্যময়’ আল কায়েদাই প্রধান শত্রু। সে মোতাবেক ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’ দিয়ে আল কায়েদা দমনে একতরফাভাবে যে কোনো কিছু করার পবিত্র অধিকার আমেরিকার রয়েছে! সুতরাং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন অন্যায় নয়! মুম্বাইয়ের 'মানবিক ক্ষতির' জবাবে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোয় বোমাবর্ষণ করাও সঙ্গত; এই হলো মার্কিনি চাল। গণমাধ্যমে নিরলসভাবে মুম্বাই হামলার দৃশ্য প্রচারে পশ্চিমাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ঘটনা আমেরিকার ৯/১১ থেকে আলাদা নয়।

বলা হচ্ছে, এসবই হলো আমেরিকার মাটিতে নতুন আরেকটি সন্ত্রাসী হামলার আলামত। ভাবি উপরাষ্ট্রপতি জো বিডেন তো নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেইছেন: যারা ৯/১১ ঘটিয়েছিল...তারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মাঝখানের পাহাড়গুলিতে সংগঠিত হচ্ছে এবং নতুন আক্রমণের ফন্দি করছে। সুতরাং মার্কিন সরকারি ভাষ্য হচ্ছে ৯/১১, মুম্বাই এবং আমেরিকায় নতুন করে হামলার পরিকল্পনাকারীরা আসলে একই শক্তি। মুম্বাই হামলার পরপরই নিউ ইয়র্কের মেয়র সেখানে ‘হাই এলার্ট’ জারি করেছেন। আইএসআই, আমেরিকার ট্রয়ের ঘোড়া সবাই যখন মুম্বাইয়ের ঘটনার পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই-য়ের হাত আবিষ্কার করছেন, তখন ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে সিআইএ-র যোগসাজশ বা সম্মতি ছাড়া আইএসআই কিছু করে না।

আইএসআই আমেরিকার ট্রয়ের ঘোড়া। ১৯৮০-র দশক থেকেই তারা মার্কিন-ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তাদের হয়েই তারা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে তালেবান বাহিনী গঠন করে দিয়েছিল। ৯/১১ এর পরে আফগানিস্তান আক্রমণের বেলাতেও মার্কিনিদের ডান হাত হিসেবে আইএসআই-ই কাজ করেছিল, এখনও সেটাই করছে। আইএসআই-য়ের প্রধান নিয়োগে সিআইএ-র ভূমিকাও সুবিদিত।

গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকার চাপে আইএসআইয়ের তখনকার প্রধান জেনারেল নাদিম তাজ এবং তাঁর দুই সহকারিকে সরানো হয়। সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি নিউইয়র্কে সিআইএ-র পরিচালক মাইকেল হেইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর কয়েকদিন পরেই আইএসআই-য়ের পরিচালক হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ সুজা পাশাকে নিয়োগ দিতে বলে যুক্তরাষ্ট্র। সেটাই করা হয়। একইসঙ্গে পাকিস্তান পার্লামেন্টে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাটিকে বেসামরিক কর্তৃত্বে তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে আনার সরকারি চেষ্টারও বিরোধিতা করে ওয়াশিংটন।

লণীয় যে, পাকিস্তান সরকার সার্বভৌমত্ব লংঘনকারী মার্কিন বিমান হামলার বিরোধিতা করলেও সেনাবাহিনী এবং আইএসআই ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে’ তা মেনে নিয়েছে। আইএসআই-য়ের নতুন প্রধান হিসেবে সুজা পাশার নিয়োগের সময়টি তাই মনোযোগ দাবি করে। এর মানে হচ্ছে এ ধরনের হামলা চলতেই থাকবে। মতা নিয়েই জেনারেল সুজা আইএসআইয়ের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক কমান্ডারকে সরিয়ে নতুন লোক বসান। অক্টোবরের শেষাশেষি তাঁকে দেখা যায় পেন্টাগন এবং ল্যাংলিতে অবস্থিত সিআইএ-র সদর দপ্তরে বৈঠক করতে।

ওয়াশিংটন পোস্টে বলে, ‘পাকিস্তান প্রকাশ্যভাবে বিমান হামলার বিরোধিতা করে এলেও ওয়াশিংটনে জেনারেল সুজা পাশার সঙ্গে মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানদের বৈঠকটি বেশ হাশিখুশির মধ্যেই হয়েছে’। (ওয়াশিংটন পোস্ট, ৪ নভেম্বর, ২০০৮)। মুম্বাই হামলার সময় নির্বাচন লাগাতার মার্কিন হামলায় তীব্র মার্কিন বিরোধী জনমত গড়ে উঠেছে পাকিস্তানে। এই জনমতই আবার ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর পক্ষেও চাপ দিচ্ছে। মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্ক সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থায় থাকলেও মুম্বাই হামলার আগের দিনগুলোতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সর্বোচ্চ ভাল অবস্থায় আসে।

হামলার এক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট জারদারি কাশ্মীর সমস্যা নিয় ভারত ও পাকিস্তানে প্রকাশ্য বিতর্ক আয়োজন এবং জনগণের হাতেই এর সমাধানের ভার তুলে দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি উভয় দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করতে নতুন একটি অর্থনৈতিক জোট গঠনেরও প্রস্তাব তোলেন। ভাগ কর শাসন কর এই আক্রমণের ফায়দা কী? ওয়াশিংটন চাইছে মুম্বাই হামলাকে ব্যবহার করে: ১. ভারত পাকিস্তানের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক ঐক্যে ফাটল ধরানো। ২. ভারত ও পাকিস্তানের ভেতরের সামাজিক, জাতিগত ও আঞ্চলিক বিভেদকে আরো বাড়ানো। ৩. আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব লংঘন করে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো এবং নিরীহ জনসাধারণ হত্যাকে যুক্তিযুক্ত করা।

৪. ভারতীয় উপমহাদেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ চালু করাকে বৈধতা দেয়া। ২০০৬ সালেই পেন্টাগনের দলিলে প্রকাশ পায় যে, ‘৯/১১ ধরনের আরেকটি ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা হলে পরিচিত শত্র“দের বিরুদ্ধে চলতি আক্রমণগুলিকে যেমন জায়েজ করা যাবে, তেমনি চালানো যাবে নতুন সামরিক অভিযান। বর্তমানে সেসবের যৌক্তিকতার অভাব ঘটেছে। ’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও ভারতীয় গণমাধ্যম একযোগে হামলাকারীরা পাকিস্তানী বলে রায় দিয়েছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে গেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে হামলার সঙ্গে আইএসআই জড়িত।

সেই হামলায় ভারতের একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকসহ ষাটজন নিহত হন। এ মূল্যায়নও পাকিস্তানকে আরো চাপের মধ্যে ফেলেছে। আইএসআই ও সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং এর বাহু আইএসআই-য়ের ওপর নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতিও সরকার ঠিক করতে পারে না। এই পরিপ্রেেিত প্রেসিডেন্ট জারদারি নানান পে নানান ভূমিকা রাখছেন।

একদিকে দেশের মিলিটারি-গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করছেন, অন্যদিকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছেন আবার প্রধানমন্ত্রী জিলানীর কাছে ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে বাখোয়াজি করছেন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির উত্তেজনা এই অঞ্চলে মার্কিন ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পরিবেশ তৈরি করছে। তদন্তে মার্কিন হস্তপে অন্যদিকে ওয়াশিংটন ভারতের পুলিশি তদন্তে সরাসরি হস্তপে শুরু করে দিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে বলা হচ্ছে, ‘তদন্তকাজে এক অদৃষ্টপূর্ব যোগাযোগ দেখা যাচ্ছে ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে। ’ দিল্লিতে মার্কিন এফবিআই এবং ব্রিটিশ এমআই১৬ এর দপ্তর আছে।

ইতিমধ্যে ওয়াশিংটন মুম্বাই হামলা তদন্তে পুলিশ, সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক বিজ্ঞানীদের মাঠে নামিয়েছে; ‘যেহেতু মার্কিন নাগরিকরাও ঐ হামলার শিকার হয়েছে। ’ পরিষ্কারভাবে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ভূমিকা হবে ভারতীয় পুলিশের তদন্তকে প্রভাবিত করা। বালি ২০০২ বনাম মুম্বাই ২০০৮ মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ২০০২ সালের বালি দ্বীপের হামলার কিছু বিশেষ মিল রয়েছে। দুটি ঘটনাতেই পশ্চিমা পর্যটকরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ বিচারকাজের পর দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মাত্র গত ৯ নভেম্বরে।

কিন্তু এই ঘটনার রাজনৈতিক হোতাদের টিকিটিও ধরা হয়নি। অথচ ঐ ২০০২ সালেই ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের থেকে অভিযোগ ওঠে যে, বালির ঘটনার সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল এ. এম. হেন্দ্রোপ্রিয়নো এবং সিআইএ জড়িত। ইন্দোনেশিয়ায়র জেমাহ ইসলামিয়াহ'র সঙ্গে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্কের বিষয়টি অস্ট্রেলিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সরকারি তদন্তে কখনোই আলোচিত হয়নি। বালির ঘটনার পরে অস্ট্রেলিয় প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড বলেন, ‘বালি বোমা সম্পর্কে আমরা আগেই জানলেও কোনো হুঁশিয়ারি না দেওয়াই ঠিক মনে করেছিলাম’। ২০০২-এর বালি বোমায় ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জড়িত থাকা বিষয়ে দেশটির দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টও অভিযোগ তোলেন।

কিন্তু আদালত তাঁদের কথাকে আমলে নেয়নি। প্রেসিডেন্ট মেঘবতী সুকর্ণপুরীও যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদ আব্দুর রাহমানও অস্ট্রেলিয় এসবিএস টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে ঐ ঘটনায় ইন্দোনেশিয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার কথা বলেন। পুনশ্চ: গত কয়েক মাসে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার (র) প্রধান অশোক চতুর্বেদী রাজনৈতিক নিশানায় পরিণত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁকে সরিয়ে অন্য একজনকে ঐ দায়িত্বে বসাতে চান।

এখনও পরিষ্কার নয় যে, সাম্প্রতিক পুলিশি ও গোয়েন্দা তদন্তে চতুর্বেদী যুক্ত রয়েছেন কিনা। গ্লোবাল রিসার্চ থেকে নেয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ মাইকেল চসুদোভস্কি: কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। এছাড়া অবশ্যই দেখুন ভিডিও : Click This Link অবশ্যই পড়ুন : http://www.countercurrents.org/misra031208.htm

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.