আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস :: রাষ্ট্র পাওয়ার মাস... কষ্ট পাওয়ার মাস :: - ০৪

এলেমেলো কথাবার্তা tutul@amrabondhu.com

১ ডিসেম্বর ০৪ একাত্তরের এই দিনে দখলদার পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় বীর বাঙালী মুক্তিসেনার দল। একের পর এক শত্রুঘাটির পতন ঘটাতে ঘটাতে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। পরাজয় অনিবার্য জেনে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে পাকিস্তান। এই দিন পাকিস্তানের অনুরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের উভয় রণাঙ্গনে দু’দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারতের অনুরোধে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবের ওপর ভেটো দেয়।

সোভিয়েত ভেটোর ফলে পাকিস্তান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত আদায়ে ব্যর্থ হয়। আজ শত্রুমুক্ত হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, লক্ষ্মীপুর, মতলব, কুমিল্লার দেবীদ্বার, জামালপুরের কামালপুর, শেরপুরের ঝিনাইগাতী, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর। আজ যৌথবাহিনীর ৩টি ডিভিশন যৌথভাবে ফুলবাড়ি উপজেলার জলপাইতলী, রুদ্রানী, পানিকাটা, দেশমা, জলেশ্বরী, মিরপুর, রানীনগর, আমড়াসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। তারা ভারত থেকে এসে পাকিস্তানী বাহিনী এবং রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের ওপর চতুর্মুখী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের মুখে পাকহানাদার বাহিনী নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরে বাঁচার জন্য ফুলবাড়ির শাখা যমুনা নদীর লোহার ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে গ্রামীণ পথে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।

পরে যৌথবাহিনী ফুলবাড়িকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করে। জামালপুরের কামালপুরেও এইদিনে পাক হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ও সুসজ্জিত একটি দল বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। টানা ১০ দিনের যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর এখানে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের পতন ঘটে। ওইদিন ভোরে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা বশিরের মাধ্যমে পরে দ্বিতীয়বারের মতো মুক্তিযোদ্ধা সাজুকে দিয়ে কামালপুর ঘাঁটিতে চিঠি পাঠানো হয়। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নেয় পাকবাহিনী।

লক্ষ্মীপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রফিকুল হায়দার এবং অপর কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা করলে ৭০ জন পাকসেনা ও তাদের বিপুলসংখ্যক সহযোগী রাজাকার নিহত হয়। চাদপুরের মতলবে ৩ ডিসেম্বর রাতে বরদিয়া বাজার এলাকায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড বাধার মুখে পালিয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে মতলবের ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কুমিল্লার দেবীদ্বারে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে ৩ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ ব্রিজটি মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়।

মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্টেড ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এ অভিযান পরিচালিত হয়। হানাদাররা এ রাতে দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ৪ ডিসেম্বর দেবীদ্বারের উল্লসিত জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জীবননগরের দখলদারিত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায়। শেরপুর/ঝিনাইগাতীতে শালচূড়া ক্যাম্পের পাকবাহিনী ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে কামালপুর দুর্গের পতনের আগাম সংবাদ পেয়ে পিছু হটে।

তারা মোল্লাপাড়া ক্যাম্প গুটিয়ে শেরপুরে আশ্রয় নেয়। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত ঝিনাইগাতীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। ২ ৭১ এর হত্যা, চীফ কর্নেল রহমান ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। চীফ কর্নেল মনজুরুর রহমান। এই কলেজের অসম্ভব প্রিয় একটি মুখ।

যুদ্ধের সময় ক্যাডেট কলেজ থেকে সবাই পালিয়ে যান কিন্তু কর্নেল রহমান কয়েকজনের সঙ্গে থেকে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার পাশাপাশি তিল তিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দিচ্ছিল না। পাক আর্মি ঘিরে ফেলে একদিন এই কলেজ। নেতৃত্ব দিচ্ছিল ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইকবাল। সঙ্গে ঝিনাইদহের অল্প কয়েকজন স্থানীয় মানুষ।

টমেটো নামের একজন মিথ্যা অভিযোগ করে, কর্নেল রহমান তার পরিবারের লোকজনকে মেরে ফেলেছেন। পাক আর্মিরা একেক করে মারা শুরু করে। পাক আর্মির ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কর্নেল রহমানের কথা কাটাকাটি হয়। কর্নেল রহমান বলেন, আমি একজন সামরিক অফিসার। আমাকে এভাবে মারা অন্যায়।

আমার অপরাধের বিচার একমাত্র সামরিক আদালতেই হতে পারে। একজন আর্মি কর্নেল একজন ক্যাপ্টেনের কাছে যে আচরণ পেতে পারে- আমাকে সেটা দেয়া হচ্ছে না কেন? কর্নেল রহমানের কোন যুক্তিই এদেরকে প্রভাবিত করলো না। কর্নেল রহআন মৃত্যুর জন্য প্রস্তত হলেন। হাত থেকে খুলে দিলেন ঘড়ি, পকেট থেকে বের করে দিলেন কলেজের চাবি, যা ছিল তাঁর কাছে। একজন সিপাই তাঁর ঘড়ি উঠিয়ে নিজের হাতে দিয়ে দেখলো কেমন মানাচ্ছে তাকে- আর হ্যা হ্যা করে হাসতে থাকলো।

কর্নেল রহমান প্রাণ ভিা চাইতে রাজী হলেন না। শুধু ৫ মিনিট সময় চাইলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন নিজ হাতে লাগানো গোলাপ গাছটার দিকে। হাঁটু গেড়ে বসলেন। কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলেন- দূর থেকে শুধু ঠোঁটনড়া দেখা গেল।

তারপর হাত তুলে মোনাজাত করলেন। মোনাজাত শেষ করে বললেন, আয়্যাম রেডী, তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেনের চোখে চোখ রেখে। ক্যাপ্টেন ইকবাল পরপর ৩টা গুলি করলো। লুটিয়ে পড়লেন কর্নেল রহমান। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে প্রায় শোনা যায় না একটা স্বর শোনা গিয়েছিল, মা আয়েশা, তোকে দেখে যেতে পারলাম না।

(সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্টা: ৬০৫-৬০৮) ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা : দৃক পিকচার লাইব্রেরী

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.