আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিসেম্বর ’৯০—ডিসেম্বর ২০১৩

আজ ৩ ডিসেম্বর। তিন দিন পর ৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে সরকারে এবং বিরোধী দলে যাঁরা রাজনীতির কুশীলব, তাঁদের কোনো পক্ষেরই ডিসেম্বরের প্রথম ছয়টি দিনের কথা ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
আজ ৩ ডিসেম্বর দেশের যেসব কিশোরী ও কিশোর ১৩ বছর পূর্ণ করল, এখনো সাবালক হয়নি, যদিও তাদের অনেকের নৈতিকতাবোধ ও দেশাত্মবোধ প্রতিদিন মিডিয়ায় যাঁদের দেখা যায় তাঁদের অনেকের চেয়ে বেশি, তারা টিভি দেখে ও কাগজ পড়ে, তাদের মনে হতে পারে বাংলাদেশে এই নভেম্বর-ডিসেম্বরেই শুধু হরতাল-হাঙ্গামা হচ্ছে এবং মানুষ মরছে। অতীতে কোনো দিন বাংলার মাটিতে হরতাল-হাঙ্গামা-প্রাণহানি হয়নি।


আজ যাঁরা ২৩ বছরে পড়লেন তাঁরা পরিপূর্ণ যুবক-যুবতী। অনেকে সন্তানের বাবা-মা পর্যন্ত হয়ে গেছেন এর মধ্যেই। অনেকে খেতখামারে বা কারখানায় কাজ করেন। যাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। অনেকে পেটের ভাত জোগাতে হীন কায়িক শ্রম করতে বাধ্য হচ্ছেন।

কেউ দালালের মাধ্যমে ঘরবাড়ি বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। যাঁদের বাবা-মা বড় কর্মকর্তা বা বিত্তবান তাঁরা আমেরিকা বা কানাডায় ‘উচ্চশিক্ষা’ নিতে গেছেন। তাঁদের বসবাস ও যাতায়াতের জন্য বাড়ি বা ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনে দেওয়া হয়েছে। সেই ২৩ বছর বয়স্করা, যদিও কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার সময় থেকেই হরতাল-অবরোধ দেখছেন, তবু জানেন না যে যেদিন তাঁদের জন্ম হয়, সেদিন—৩ ডিসেম্বর ১৯৯০—বাংলাদেশের অবস্থাটা কেমন ছিল।
২৩ বছর বয়স্ক অনেকেই আজ দায়িত্বশীল কর্মজীবন শুরু করেছেন।

দেশ তাঁদের থেকে অনেক কিছু আশা করে। কেউ বা সাংবাদিকতায়ও সম্ভাবনার পরিচয় দিচ্ছেন। কেউ হয়েছেন বড় কোনো দলের ক্যাডার। রোজগার হচ্ছে বেশ। গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক।

পেশির জোর অব্যাহত থাকলে একদিন এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত যেতে পারবেন। আমাদের স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়া হরতাল-অবরোধ-প্রাণহানি নিয়ে যেসব বৈষ্ণবীয় প্রতিবেদন করছে তাতে তাদের সায় আছে কি নেই, তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। দেশ এখন অন্য কোনো বিষয় নয়, গণতন্ত্রের জন্য পাগল। মানুষ পুড়ুক আর মানুষ মরুক, সবই গণতন্ত্রের জন্য। তবে আসামির কাঠগড়ায় কোনো মানুষ নয়, খাড়া করা হয়েছে বেচারা হরতালকে।


যাদের বয়স আজ ১৩ বা ২৩, তাদের জানার কথাই নয়। যাদের বয়স ৩০-এর নিচে, তাদের ৪ ডিসেম্বর ১৯৯০-এর রাতটির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তখন এত টিভি চ্যানেল ছিল না। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত কিছুক্ষণ পর পর দুটি ভাষণ প্রচারিত হতে থাকে। ভাষণ দুটি ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের।

একটি ভাষণে বলা হয়েছিল:
‘শত শহীদের আত্মাহুতির বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের অগ্রযাত্রাকে... দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকে তিন জোট কর্তৃক ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে সার্বভৌম সংসদ নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয় ও জনগণ যাতে তাদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই পরিবেশ আমরা সৃষ্টি করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করে দেশবাসী যেমনিভাবে চলমান আন্দোলনকে বর্তমান পর্যায়ে এনে উপনীত করেছেন, তেমনিভাবে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা অতীতের ন্যায় দৃঢ় ভূমিকা পালন করবেন। শত শহীদের রক্তের প্রতি আমাদের এই অঙ্গীকার পালনে আমি দেশবাসীর সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছি। ’
আর একটি আড়াই মিনিটের ভাষণে অন্যজন যা বলেছিলেন, তাতেও ছিল মূল্যবান কথা:
‘আপনাদের সকলের আন্দোলনের ফলে স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে, কিন্তু আন্দোলনের মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একটি সুখী সমাজ গড়ে তোলার কাজ আমাদের শুরু করতে হবে। এই পথ দীর্ঘ ও বন্ধুর।

আজ এ জন্য আমাদের সকলকে হতে হবে ধৈর্যশীল ও সংযমী। ভাবাবেগে জড়িত যেকোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। পরিণামে দেশ ও জনগণের জীবনে নেমে আসবে হতাশা। ’
প্রথম ভাষণটি দিয়েছিলেন ৮-দলীয় জোটের নেতা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় ভাষণটি দিয়েছিলেন ৭-দলীয় জোটের নেতা ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

তাঁদের দুজনের দুই পাশে তখন যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখনো তাঁদের পাশেই আছেন। তাঁরা তো আছেনই, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও অনেক গণতন্ত্রের মানসসন্তান। মানুষ পুড়ুক বা মরুক, গণতন্ত্র তাঁদের চাই। বাংলার মাটিতে গণতন্ত্রকে যদি গলায় গামছা দিয়ে টেনে আনতেও হয়, তাতেও তাঁরা প্রস্তুত। বঙ্গীয় গণতন্ত্রের অপর নাম ক্ষমতা, মন্ত্রিত্ব, এমপিত্ব ও প্রাপ্তি—বাড়ি-গাড়ি, রাজউকের প্লট, সরকারি খাসজমি, পাহাড়-বনভূমি, নদীর পাড়, নদীর বুকের ভেতরকার বালু—কী নয়? যার ওপর চোখ পড়বে, তাই পাওয়া যায় গণতন্ত্রচর্চায়।


সেই গণতন্ত্র জিনিসটি আবার এমনি এমনি পাওয়া যায় না। তার জন্য মূল্য দিতে হয়। মূল্য মানে টাকা-রুপি-ডলার-পাউন্ড-ইউরো নয়। রক্ত ও জীবন। সে রক্ত ও জীবনও গণতন্ত্রের মানসসন্তানদের নয়—পথঘাটের আমজনতার।


ওপরে উদ্ধৃত ভাষণ দুটিতে আমরা কয়েকটি শব্দ দেখতে পাই। সেই শব্দাবলির মধ্যে রয়েছে ‘শত শহীদের আত্মাহুতি’, ‘তিন জোটের ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর’, ‘অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে নির্বাচন’, ‘ভোটের অধিকার প্রয়োগ’, ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন’, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’, ‘শত শহীদের রক্তের প্রতি অঙ্গীকার’, ‘স্বৈরতন্ত্রের পতন’, ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’, ‘জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি’ প্রভৃতি। এই পদগুলোর যদি ভাব-সম্প্রসারণ করি, তা হলে বার-চৌদ্দ শ শব্দে কুলাবে না। প্রয়োজন পড়বে ২৫ ফর্মার একখানা বই লেখার।
স্বৈরাচার—একটি বিশেষ্য পদ।

কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর নাম। ওই ভাষণ দুটি থেকে ১৩ এবং ২৩ বছর বয়সীরা একটি কথা জানতে পারছে, তা হলো তাদের জন্মের আগে স্বৈরাচার নামক কিছু একটা ছিল। তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় ধরে (সাড়ে আট বছরব্যাপী) তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। তাতে শত শত মানুষ শহীদ হয়েছে (অর্থাৎ স্রেফ মরেছে)। সেই সংগ্রাম করেছিল তিনটি জোট।

তাদের লক্ষ্য ছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যে গণতন্ত্রের কাজ ‘জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একটি সুখী সমাজ গড়ে তোলা’। এখন আমরা যেমন সুন্দর ও সুখী গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি—সেই রকম একটি সুখী ও সুন্দর সমাজ।
স্বৈরাচার শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো যে শাসক তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসন করেন—দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নয়।

সেদিনের সেই স্বৈরাচার, যিনি ৪ নভেম্বর ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্ষমতা থেকে সরে যাচ্ছেন এবং যে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই দুই নেতা দিয়েছিলেন বেতার-টিভিতে ভাষণ, তিনি আজ কোথায়?
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেছিলেন বিপ্লবী দল জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনু। যা ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এখন এই ২৩ নম্বর নভেম্বরে এসে শুনছি, টিভির পর্দা থেকে, তিনি এখন গণতন্ত্রী হয়ে গেছেন। কারণ তাঁরা উভয়েই একই নৌকার যাত্রী। একজন গলুইয়ের একদিকে, অন্যজন গলুইয়ের অন্যদিকে।

এমনও দিন আসবে, এই বাংলাভাষী ভূখণ্ডে যেদিন কোনো বীর উত্তম বলবেন: টিক্কা খান, ফরমান আলী ও নিয়াজি মানুষ ভালো ছিলেন এবং ছিলেন তাঁরা গণতন্ত্রের মানসপুত্র।
এক কথা মানুষ বেশি দিন মনে রাখে না এবং তা বিরক্তিকরও বটে। ‘তিন জোটের রূপরেখা’—কথাটার মানে কী? ২৩ বছর বয়সীদের অবগতির জন্য বলছি: ১৯৮৩ সালে ৮-দলীয় জোট, ৭-দলীয় জোট এবং ৫-দলীয় মোর্চা একটি পাঁচ দফা দাবিনামা তৈরি করেছিল। তার ভিত্তিতেই সাড়ে আট বছর আন্দোলন হয় এবং অন্তত সাড়ে ৮০০ মানুষ ‘আত্মাহুতি’ দেন বা বেঘোরে মারা যান। তাঁরা কেউ বিষ পান করে বা ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেননি।

অধিকাংশই মারা গেছেন পুলিশ-বিডিআরের বেয়নেট ও বুলেটের আঘাতে, কেউ সরকারি দলের ছাত্র-যুব সংগঠনের ক্যাডারদের হাতে, কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ট্রাকের চাকায় চাপা পড়ে, কেউ বোমা, কিরিচ (তখন চাপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল কিন্তু তিন হাত লম্বা রামদার এস্তেমাল ছিল না) প্রভৃতির আঘাতে।
তিন জোটের সংক্ষিপ্ত পাঁচ দফা রূপরেখার ৩ নম্বর দফায় ছিল: ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশে অন্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই কেবলমাত্র সার্বভৌম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে এবং সংবিধানসংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেবলমাত্র জনগণের নির্বাচিত সার্বভৌম জাতীয় সংসদেরই থাকবে। অন্য কারও নয়। ’ অন্য কারও নয় বলতে বোঝানো হয়েছিল রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান বা সর্বোচ্চ আদালতও সংবিধানের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না।
সাড়ে আটটি বছর রাজনৈতিক দল ও জোট, ছাত্রসমাজ, আইনজীবী, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, চিকিৎসক, শিক্ষকসমাজ, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।

লক্ষ্য একটাই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন। সার্বভৌম সংসদকে সব সিদ্ধান্তের অধিকার দেওয়া—কোনো ব্যক্তিকে নয়। সেদিনের সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।
তিন জোটের রূপরেখাকে প্রথম বুড়ো আঙুল দেখাতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

তিনি আর কোনো দলকে নয়, নিজেই আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। তিরাশি সালের রূপরেখা তিরানব্বই সাল নাগাদ কলার খোসায় পরিণত হয়। বিরোধী দলের আবার আন্দোলন। আবার রাজপথে লাশ। তখনো অবশ্য বিরোধী নেতাদের জেলে ঢোকানো হয়েছে, কিন্তু হুকুমের আসামি করে রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী জিনিস, তা বুঝতে চাইলেন না বেগম জিয়া। ১৯৯৫-৯৬তে এখনকার মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করল রাজনৈতিক সহিংসতা। তত্ত্বাবধায়ক তরিকা ফিরে এল। শেখ হাসিনা নির্বাচনে ভালো করলেন। অন্যদের নিয়ে ‘ঐকমত্য’ করে ক্ষমতায় গেলেন।


তাঁরই আন্দোলনের ফলে সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা লিপিবদ্ধ হলো, সেই প্রথার নির্বাচনেই ২০০১-এ তাঁর দল পরাজিত হয়। বস্তুত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তাঁর দল পরাজিত হয়নি, কর্মফলে পরাজয় হয়। ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, মোহাম্মদপুর, বরিশাল প্রভৃতি এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বেগম জিয়া চাননি, তার অধীনে নির্বাচন করেই তিনি পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী হন। এবং ক্ষমতাকে বংশানুক্রমিকভাবে পাকা করতে বিচিত্র ফন্দি আঁটেন।

গণতান্ত্রিক শাসনের সংস্কৃতিকে তরমুজের মতো ফালা ফালা করেন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটাকে বুড়িগঙ্গার পানির মতো সম্পূর্ণ দূষিত করে ফেলেন। সেই সুযোগে অলৌকিক আশীর্বাদ নিয়ে উদ্দিনীয় প্রশাসনের আবির্ভাব। উদ্দিনদের আশা ছিল, উনিশ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। নেতাদের ঘুষ দিয়ে দুটি প্রধান দলকে ভাঙবেন।

দুই নেত্রীকে নির্বাসিত করবেন। অন্যতম উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর মতো ভারত থেকে ঘোড়া নিয়ে এলেন ছয়টি। খিলজীর ঘোড়া ছিল এগারোটি। তাই তিনি বা তাঁর লোকেরা ছয় শ বছর টিকে গিয়েছিলেন। মইনের পাঁচটি ঘোড়া কম থাকায় দুই বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হলো না।

একপর্যায়ে আত্মরক্ষার জন্য ঘোড়ার ওপর নির্ভর না করে নৌকার আশ্রয় নিলেন। ত্বরিতে পাড়ি দিলেন আটলান্টিক। ঘোড়ায় আটলান্টিকের তরঙ্গ পাড়ি দেওয়া যেত না।
যে তত্ত্বাবধায়ক মহাজোটকে গদিনশিন করে, তার ওপরেই চাপাতি চালাল সরকার। বঙ্গীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরিদ্র ঘরের অবলা যুবতীর মতো।

তাকে বড় রাজনৈতিক দলগুলো উপভোগ করার পর মুহূর্তেই আর তাকে স্বীকৃতি ও দাম দেয় না।
বাংলার মাটিতে গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন করতে এক পায়ে খাড়া থাকা লোকের অভাব হয় না। একাত্তরে টিক্কারাও একটি নির্বাচন করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে তাঁরা জেলে যান। প্রধান দল ছাড়া নির্বাচনে ’৮৬তেও লাভ হয়নি।

’৮৮-র নির্বাচন ছিল একটি কলঙ্ক। ’৯৬-এর ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ছিল একটি জাতীয় লজ্জা। গণতন্ত্রকে পুড়িয়ে নিখাদ করতে প্রধান দল ছাড়া ভবিষ্যতেও যদি কোনো নির্বাচন হয়, তা হলে সেই সংসদের সম্ভাব্য বিরোধীদলীয় নেতার ভাষাতেই বলতে চাই—‘মানুষ থুতু দেবে’। এখন থুতু দিচ্ছে তাঁর কুশপুত্তলিকায়, তখন দেবে মুখমণ্ডলে।
শুরু করেছিলাম ’৯০-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর দিয়ে।

আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মুখটি দেখতে পাচ্ছি মেডিকেল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। নব্বইতেও তেমনটি দেখেছি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে জাফর, জয়নাল, দীপালিদের কথা মনে পড়ে। ফুলবাড়িয়ার ছাত্রমিছিলে সেলিম-দেলোয়ার ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজাহান সিরাজ বিডিআরের গুলিতে মারা যান এবং সেখানে পত্রিকার হকার আজিজ ও হলের বাবুর্চি আশরাফ গুলিতে প্রাণ হারান।

মনে পড়ে সরকারি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রউফুন বসুনিয়াকে। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় জীবন। ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮। চাটগাঁয় তাঁর মিছিলে বিডিআর-পুলিশ গুলি চালায়। তিনি বেঁচে যান।

সরকারি হিসাবে ২১ জন, বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৩০ জন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিহত হন। অমন ধর্মনিরপেক্ষ হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে কম ঘটেছে। ২৭ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত দিনে ঢাকায় ৩৫ জন, চট্টগ্রামে ছয়, ময়মনসিংহে চার, রাজশাহীতে তিন, খুলনায় তিন, নারায়ণগঞ্জে দুজন নিহত হন। ২৭ নভেম্বর যখন ডাক্তার মিলন শহীদ হন, আমি ছিলাম রোকেয়া হলের সামনে। সেদিনের দৃশ্য ভোলার নয়।

আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিই আমার বন্ধু অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও ড. শওকত আরা হোসেনের কোয়ার্টারে। নূর হোসেনের কথা কে না জানে?
এসব তেইশ-পঁচিশ বছর আগের কথা। নেতাদের বয়স হয়েছে। তাই তাঁরা ভুলে গেছেন। আমরা সাধারণ মানুষ।

গণতন্ত্রের জন্য নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বরের আগের দিনগুলোতে যাঁরা ‘আত্মাহুতি’ দিয়েছেন, তাঁদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.