আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আহসান হাবীব.................................



ছোট্ট একটা কক্ষ৷ ভেতরে ভারি চশমাপড়া ছোটখাটো গোছের একজন লোক বসা৷ তাঁর চুলের রং ধবধবে সাদা৷ সিগারেট হাতে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছেন৷ কখনো কখনো আয়েশ করে হাতের সিগারেটটি মুখে নিয়ে টেবিলের উপর কাগজগুলোতে নিবিষ্টমনে চোখ রাখছেন৷ কক্ষের ভেতরের ফ্যানের বাতাসে দরোজার পর্দাটা মাঝে মধ্যে নির্ধারিত স্থান থেকে সরে ভেতরটাকে স্পষ্ট করে তুলছে৷ পর্দার এই সামান্য ফাঁক ফোঁকরের মধ্যে দিয়ে দেখা লোকটাকে মনে হয় ঋষি৷ টেবিলের উপরের কাগজের স্তুপ আর লোকটার ভাবগাম্ভীর্যসুলভ চেহারা ভেতরের পরিবেশটাকে অনেক বেশি গভীর করে তুলছে৷ কিন্তু কেউ কেউ এই গভীরতাকে পাশ কেটে পর্দার ফাঁক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন৷ তখন পরিবেশটা আর আগের মতো নীরব থাকে না৷ ক্রমাগত সাহিত্যের নানা আলোচনায় সরব হয়ে উঠে কক্ষটি৷ সামনে বসা ঋষিগোছের লোকটাকে সেই সময় আর বর্ষীয়ান কিংবা গম্ভীর প্রকৃতির মনে হয় না৷ চশমার পুরো লেন্সের কাঁচ মুছতে মুছতে সে গলা ছেড়ে ডাকে- কালাম দুকাপ চা৷ কালাম যথারীতি চা দিয়ে যায়৷ জমে উঠে তুমুল আড্ডা৷ ক্রমে দীর্ঘ হয় সে আড্ডা, আর সিগারেটের ধোয়ায় পুরো কক্ষটা সাদা হয়ে আসে৷ এই দৃশ্যটা ঊনিশ শতকের সত্তর দশকের দৈনিক বাংলা পত্রিকা অফিসের চারতলার ছোট্ট একটি কক্ষের ৷ ভারি চশমাপড়া সাদা চুলের ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্বয়ং আহসান হাবীব৷ দেশভাগের পর তাঁর নেতৃত্বে এই কক্ষটি হয়ে উঠেছিল নতুন দেশের সাহিত্যের সূতিকাগার৷ নবীন প্রবীণ কবিদের পদচারণায় এই স্থানটি মুখরিত হয়ে উঠতো প্রতিমূর্হুত৷ সে সময় 'দৈনিক বাংলা' ও আহসান হাবীবকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল৷ অসাধারণ ব্যাক্তিত্ববোধ, মনন, রুচি ও আচার আচরণে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন কিংবদন্তি সম্পাদক৷ সেদিন আহসান হাবীব অভিভাবকের মতো সাহিত্যের মূলধারায় নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ তাঁর কল্যাণে বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক মূলধারার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিলেন৷ আজকের বাংলা কবিতার অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে আহসান হাবীবের হাত ধরে৷ তাঁর রুচি ও নিষ্ঠায় তখন 'দৈনিক বাংলার' সাহিত্য পাতা একটি আর্দশ সাহিত্য পাতার মর্যাদা অর্জন করেছিল৷ সম্পাদক হিসেবে ছিলেন একেবারেই নির্মোহ প্রকৃতির৷ সেই সময় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা যখন অনুরোধ আর স্বজনপ্রীতিতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল ঠিক তখন তিনি স্থাপন করেছেন অনন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত৷ লেখা প্রকাশে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক কিংবা কোনো সূত্রের চেয়ে নিজের রুচি ও বিচারবোধকে প্রাধান্য দিতেন তিনি৷ আর এই বিচারবোধ হলো গুনগতমান৷ আহসান হাবীবের উপর সত্তর দশকের কবি মাহবুব সাদিকের একটি লেখায় এ সম্পর্কে চমত্‍কার ধারণা পাওয়া যায়৷ লেখালেখির সূত্রে আহসান হাবীবের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়েছিল৷ তিনি লিখেন- "শোনা যায়,' দৈনিক বাংলার' সাহিত্য সম্পাদক থাকা অবস্থায় একই পত্রিকার সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান একবার কবিতা পাঠালে তিনি সে কবিতা বদলে দিতে বলেছিলেন৷ সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান আহসান হাবীবের এই অনুরোধ মেনে নিয়েছিলেন৷ তাঁরা প্রত্যেকেই যে কত বড়মাপের মানুষ ছিলেন এবং সাহিত্যের গুণগত মানকে সর্বোচ্চ সম্মান করতেন, তা এসব ঘটনায় অবহিত হওয়া যায়৷ যাদের লেখা ছাপতে পারেননি তারা প্রথমে খামে করে কবিতা পাঠালেও পরবর্তীকালে খামে ভরে অশ্লীল গালিগালাজ পাঠাতেন৷ রিকশায় করে অফিসে যেতেন তিনি৷ যেতে যেতে পথে কখনো কখনো অশ্লীল ধ্বনি শুনেছেন৷ কিন্তু শিল্পের বিচারক হিসেবে তিনি ছিলেন নির্বিকার৷ তিনি সাহিত্যের সত্যিকার অভিভাবক ও জ্ঞানতাপস"৷ এ ঘটনাই প্রমাণ করে সম্পাদক হিসাবে তিনি ছিলেন কতটা নির্মোহ এবং আপোষহীন৷ তাঁর এই আপোষহীন মানসিকতা তাঁকে এমন এক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর প্রতিতূল্য ব্যাক্তি একমাত্র তিনি নিজেই৷ অনবদ্য এই গুণের জন্য দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাসে তাঁর বিকল্প খুঁজে পাওয়া বিরল৷ আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে৷ পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার৷ মাতা জমিলা খাতুন৷ তাঁর পাঁচ ভাই চার বোন৷ অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পিতা মাতার প্রথম সন্তান তিনি৷ বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন চার সন্তানের জনক৷ শ্বশুড় বাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়৷ স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া৷ সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ৷ দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী৷ ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক৷ তিনি বাংলা মূলধারার কথা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় কথাশিল্পী৷ এছাড়া প্রকাশক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে৷ ছোট ছেলে মঞ্জুরুল আহসান জাবেদ আমেরিকা প্রবাসী ৷ পারিবারিক ভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন৷ সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি৷ সেইসময় তাঁর বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি৷ যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন৷ তখন তাঁর বয়স ১২/১৩ বছর৷ স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর একটি প্রবন্ধ ধরম' প্রকাশিত হয়৷ ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা মায়ের কবর পাড়ে কিশোর পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়৷ পরবর্তী সময়ে ছাত্রাবস্থায় কলকাতার কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হলে নিজের সম্পর্কে আস্থা বেড়ে যায়৷ স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তুকে কবিতায় উপস্থাপিত করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন৷ সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর তিনি চলে আসেন বরিশালে৷ ভর্তি হন সেখানকার বিখ্যাত বিএম কলেজে৷ কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাঁকে৷ বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান৷ এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তত্‍কালীন রাজধানী কলকাতায় পদার্পণ৷ ততদিনে অবশ্য দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রার মতো নামি দামি পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে৷ কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা৷ সেখানে যেয়ে ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথমে চাকরি নেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত দৈনিক তকবীর পত্রিকায়৷ বেতন মাত্র ১৭ টাকা৷ পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক সওগাত পত্রিকায় কাজ করেন৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন৷ কবি হিসেবে আহসান হাবীবের যাত্রা শুরু হয় অবিভক্ত বাংলায়৷ বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল তখনো ছিল অখণ্ড আকাশের মতোই এক৷ ধূর্ত ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর কূটচালে তখনও সীমানত্মে আজকের মতো কাটাতাঁরের বেড়া কিংবা সীমানা চিহ্ন বসেনি৷ তবে রাজনীতির মঞ্চে তখন বিভাজনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে৷ ঠিক সে সময় যে কজন মুসলমান তরুণ আধুনিকতাকে আত্মস্থ করে বাংলা কবিতার গতিপথে ঢুকে পড়েছেন তার মধ্যে আহসান হাবীবের নাম অগ্রগণ্য৷ পরবর্তীকালে (১৯৪৭ সাল) ধূর্ত ইংরেজ শাসকদের কূটচালে বাংলা দ্বিখন্ডিত হলো৷ তিনি ফিরে এলেন ঢাকায়৷ ঢাকা হলো তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী৷ স্বাভাবিক ভাবেই নতুন দেশের সাহিত্য নতুন স্রোতধারায় বিকশিত হবে এবং তা হয়েছিলও৷ কিন্তু সেই স্রোত আহসান হাবীবের অনুকূলে ছিল না৷ ইংরেজদের কূটচাল আর ধর্মের ঐক্যে বিভাজিত হওয়া রাষ্ট্রে সাহিত্যও ধর্মীয়করণ প্রক্রিয়া শুরু হলো৷ কলকাতা থেকে সাহিত্যের নিবিড় সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন (পূর্ব পাকিস্তানে) হওয়ার পর মননের ক্ষেত্রে নেমে আসে নৈরাজ্যের ছায়া৷ সেই সময় কাব্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়া তরুণদের অধিকাংশই নিমজ্জিত হয়ে পড়েন পুরানুকরণ প্রিয়তায়৷ তরুণরা কি নিয়ে কাব্য সৃষ্টি করবে বার বার তারই পথ নির্দেশ করেছেন তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা৷ আর সেই নির্দেশিত পথ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ৷ তখন রাষ্ট্র যন্ত্রের সাহায্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিল৷ প্রতিক্রিয়াশীলদের সেদিনের অবস্থা কবি গোলাম মুস্তাফার একটি লেখায় দারুণভাবে প্রকাশ পায়৷ তিনি লিখেছেন- "তরুণ লেখকদের কাছে তাই আমার আহবান তারা সুস্থ হউন, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করুন; সাধনা করলে পাকিস্তানের মাল মশলা দিয়ে তারা এমন সাহিত্য রচনা করতে পারবেন, যা বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে অনায়াসেই পরিবেশন করা যাবে৷ আল্লাহ্র নামে ড. আর্নল্ড যদি পার্লস অব দি ফেইথ নামক সুন্দর কাব্য রচনা করতে পারেন, আ্যলান পো যদি কোরআন শরীফের সূরা আল আরাফ নিয়ে কাব্য লিখতে পারেন, লাইলী মজনু শিরি ফরহাদ , ইউসুফ জুলেখা, আলিফ লায়লা নিয়ে যদি ইউরোপীয় লেখকেরা কাব্য রচনা করতে পারেন, হাফিজ, রুমি ওমর খৈয়াম, ইকবাল এরা যদি নিজস্ব রূপ রং রস বজায় রেখে বিশ্বসাহিত্য রচনা করতে পারেন তবে আমরা কেন পারব না৷ যে বিশ্বে আমি নেই সে বিশ্বের মূল্য কী?" ঠিক এরকম অসুস্থ সময়ে আহসান হাবীব নিজের বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়েননি৷ আপন বিশ্বাসে অটল থেকে নিজের লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন৷ উপমহাদেশের রাজনীতির টালমাটাল করা পাগলা হাওয়ার কবলে তিনি পতিত হননি৷ অথচ তত্‍কালীন মধ্যবিত্ত সমাজ সেদিন স্বাধীনতার স্বপ্ন আর ধর্মীয় চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ স্ব স্ব ধর্মের কবিরা সচেতন ভাবে রাজনীতি ও ধর্ম উত্‍সারিত কবিতা লিখতে শুরু করেন৷ এমন পরিস্থিতিতে আহসান হাবীব সরাসরি রাজনীতি কিংবা ধর্ম উত্‍সারিত একটি লাইনও রচনা করেন নি৷ দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়েও তাঁর এই নির্বিকার মনোভাব অব্যাহত ছিল৷ সাহিত্য, রাজনীতি, দলবাজিতা কিংবা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি তিনি পছন্দ করতেন না৷ সচেতন ভাবেই তিনি এ ধরনের প্রচেষ্টা থেকে নিজেকে রেখেছেন মুক্ত৷ অন্যদিকে নিজের কবিতাকেও রেখেছেন নিরাপদ দূরত্বে৷ তাঁর এমন নির্মোহতা প্রচণ্ড প্রাণ শক্তির পরিচয় বহন করে৷ আত্ম প্রচারণামুখর হৈচৈয়ের সময়ে আহসান হাবীব অন্তর্গত জগতেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন৷ কলেজ জীবনে পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্যই কলকাতায় যাননি তিনি৷ অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে ছিল সাহিত্যের প্রতি আজন্ম ভালবাসা৷ সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন কাব্যচর্চা আর সাহিত্য সাধনায়৷ গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, এমনকি গানও লিখেছেন৷ ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় বেশ কিছু উত্‍কৃষ্ট দেশাত্নবোধক গান রচিত হয়েছিল৷ আহসান হাবীবের - দুর্গম এ যাত্রাপথে কোনো বাধা মানব না এ গানটি সে সময়েরই লেখা এবং তাঁর লেখা এই গানটি বেশ সুনাম কেড়েছিল৷ তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস , ছড়াগান ও অনুবাদকার্য ছড়িয়ে থাকলেও আহসান হাবীব মূলত কবি৷ সময়ের প্রয়োজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোয় আগ্রহী হয়ে উঠলেও কবিতায়ই ছিল তার মূল আগ্রহের জায়গা৷ শৈশবে, কৈশোরে ও পারিবারিক অনুকূল আবহে সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালবাসা ছিল এবং সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই ভালবাসা ছিল মুত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ৷ তাঁর প্রথম কবিতার বই রাত্রি শেষে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কমরেড পাবলিশার্স থেকে৷ প্রকাশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ৷ আহসান হাবীবকে বলা হয় মৃদুভাষী কবি৷ কিন্তু স্বয়ং কবি এ ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন৷ বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান ) শুরুর দিকে অস্থির সময়ে তিনি লেখালেখি করেছেন একাগ্রতার সঙ্গে৷ জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বারবার স্থান বদল করলেও শেকড়ের প্রতি তিনি ছিলেন আজন্ম দায়বদ্ধ৷ আর তাই সাহিত্যের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন দেশ, মাটি, মানুষ, নিসর্গ ও প্রেম৷ শৈশবে বেড়ে ওঠা জন্মগ্রাম শংকরপাশা আর পারিবারিক অর্থনৈতিক দূরাবস্থার প্রভাব তাঁর সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে৷ মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন মিলিয়ে দেখেছেন তিনি৷ নীরিহ মানুষের জীবন, বৈষম্য, বন্টন, পরাধীনতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের দায় প্রভৃতি বিষয় ফুটে উঠেছে তাঁর রাত্রি শেষে নামক প্রথম গ্রন্থে ( কবিতা )৷ পরবর্তী সময়ে ছায়া হরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দুই হাতে দুই আদিম পাথর এবং প্রেমের কবিতা সহ বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি তাঁর কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন৷ এসব গ্রন্থে ঐতিহ্য, চেতনা, দেশপ্রেম ও মধ্যবিত্ত সুলভ আশাবাদের বিশ্বাস রয়েছে৷ বিষয়গত বৈশিষ্ট্য ছাড়া কবিতায় শব্দের নিজস্ব ভঙ্গি লক্ষণীয়৷ নদী মাতৃক গ্রাম বাংলার নিসর্গ সৌন্দর্যকে তিনি ওই শব্দের ব্যাবহারে চিত্রময়তা দিয়েছেন৷ প্রকৃতি ও মানবজীবন ঘিরে যে বৈপরীত্য রয়েছে তা চমত্‍কার ভাবে তাঁর কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে৷ শিশুতোষ লেখায়ও আহসান হাবীবের সাবলীল বিচরণ ছিল৷ সত্তর দশকে শিশু সাহিত্য রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন৷ শিশুকিশোর রচনার ঢং, বক্তব্য ও চিন্তা-চেতনায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন ব্যাঞ্জনা৷ ছুটির দিনদুপুরে, 'পাখিরা ফিরে আসে এ দুটি বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ৷ এছড়া শিশুকিশেরদের জন্য লেখা তাঁর অন্য গ্রন্থগুলি হলো বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, রেলগাড়ি ঝমামমে, রাণীখালের সাঁকো, জো্যত্‍স্না রাতের গল্প, ছোট মামা দি গ্রেট ইত্যাদি৷ সাহিত্য সাধনায় স্বীকৃতি স্বরূপ আহসান হাবীব ১৯৬১ সালে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার ও একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন৷ আদমজী পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৬৪ সালে, ১৯৭৭ সালে অর্জন করেন নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, ১৯৭৮ সালে লাভ করেন একুশে পদক এবং আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮০ সালে৷ পিরোজপুর থেকে রাজধানী কলকাতা৷ আবার সেখান থেকে রাজধানী ঢাকা আসেন আহসান হাবীব ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে৷ এখানে এসেও চাকরি নেন দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদীতে৷ পরে দৈনিক ইত্তেহাদ, সাপ্তাহিক প্রবাহেও কাজ করেন৷ ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যনত্ম তিনি ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামসে আ্যডভাইজার হিসেবে চাকরি করেন৷ এক সময় তিনি নিজে একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সর্বশেষ কাজ করেছেন দৈনিক বাংলায় (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান )৷ এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই (১৯৬৪) এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জীবনের বাকি সময়টা এখানেই কাজ করেছেন তিনি৷ দিনটি ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই৷ এদিনটিতেই ৬৮ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যগ করেন বাংলা সাহিত্যের স্বনামধণ্য এই কবি৷ সংক্ষেপে আহসান হাবীব জন্ম: আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে৷ পিতার নাম হামিজুদ্দীন৷ মাতা জমিলা খাতুন৷ তাঁর পাঁচ ভাই চার বোন৷ অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পিতা মাতার প্রথম সনত্মান তিনি৷ ৷ শৈশব ও পড়ালেখা: আহসান হাবীবের শৈশব কাটে শংকর পাশা গ্রামেই৷ পড়ালেখা করেন পিরোজপুর জেলার গভর্নমেন্ট স্কুলে৷ তিনি ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে ভর্তি হন বরিশালের বিখ্যাত বিএম কলেজে৷ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য তিনি এরপর আর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেননি৷ কাজের খোঁজে পাড়ি জমান তত্‍কালীন রাজধানী কলকাতায়৷ পরিবার: বিবাহিত জীবনে তিনি ছিলেন চার সন্তানের জনক৷ শ্বশুড় বাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়৷ স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া৷ সস্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ৷ দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী৷ ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক৷ বাবার মতো তিনিও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত৷ তিনি বাংলা মূলধারার কথাসাহিত্যের একজন জনপ্রিয় কথাশিল্পী৷ এছাড়া প্রকাশক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে৷ ছোট ছেলে মঞ্জুরম্নল আহসান জাবেদ আমেরিকা প্রবাসী ৷ পেশা: কলকাতায় যেয়ে তিনি প্রথমে কাজ শুরু করেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত দৈনিক তকবীর পত্রিকায়৷ পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতাতেই কাজ করেন তকবীর, (১৯৩৭ ) বুলবুল, (১৯৩৭- ৩৮ ) মাসিক সওগাত, (১৯৩৯-৪৩ ) প্রভৃকি পত্রিকায়৷ এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ৪৭ সাল পর্যনত্ম কাজ করেন৷ দেশভাগের পর আহসান হাবীব রাজধানী ঢাকা আসেন ১৯৫০ এর দশকে৷ এখানে এসেও চাকরি নেন দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদীতে৷ পরে দৈনিক ইত্তেহাদ, সাপ্তাহিক প্রবাহও কাজ করেন৷ ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগামসে আ্যডভাইজার হিসেবে চাকরি করেন৷ এক সময় তিনি নিজেও একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সর্বশেষ কাজ করেছেন দৈনিক বাংলায় (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান)৷ এ পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই (১৯৬৪ ) এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ মৃত্যু: ১০ জুলাই ১৯৮৫ সালে আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন৷

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।