আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হজরত শাহ জালাল: আর সেই তিন কাঠুরিয়া-কন্যা।

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

১৯৯২ সাল। এক বন্ধুকে নিয়ে সিলেট গেছি; বেড়াতে। তো দিনের বেলায় শহরে লাক্কাতুরা, শহরের বাইরে জাফলং ইত্যাদি ঘুরে বেড়াচ্ছি।

তিনবেলা হজরত শাহ জালালের দরগায় যাই। সিঁড়ির ওপর বসে থাকি। মাজারময় কেমন একটা পুরনো গন্ধ। আগরবাতির গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে।

পুরনো গন্ধ কত কথা যে বলে। একদিন সন্ধ্যায় দরগা থেকে বেড়িয়ে হাঁটছি। ভাদ্র মাস। ঝিরঝির বৃষ্টি। হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে হল না।

রাতে খেয়ে একবারই ফিরব। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল আবার জাফলং যাব। ফুটপাত ঘেঁষেই একটা শপিং কমপ্লেক্স; কিছু করার নেই। ঢুকলাম ভিতরে, তখনও জমে ওঠেনি।

কেমন ফাঁকা। একটা দোকানে ঢুকলাম। এটা সেটা দেখছি। লাইটার, পেনসিল ব্যাটারি। দোকানের মালিক তরুন।

বেশ স্মার্ট। ফরসা। কালো রঙের টিশার্ট পরেছিল। বয়স এই পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। কথায় কথায় পরিচয় হল।

নাম বলল ইমরান। সিলেটের স্থানীয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনে চেখেমুখে সমীহ ভাব ফুটল। বিনয়ের সঙ্গে বলল, পড়াশোনা তেমন শেষ হয়নি। কয়েক বছর লন্ডন ছিল।

ফিরে এসে এই দোকান দিয়েছে। দোকানে একটা পিচ্ছি ছিল। ইমরান ওকে চা আনতে বলল। আমাদের বসতে বলল। কয়েকটা টুল ছিল।

আমরা টুলের ওপর বসলাম। ইমরান জিজ্ঞেস করল, সিলেটে আসছেন, শাজালালোর মাজারে গেছেন না? হ্যাঁ। বললাম। আমি আগে মাজারে যাইতাম না। এখন রেগুলার যাই।

ইমরান বলল। মানে? আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। ইমরান বলল, বিয়ের পর অনেকদিন ছেলেমেয়ে হয়নি। বউয়ের মুখ কালো। তখন মানত দরগায় করছিলাম।

গত বছর আমার বউয়ের একটা ছেলে হয়েছে। বলে লাজুক হাসল। ও। ইমরান বলল, আমি এখন রেগুলার মাজারে যাই। আমার বউও যায়।

কান্দে। হজরত শাজালাল সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করি। কত কিছু যে জানলাম। আমাদের হাতে কাজ নাই। বললাম, বলেন শুনি, কী জানলেন।

ইমরান বলল, এই যেমন ধরেন-অনেকে মনে করে যে ওনার জন্ম ইয়েমেনে। কথাটা ঠিক না। আমিও তেমনই জানতাম। অবাক হয়ে বললাম, তা হলে? ওনার জন্ম ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে কোনিয়ায়। কোনিয়া হইল তুরস্কে।

ও। হজরত শাজালালের পুরা নাম শেখ উল মাশায়েক মখদুম শেখ শাহ জালাল মোজোরোধ বিন মুহাম্মাদ। তার বাবা ছিলেন মওলানা জালালউদ্দীন রুমী সমসাময়িক। রুমীর মাজারও তুরস্কের কোনিয়ায়। পূর্ব পুরুষ আসছিল ইয়েমেন থেকে।

এ জন্য শাহ জালালকে মোজোরোধ-ই- ইয়েমেনী বলা হয়। আমি এবার বেশ অবাক হলাম। ইমরান দেখছি অনেক কিছু জানে। আসলে বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্ছা হয়নি। বিপদে পড়েছিল।

হয়তো বউ ... মানুষ তো অসহায়। তখন শাহ জালালের দরগায় মানত করে। তারপর বাচ্চা হয়েছে। কৃতজ্ঞতাসরুপ এখন দরবেশকে নিয়ে গবেষনা করছে। ভাল।

আমাদের কত কথা জানা হল। পিচ্ছি চা নিয়ে এল। আমরা চায়ে চুমুক দিলাম। ইমরান বলল, শাজালাল তাঁর মামার কাছে মানুষ। মক্কায়।

মামার নাম সৈয়দ আহমেদ কবির। কোরান হেফজ করলেন। ইসলাম নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করলেন। Legend has it that one day his uncle gave him a handful of earth and ask him to go to Hindustan with the instruction that whichever place in Hindustan matches this earth completely in smell and color, he should settle down for preaching and establishing Islam. আমি তখন সিগারেট খেতাম। চা শেষ করে ধরালাম।

বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। তার ক্ষীন শব্দ পেলাম। অল্প শীত করছিল। আতরের ক্ষীন গন্ধ পেলাম যেন। শাহ জালালের দরগার সিঁড়ির ওপর বসে থাকার সময় যেমন পুরনো গন্ধ পাই-অনেকটা সে রকম।

দরগায় আগরবাতির গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে। পুরনো গন্ধেরা কত কথা যে বলে। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ। ইমরান বলল।

শাহ জালাল রওনা হলেন পুবে। পুবে ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষে তখন সম্মানিত পির (পির বানান ঠিকই আছে। বিদেশি শব্দ -িকার) ছিলেন আজমিরের খাজা বাবা, দিল্লীর নিজামউদ্দীন আউলিয়া প্রমূখ। শাজালাল বাবা সব বুগর্জ পিরের সঙ্গে দেখা করলেন।

ওইখান থেকেই ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়া সিলেটে আসলেন। মামা সৈয়দ আহমেদ কবিরের দেওয়া মাটির সঙ্গে মিল হইল সিলেটের মাটির। কাজেই এই মাটিতেই আস্তানা হইল বাবা শাজালালের। ইমরানের কথায় গর্বের সুর ফুটল। এরপর ইমরান যা বলল তাতে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে গেলাম।

সেই বিস্ময়ের ঘোর এতদিন পরেও কাটেনি। সেই ঝিরঝির বৃষ্টির সন্ধ্যায় ইমরাম যা বলল- তা আমি এখানে গুছিয়ে লিখছি। একদিন। শাহ জালাল তাঁর আস্তানায় বসে আছেন। এমন সময় একজন লোক তাঁর কাছে এল।

কে তুমি? শাজালাল জিজ্ঞেস করলেন। লোকটা বলল,আমি একজন গরীর কাঠুরিয়া। তো? লোকটা এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুজুর। আমার ঘরে তিনটি বিবাহযোগ্যা কন্যা রয়েছে। আমি গরীর মানুষ-ওদের বিবাহ দিতে পারছি না।

আপনি যদি দয়া করে আপনার তিনজন্য শিষ্যর সে তুমি কাঠুরিয়া। না? জ্বী। হুজুর। ঠিক আছে। তুমি কাল ফজর নামাজের পরে এসো।

দেখা যাক কি করতে পারি? পরের দিন; ভোরবেলা। গরীব কাঠুরিয়া আস্তানায় এল। এসে তো সে অবাক। কারণ। হজরত শাজালালসহ তিনশো ষাটজন আউলিয়ার পরনে কাঠুরিয়ার পোষাক।

হাতে কুঠার। কাঁধে থলে। কী ব্যাপার? হযরত শাজালাল বললেন, আমরা আজ কাঠ কাঠতে যাব। কাঠুরিয়া স্তম্ভিত। সে আর কি বলবে।

সে দলটাকে অনুসরন করে। এখনকার সিলেটের লাক্কাতুরা তখন গহীন অরণ্য। কাঠ কাটতে দরবেশরা সবাই সেই বনেই গেল। সারা দিন কাঠ কাটা হল। দুপুরে আহার করলেন, গরীর কাঠরিয়ারা যা করে তাই।

সন্ধ্যের আগে আগেই দরবেশরা কাঠ কাঁধে নিয়ে ফিরে এলেন আস্তানায়। হজরত শাহ জালাল বললেন, আজ আমরা কি করলাম? কাঠ কাঠলাম। আউলিয়ারা সমস্বরে বললেন। তা হলে আমরা কাঠুরিয়া? (অন্তত একদিনের জন্য হলেও) হ্যাঁ। তা হলে এবার বল এই গরীব কাঠুরিয়ার তিন মেয়ে কে কারা কারা বিবাহ করবে? হাত অনেকেই তুলেছিল।

শাহ জালাল তিনজনকে বেছে নিলেন। বলে ইমরান আমাদের দিকে তাকাল। তার মুখে মিটমিট হাসি। বলল, কি বুঝলেন? কী আর বুঝব। আমি আমার বন্ধু রুকসারের দিকে তাকালাম।

ও কেমন ঘোরে আছে বলে মনে হল। আমারও কেমন ঘোর লাগল। হজরত শাহ জালাল জাঁদরেল পির। গরীব কাঠুরিয়ার তিন মেয়েকে বিয়ের করার জন্য শিষ্যদের তিনি আদেশ করলেই পারতেন। কিন্তু, তিনি নিজে কাঠ কাঠতে গেলেন কেন? সারদিন লাক্কাতুরার জঙ্গলে অত কষ্ট করলেন কেন? রোদে পুড়লেন।

ঘাম ঝরালেন। কেন? গরীর কাঠুরিয়ার তিনটে মেয়ের কথাও আমার মনে পড়ল। আজও আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে হওয়া- না হওয়াটা বিশাল এক প্রশ্ন। বিয়ে প্রতিদিনই হচ্ছে; তবে তার পিছনের ইতিহাস অত সরল না। সেই সাত/আটশ বছর আগে তিনটি মেয়ে।

তার ওপর বাবা গরীব কাঠুরিয়া...পিরের বদান্যতায় আউলিয়া বর পেয়েছিল তারা। তারা কি সুখি হয়েছিল? যখনই সিলেট যাই- তিনবেলা হজরত শাহ জালাল দরগায় সিঁড়ির ওপর বসে থাকি। মাজারজুড়ে কেমন একটা পুরনো গন্ধ। আগরবাতির তীব্র গন্ধ। কেমন ঘোর লাগে।

পুরনো গন্ধরা কত কথা যে বলে। ইমরানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। ন'টার মতো বাজে। শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে রাস্তায় অন্ধকার। অন্ধকার আর ঝিরঝির বৃষ্টি।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম: হজরত শাহ জালাল নিশ্চয়ই সেই তিনটে গরীব মেয়ের অসহায় অবস্থার কথা উপলব্দি করেছিলেন। বিয়ে হচ্ছিল না ...সহসা অনেক দিন আগে পড়া ইসলামের নবীর একটি হাদিস মনে পড়ল। The Prophet said, “(It happens that) I start the prayer intending to prolong it, but on hearing the cries of a child, I shorten the prayer because I know that the cries of the child will incite its mother’s passions.” আল-বুখারি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছি। শীত করছিল।

আমার মুখ চোখে বৃস্টির বিন্দু। চশমার কাচে জলবিন্দু। ঝাপসা দেখছি। একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবলাম: নারীর নিভৃত কান্না মহাপুরুষরা কখনও এড়িয়ে যাননি।

যাওয়ার কথাও নয়। আমি আজও ভাবি: হজরত শাহজালাল নিজে কাঠ কাটতে গেলেন কেন? সারদিন অত কষ্ট করলেন কেন? সূত্র: Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.