আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রবিঠাকুরের শাহজাদপুরে

প্যাটে ক্ষিদা, খাওন দে

গাবতলী থেকে সাভার; কালিয়াকৈর থেকে এলেঙ্গা বাজার− আজ আর হারাতে যেন মানা নেই, মানা নেই হারিয়ে যেতে বহু দুর, গ্রীষ্ক্নের খরতাপ উপেক্ষা করে পৌঁছে যেতে উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর। শাহজাদপুর ট্রাভেলসের বাস থেকে নামলাম দিলরুবা বাসস্ট্যান্ডে। খুব স্বাভাবিকভাবেই রিকশা নিলাম এরপর। জয় নামের সিনেমা হলটি পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে এগোলাম কান্দাপাড়া দিঘির পাড়ের দিকে। দিঘির পাড়ের বাঁ দিকে ইট বিছানো রাস্তা।

সে রাস্তায় ঢুকতেই চোখে পড়ল রবীন্দ্রনাথের স্নৃতিবিজড়িত কাচারিবাড়ির লোহার গ্রিল দেওয়া গেট। গেট পার হয়ে ঢুকলাম ভেতরে, পা রাখলাম শান বাঁধানো সরু পথে−যে পথের শেষ মাথায় হলদে রঙের প্রলেপ জড়ানো দ্বিতল কাচারিবাড়ির সৌম্য কাঠামো। এখান থেকেই শাহজাদপুর জমিদারি পরিচালনা করতেন কবিগুরু রবিঠাকুর। ইউসুফ শাহী পরগনার অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুর নামে এই জমিদারিটি কেনেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায়। নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির বিরাট একটা অংশ তখন নিলামে উঠেছে।

শাহজাদপুরের অংশটা সে সময় মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় কেনা। রবিঠাকুর এখানে প্রথম আসেন ১৮৯০ সালের গোড়ার দিকে। তবে স্থায়ীভাবে জমিদারি পরিচালনার নির্দেশ তিনি পান দ্বিতীয়বার বিলেত থেকে ফিরেই। যদিও রবীন্দ্রনাথের হাতে এই জমিদারি পরিচালনার ভার অর্পিত হওয়ার মাত্র বছর পাঁচেক পরই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভ্রাতুষ্কপুত্রদের জমিদারি ভাগ করে দেন। ভাগাভাগিতে শাহজাদপুরের এই জমিদারির মালিক হন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অতএব, সংগত কারণেই রবীন্দ্রনাথ চলে যান নিজস্ব জমিদারি এলাকা শিলাইদহ, পতিসরে; আর পেছনে কবিগুরুর অজস্র স্নৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শাহজাদপুর কাচারিবাড়িটি। কাচারিবাড়ির মূল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্রস্নৃতি জাদুঘর। সেখানে ঢোকার মুখেই বড় একটা নিমগাছ। তারপর প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা পার হয়ে প্রথম যে ঘরটি, সেখানে রবিঠাকুর ব্যবহূত বড় বড় দুটি খাট, দেয়ালে বাঁধানো ফটোগ্রাফস আর কবির আঁকা বিভিন্ন ছবির প্রতিলিপি।

প্রথম ঘরটির ডান পাশে আরেকটি ঘর প্রদর্শনসামগ্রীতে সাজানো। তার ঠিক পাশে অর্থাৎ ভবনটির পশ্চিম কোণে ছোট ছোট দুটি ঘর অব্যবহূত বর্তমানে। এ ধরনের আরও দুটো ঘর ভবনের পূর্ব কোণেও রয়েছে, যার মধ্যে একটি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করা হয় কেয়ারটেকারের অফিস হিসেবে−জানালেন জাদুঘর পরিচারক মো. মোসলেমউদ্দীন। মো. মোসলেমউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়ালাম উত্তরের বারান্দায়। সে বারান্দার সামনের উঠোন পেরিয়ে লোহার একটা বিশাল ফটক।

বর্তমানে বন্ধ এ ফটকটিই আসলে কাচারিবাড়ির প্রধান প্রবেশপথ। উত্তরের এ দিকটিই আসলে কাচারিবাড়ির সম্মুখ অংশ। ১৯৬৯ সালে ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই শাহজাদপুর কাচারিবাড়িটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে, তখন মানুষ এ পথেই এ বাড়িতে ঢুকত। ঢোকার মুখেই তখন বট-অশ্বত্থের লম্বা সারি ছিল, তার পরই ছিল কবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের নামে প্রতিষ্ঠিত দ্বারিকাপুর বাজার। তারপর ছিল বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপর কাচারিবাড়ির প্রধান প্রবেশপথ।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাজারের পরিধি বিস্তৃত হতে হতে একসময় ছুঁয়ে ফেলে নিচু দেয়ালঘেরা কাচারিবাড়ির প্রধান প্রবেশপথ। লোকচলাচলে সৃষ্টি হয় বিঘ্ন। সম্ভবত ২০০০ সালের জুন মাসের পর কোনো একসময় একান্ত বাধ্য হয়েই উত্তরের এ প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ; সর্বসাধারণের জন্য কাচারিবাড়ির দক্ষিণ দিকে ব্যবস্থা করে বর্তমান প্রবেশপথটির। বারান্দার পশ্চিম কোণে সিঁড়িঘর। সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলাম দোতলায়।

জাদুঘরের এ তলে প্রদর্শনীকক্ষ পাঁচটি। এ তলেরও উত্তর-দক্ষিণে নিচতলার অনুরূপ বারান্দা। ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হওয়ার আগে পাকা এ ভবন ছিল নীলকর সাহেবদের কুঠিবাড়ি। এ কুঠিবাড়ি চত্বরের পশ্চিমে একসময় ছিল কাচারি, যে কারণে বাড়িটিকে পরবর্তীকালে কাচারিবাড়ি নামেই চিনত সবাই। তখন এ বাড়িতে মালখানা ছিল, কর্মচারীদের বাসস্থান ছিল আর ঠাকুরদের আমলে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল এডওয়ার্ড লাইব্রেরি, বাবুর্চিখানা এবং বাড়ির পূর্ব দিকে একতলার লাগোয়া অংশে ছোট একটি পোস্ট অফিস।

যদিও সেসব স্নৃতির প্রায় কিছুই নেই এখন, তবে পোস্ট অফিসের খানিকটা চিহ্ন পুরোনো একটা আমগাছের ছায়ায় এখনো যে বিদ্যমান, তা দেখালেন অডিটরিয়াম অ্যাটেন্ডেন্ট আবদুল মালেক। কাচারিবাড়ির পশ্চিমে বাঁধানো বকুলতলা। বকুলতলার দক্ষিণে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত ভবনটিই অডিটরিয়াম। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টডিয়ানের অফিসও সে ভবনেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কাস্টডিয়ান নাহিদ সুলতানা নাজনীনের অবর্তমানে অফিস সহকারী মো. আলীর সঙ্গে কথা হলো অনেকক্ষণ।

সেসব কথার পুরোটাই নিঃসন্দেহে কবির ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবনকেন্দ্রিক। মো. আলীর মতে, শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ির হাওয়া-জল-মাটি যে ভাব সঞ্চারিত করেছিল একদিন রবিঠাকুরের অন্তরের অন্তস্তলে, তার সুললিত নির্যাসই বিসর্জন নামের সার্থক নাটক; ছুটি, অতিথির মতো চমৎকার গল্প; সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালির বহু কবিতা; ছিন্নপত্রাবলির নানা পত্রসহ প্রচুর রচনা। এ রচনাগুলো কি কবিগুরুর ব্যক্তি ও সাহিত্যজীবনকেই ঋদ্ধ করেছে কেবল? মোটেই না, বরং তা সাহায্য করেছে বাঙালির জীবনদর্শন বিনির্মাণেও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।