আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উকুন বাছা দিন। ১০। রাজসাক্ষী

মাহবুব লীলেন
বাড়িটার ছবি অনেকবার দেখেছি পত্রিকায়। এই বাড়ি নিয়ে প্রায়ই খবর ছাপা হয়। সঙ্গে ছবি। দুয়েকবার চোখ বুলিয়ে জেনেছি একজন আমলার বাড়ি ওটা। যার হাত-পা অনেক লম্বা ও শক্ত রাজধানীতে মাঝে মাঝে এলে ওই বাড়িটার কাছেই একটা আস্তানায় আমাকে উঠতে হয়।

পাশ দিয়ে যেতে-আসতে ছবির সাথে মিলিয়ে নিজেই চিনে নিয়েছি বাড়িটা। সামনে পুলিশ পাহারা। ঢুকবার দরকার কিংবা সাহস কোনোটাই কোনোদিন হয়নি উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়িটায় রাত সাড়ে নয়টা। বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেক্ষণ। রাস্তায় হাঁটছি।

অন্ধকার ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সিগারেট বাড়িয়ে দিলো আব্দুল হাই। গরমের রাতে লোডশেডিংয়ে অনেকেই রাস্তায় হাঁটে। কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করলাম না কোথায় যাব- না যাব। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হাঁটছি চুপচাপ। বাড়িটার কাছাকাছি চলে এলাম।

আব্দুল হাই দ্রুত তাকাল আশেপাশে। একটা পুলিশ ভ্যান পাশ কেটে গেল। একটু থামল সামান্য দূরে। আবার গেল। আব্দুল হাই ঘুরে দাঁড়াল- চলেন ওদিকে হাঁটি আবার এবং আবার।

তৃতীয়বার বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল আব্দুল হাই। আশপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল- একটু কাজ ছিল আমার এখানে। চলেন আমার কোনো কাজ নেই। বিদ্যুতের অপেক্ষা আমার কাজ। গেলাম।

বাড়িটাতে নিজস্ব বিদ্যুৎ। একটা প্রাসাদ। বাগান। পার্ক। সুইমিংপুল... আধুনিক রাজবাড়িতে যা যা থাকে সব।

আব্দুল হাই বাড়ির বর্ণনা দিতে দিতে গিয়ে দাঁড়াল রাজবাড়ির বারান্দার নিচে - স্যার আছেন? নিচ থেকে আব্দুল হাইর ডাক শুনে পর্দা সরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন একজন প্রচলিত মা - নয়ন এসেছিস? বস। আমি তোর চা বানিয়ে আনি আমি অবাক। আমাকে চেনার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন। এবং দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরলে আমার মা যা করেন ঠিক তাই করলেন।

একই স্বর। একই চেহারা। একই অভ্যর্থনা আব্দুল হাই নির্লিপ্ত। বারান্দার নিচে ডান দিকে তিনটা সোফা পাতা। বুঝতে পারলাম না ওগুলো সিঙ্গেল না ডাবল সোফা।

সিঙ্গেল থেকে একটু বড়ো আর ডাবল থেকে একটু ছোট দুজনেই একটা সোফায় বসলাম। দেহের আকারের জন্য গা-ঘেঁষাঘেষি করে বসতে পারলাম উল্টো দিকে একটা বিশাল চেয়ার। অথবা একটা বড়োসড়ো খাটকে রেলিং লাগিয়ে চেয়ার বানানো হয়েছে। রেলিংটা আল্পনা করা সেগুন কাঠের। উঠতে উঠতে ঠেকেছে ছাদ পর্যন্ত।

চেয়ারটার পাশেই একটা সাদামাটা তক্তার চৌকি। উঁচু বারান্দাতেও একটা চৌকি; তবে তাতে ভারি জাজিম বিছানো পর্দা সরিয়ে এলেন আব্দুল হাইর স্যার। চিনলাম। ইনি সেই আমলা। সাবা করিম।

ষাটের কোঠায় বয়স। থলথলে শরীর। ঝুঁকে পড়া দেহ। উঠে সালাম করার আগেই বললেন- বসো নয়ন আমি বসলাম না। ভদ্র্রলোক সরাসরি তাকালেন- এ্যম্বেরাস্ড ফিল করছ? - অবাক হচ্ছি।

আপনারা আমার নাম জানলেন কী করে? - নাম নয় অনেক কিছুই জানি। লোডশেডিংয়ে তুমি রাস্তায় হাঁটো তাও জানি। আজকের লোডশেডিং তোমার জন্যই করা। আজকে এ বাড়িতে আমরাই তোমাকে এনেছি - কিন্তু কেন - কাজ আছে। আমাকে সাহায্য করবে তুমি ভদ্রলোক আমলা স্টাইলে নির্দেশ দিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।

আব্দুল হাই চুপসে গেছে। কিছু টোকাই এবং দিনমজুর এসে বসল উল্টোদিকের তক্তার চৌকিতে। তাদের মাঝখানে একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকও বসেছেন আসন করে। উনি সাবা করিমের বেয়াই। বড়ো মেয়ের শ্বশুর অনেকগুলো কাগজপত্র নিয়ে ঢুকলেন সাবা করিম।

আসন করে বসলেন উল্টো দিকের রাজকীয় চেয়ারে। কাগজ নাড়তে নাড়তে আমার দিকে না তাকিয়ে আমাকেই বলতে শুরু করলেন- বোঝোইতো সরকারি চাকরি করি। তার উপর রিটায়ারমেন্টের সময়; কত লোককে ট্যাক্স দিয়ে চলতে হয়। মন্ত্রী- রাজনীতিবিদ- কলিগ। তার উপর আছে পত্রিকাওয়ালারা আব্দুল হাই কাচুমাচু করে কী একটা বলল।

কিছুই বুঝলাম না। সাবা করিম আগের মতোই বলে চলেছেন- আমার একটা গবেষণাপত্র বেরিয়েছিল পত্রিকায়; বৃক্ষ ও মানুষের যৌন জীবন। অবশ্য ওসব পত্রিকা তোমার পড়ার কথা না। ধর্ম ও বিজ্ঞানমতে কীভাবে বৃক্ষ ও মানুষের যৌনজীবন হওয়া উচিৎ এবং কীভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করে বৃক্ষ ও মানুষের যৌনবিনিময় হতে পারে সেটাই ছিল আমার গবেষণার বিষয়। আমি ত্রিশ বছর গবেষণা করে লিখেছি ওটা।

অনেকগুলো নতুন বিষয় আবিষ্কার করেছি আমি। মানুষ ও বৃক্ষকে অনেকগুলো ধর্ম ও বিজ্ঞানসম্মত যৌনপথ দেখিয়ে দিয়েছি আমি সাবা করিম সম্ভবত কী একটা খুঁজছেন। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে আরো এলোমেলো করে দিচ্ছেন সব। খুঁজতে খুঁজতে কিংবা এলোমেলো করতে করতে বলে চলেছেন- লেখাটা ছাপা হওয়ার আগে আমি আইনজীবীদের সাথে আলাপ করেছি। কী কী বিষয়ে সমালোচনা আসতে পারে এবং এলে কী কী উত্তর দেয়া হবে তাও আগেই লিখে রেখেছি।

কোন উত্তরটা আমার পক্ষে কার নামে যাবে সবই ঠিক করে রেখেছি। এমনকি কারা কারা আমার পক্ষে বিবৃতি দেবেন তাও ঠিক করে- বিবৃতি দেয়ার জন্য সম্মানীর টাকা পুরোটাই অগ্রিম পরিশোধ করেছি। আমার পক্ষে সব ধরনের লোকই ছিল। বিজ্ঞানী- ধর্মীয় নেতা- বুদ্ধিজীবী- আমলা- সাংবাদিক- সাহিত্যিক- রাজনীতিবিদ... সবই ছিল খেয়াল করলাম সাবা করিমের চেয়ারের পাশে তার থেকে একটু কম বয়সের আরো দুজন লোক। তারা অনবরত সাবা করিমকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে।

তার স্ত্রীও আছেন। সেই মহিলা। আমার চা আনেননি। মাথা নিচু করে বসে আছেন সাবা করিমের পাশে - বুঝলে... গবেষণাপত্রটা ছাপা হওয়ার পর মন্ত্রীরা এবং সরকারি দল সমালোচনা করল। বলল আমি বিরোধী দলকে আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করে দিয়েছি।

বিরোধী দল আড়াই দিনের হরতাল করল... বিবৃতি দেয়ার জন্য যাদের পয়সা দিয়েছিলাম প্রায় সবাই বিবৃতি দিয়েছে। শুধু চারজন দেয়নি। ওরা নাকি আমার লেখা বিবৃতির কপিটা হারিয়ে ফেলেছে। আসোলে ওসব কিছু না। হয়ত বিবৃতি না দেয়ার জন্য কেউ ওদের টাকা দিয়েছে।

কিন্তু... সাবা করিম আর তার স্ত্রী উঠে গেলেন ভেতরে। উল্টোদিকের তক্তার খাটে লোকসংখ্যা আরো বেড়েছে। সাবা করিমের বেয়াই খুব রসিয়ে কী একটা কাহিনী শোনাচ্ছেন সবাইকে। কিন্তু কেউ শুনছে বলে মনে হয় না। বয়স্ক দিনমজুররা একজন আরেকজনের উপর ঠেস দিয়ে ঝিমুচ্ছে।

ছোট টোকাইরা বসার জায়গা নিয়ে হাতাহাতি করছে। আর বেয়াই বারবার একেকজনকে হাত দিয়ে ঠেলছেন- এই শোনো না। তারপর কী হলো শোনো... তারপরতো আমি... হা হা হা... একাই হাসছেন তিনি আরো অনেকগুলো কাগজপত্র নিয়ে ঢুকলেন স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই বসলেন বারান্দার জাজিমপাতা খাটে। এবার তারা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাগজপত্র পড়ায় আমার চোখ মাটির দিকে।

ভাবছি। আমাকে এখানে আনার কী অর্থ? কী সাহায্য করব আমি? আমার ডান পা মাড়িয়ে হাঁটু ঘেঁষে একটা জিন্স-কেড্স পরা পা দাঁড়াল এসে। আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ঝুঁকে কথা বলতে শুরু করল আমার ডান পাশে বসা আব্দুল হাইর সাথে আমার পা এখনও ওর পায়ের নিচে। কী রকম বেয়াদব ছেলে। আমি বিরক্ত হয়ে মুখ তুলতেই থমকে গেলাম।

আমার নাক গিয়ে ঠেকল তার বুকের মাংসে। ছেলে নয় মেয়ে। মাথায় ওড়নার বড়ো ঘোমটা। বুকে শুধুই ব্রা আব্দুল হাই হুড়মুড় করে বলে উঠল- আমি না- আমি না ...ওসব কাজ ও ভালো পারে। মেয়েটি আমার দিকে তাকাল।

আবার আব্দুল হাইর দিকে- উনিতো বাউল। ধরা মুশকিল। আমার পা থেকে নিজের পা তুলে নিলো সে - আমাকে বললেই আমি ধরে দেবো। গর্বের সাথে বলল আব্দুল হাই মেয়েটির জিন্সপরা ঊরুতে বাম হাতের আলতো চাপ দিয়ে বললাম- নিজেই ধরা দেবো যদি মাঝে মধ্যে আশীর্বাদ করেন - যাহ্ আরেকটু লম্বা করে ঘোমটা টেনে গেটের দিকে এগুলো মেয়েটি। ফিরে একটা হাসি দিলো।

ডাক দিলাম ওকে। ইশারায় - না আপনি খুব অসভ্য - সভ্যতা শিখিয়ে দিলেই শিখে নেব। আসেন মেয়েটি এল । কিন্তু আব্দুল হাইর কাছে। কানে কানে কী যেন বলল।

আমি ওকে টান দিয়ে নিয়ে এলাম কাছে। কানে কানে বললাম- জিন্সটা বড়ো বেশি লম্বা আর মোটা। ছোট কিছু পরবেন এবং পাতলা। তাইলেই ধরা দেবো নিজে থেকেই ভেংচি কেটে- ঘোমটা টেনে চলে গেল মেয়েটি সাবা করিম আর স্ত্রী পড়ছেন তখনও। উল্টোদিকের রাজকীয় চেয়ারে সাবা করিমের দুই সমর্থক ঘুমোচ্ছে।

সাবা করিমের বেয়াই আগের স্টাইলেই বলে যাচ্ছেন। আব্দুল হাই গালে হাত দিয়ে বসা ঠেসাঠেসিতে গরম লাগছিল। আমি উঠে পাশের ফাঁকা সোফায় বসলাম। দশ কি পনেরো মিনিট। হঠাৎ টের পেলাম আমার উপর নরম মাংসের চাপ।

সাবা করিমের মেয়ে। আগের মেয়েটার বড়ো বোন। গল্প-বলা বেয়াইর ছেলেবৌ। একটা ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে এসে ঠেসে বসেছে আমার সোফায়। নির্লিপ্তভাবে আমার উপর হেলান দিয়ে বাচ্চাকে মাই খাওয়াতে শুরু করল মেয়েটা তাকে ঠেলে আমি উঠে গেলাম আব্দুল হাইর সোফায়।

মাই খাওয়াতে খাওয়াতে মেয়েটি কটমট করে তাকাল আমার দিকে- কেন আরাম লাগেনি? সাবা করিম পড়ছেন। মারামারি করতে গিয়ে একটা বাচ্চা ছেলের লুঙ্গি খুলে গেল। সাবা করিমের বড়ো মেয়ে চিৎকার করে উঠল- সামলা সামলা গুপ্তধন ছেলেটা অনেক কষ্টে সামলে নিল কাপড় আমি দেখতে লাগলাম সবাইকে। সাবা করিম আর বেয়াই পরে আছেন লুঙ্গি। কিন্তু তাদের ব্যস্ততা আর অমনোযোগিতায় পোশাক না পরার অবস্থায় চলে গেছেন তারা।

বলব কি বলব না যখন দোটানায় আমি; হঠাৎ সাবা করিমের বড়ো মেয়ে চিৎকার করে ছড়া কাটতে শুরু করল- ওই দেখা যায় তালগাছ... ওই আমাদের গাঁ... ব্যস্ত হয়ে লুঙ্গি ঠিক করলেন দুজন আমি টয়লেট খুঁজতে লাগলাম। পেশাব করব। সাবা করিম যেন বুঝলেন। দারোয়ানকে বললেন- ওকে হাত ধরে নিয়ে যাও। ও চোখে দেখে না অবাক।

আমি সত্যিই দেখতে পাচ্ছি না। দারোয়ান হাত ধরে আমাকে নিয়ে গেল অনেক দূরে। টয়লেটে কাজ সেরে ঘুরতেই আয়নায় দেখতে পেলাম নিজের ছবি। আমি আবার দেখছি বের হয়ে দারোয়ানকে পেলাম না। একাই এগুলাম।

আমাকে চমকে দিয়ে একটা থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সেই মেয়ে। সাবা করিমের ছোট মেয়ে। মাথায় ঘোমটা। পোশাক বদলেছে সে। একটা ছোট বিকিনি এখন তার পরনে।

আলো-আঁধারিতে আরেকটু ঘোমটা টেনে খিলখিল করে হেসে উঠল- কি জনাব দেখতে পাচ্ছেন? চলুন আশীর্বাদ করি ১৯৯৯.০৯.১০ শুক্রবার ............................................ উকুন বাছা দিন প্রকাশক- শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ- শিশির ভট্টাচার্য্য। ২০০৫
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.