আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনামগঞ্জের কলের গ্রাম কালীপুর



হিমাদ্রি শেখর ভদ্র কলের গ্রামের সংপ্তি ইতিহাস পরিক্রমা : কালীপুর। সুনামগঞ্জ পৌরসভার একটি গ্রাম। কালীপুর গ্রামের উত্তর-দণি, পুর্ব-পশ্চিম চারদিকে ছোট ছোট হাওর। এটি হাওর বেস্টিত একটি গ্রাম। ভরা বর্ষায় চারদিক থৈ থৈ করে পানিতে তখন হাওড়ে নেচে বেড়ায় বাতাস আর ঢেউ।

শীত মৌসুমে বোরো ধানের চির সবুজের মেলা বসে হাওর জুড়ে। গ্রামের মানুষের রয়েছে একটি বিশেষ খ্যাতি। আর তা হলো গ্রামের অধিকাংশ প্রাচীন বসতির লোকজনের আদি পেশা কল-মেস্তুরী (টিউবওয়েল মেস্তুরী)। বিষয়টি একটু পরিস্কার করে বলা যায়, তারা টিউবওয়েল স্থাপনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ কালীপুর গ্রাম।

ঘনবসতি ও জনবহুল গ্রাম কালীপুর। সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই এর অবস্থান। গ্রামের মধ্যভাগে রয়েছে সুনামগঞ্জ পৌরসভার পাকা সড়ক। সড়কের উভয় পাশে রয়েছে মানুষের বাড়িঘর। কালীপুর খাল গ্রামটিকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে।

গ্রামের শেষ প্রান্তে বাঁশের চাঁটাই দিয়ে সেতু তৈরী করে উভয় পাড়ের মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করে আছে। এখন কয়েক বছর আগেও গ্রামের মানুষ বর্ষাকালে নৌকা দিয়ে শহরে যাতায়াত করতো। বর্তমানে পাকা সড়ক । রিক্সা চড়ে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা যায়। কালীপুরের লোকসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

সেই বৃটিশ আমলে মল্লিকপুরের বিখ্যাত জমিদার কালী বাবুর নামে গ্রামের নামকরণ করা হয় কালীপর । কালীপুর গ্রামের প্রাচীন বসতির প্রায় সবাই বাইরের জেলা থেকে আগত। তাদের পুর্ব-পুরুষের পৈতৃক নিবাস ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন গ্রামে। জীবন জীবিকার তাগিদে আজ থেকে শতবছর আগে তাদের পুর্ব পুরুষগণ কালীপুর গ্রামের বন-জঙ্গল কেটে-কুটে সাফ করে আবাদ করেন এবং পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সে সময় কালীপুর ছিল একটি বৃহৎ অরণ্য।

বর্তমানে কালীপুর গ্রামের নগর সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে। সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন সেখানে পাকা বাড়িঘর তৈরী করে বসবাস করছেন। কালীপুর তুলনামুলক ভাবে অনেকটাই নীচু এলাকায় অবস্থ্তি। কালীপুর গ্রামের পুর্বে ঝাঁউয়ার হাওর,পশ্চিমে পাখিয়ারবিল হাওর,উত্তরে হাওর ও নুতনপাড়া আবাসিক এলাকা, দেিণ শিয়াল মারার হাওর। যেভাবে কলের গ্রাম হয় : আজ থেকে শতবছর পুর্বে তৎকালীন ঢাকা জেলা বর্তমান নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার আব্দুল্লাপুর,আদমপুর, নুরপুর ও নোয়াখালী জেলার মইজদী উপজেলার মজিদপুর, নোয়াগাওঁ, চরগ্রাম থেকে কালীপুর গ্রামে বসবাস করেন।

তারা সুনামগঞ্জের গ্রামগঞ্জে টিউবওয়েল বসানোর কাজ করতেন। সাধারণত একটি টিউবওয়েল বসাতে ১০/১৫ লোকের ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। এজন্য তারা গ্রামের যুবকদের তাদের কাজের স্বার্থে সংগে নিয়ে যেতেন। এভাবে তারা বিভিন্ন এলাকায় টিপকল বসাতে গিয়ে গিয়ে সে সব যুবক টিপকল বসানোর কাজ শিখে ফেলে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কালীপুর গ্রামের মফিজ আলী, হাছন আলী প্রমুখ।

একসময় তাদের পথ অনুসরণ করে গ্রামের অন্য বেকার যুবকেরা টিপকল বসানোর কাজে লেগে পড়ে। সাধরণত কালীপুর গ্রামের কলমেস্তুরীরা হতদরিদ্র পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকটা “নুন আনতে পান্থা ফুঁড়ায়”। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বেশীর ভাগ যুবকই একাজে কোঁমর বেঁেধ নেমে পড়ে। যারা কল মে¯ু—রীর কাজ করে তাদের কেউই প্রাইমারী স্কুলের চৌকাঠ পেরুতে পারেনি।

শুধু মাত্র চোখের দেখায় তারা টিপকল বসানোর কাজ নিজ নিজ দায়িত্বে শিখে নিয়েছে। তাদের পরিবারের লোকসংখ্যাও আনুপাতিক হারে অনেক বেশী। দারিদ্রতার যাঁতাকলে পিস্ট হয়ে টিপকল মেস্তুরীরা যুগের পর যুগ অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা পেরিয়ে এখনও টিকে আছে। কল বসানোর কলা কৌশল : প্রথমে টিপকল বসানোর স্থান নির্বাচন করা। তারপর চারটি লম্বা বাঁশের খুঁটি মাটিতে পুঁতে বর্গত্রে তৈরী করে।

বাঁেশর উপরের অংশে মোটা রশি দিয়ে ভালো করে বেঁধে লোহার কপিকল স্থাপন। বাঁশের একপাশ খোলা রেখে তিন পাশে টুকরো টুকরো বাঁশ বেঁেধ উপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরী করে। কপিকল লোহার পাইপ রঁশি দিয়ে ঝুঁলিয়ে রাখে। ধারালো ইস্পাতের ফলা পাইপের নীচের অংশে লাগায়। এরপর পাইপ এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাটির গভীরে প্রবেশ করানো হয়।

পাইপ ঘুরানোর শুরুতে একজন শ্রমিক সিড়িঁ বেয়ে বাঁশে তৈরী বর্গেেত্রর উপরে অবস্থান করে। পাইপ যত মটির মাটির গভীরে প্রবেশ করে উপরে বসা লোকটি তত নীচে নেমে আসে। একই সাথে সমান তালে ঢেঁকি পাম্পের দুই প্রান্তে দুইজন লোক বসে চাপ দিয়ে বিরতিহীন ভাবে পানি পাইপের ভিতরের অংশে পানি সরবরাহ করে। যাতে পাইপের ভেতর বালির স্তর জমাটবদ্ধ হতে না পারে। এছাড়া ২/৩ জন শ্রমিক একের পর এক পাইপ জোড়া লাগিয়ে যেতে থাকে।

টিপকল বসানোর কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপুর্ণ ও ব্যয়বহুল। কোন কোন সময় লোহার পাইপ ছিঁটকে পড়ে মারাত্মক আহত হয় কর্মরত শ্রমিক। আবার কখনও লোহর পাইপের রঁশি ছিঁড়ে পড়ে পুরো পাইপ মাটির গভীরে ঢুকে যায়। আর একবার পাইপ ঢুকে গেলে কখনই মাটির নীচ থেকে তা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কখনও কখনও ভুগর্ভে গ্যাস থাকলে টিপকল বসানোর সময় তার অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে ওঠে।

গ্যাসের চাপে পাইপ মাটির গভীর থেকে দ্রুতবেগে বেড় হয়ে আসে। সে সাথে পাইপের মুখে আগুন ধরে যায়। একারণে অনেক টিপকল শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। কল বসানোর উপকরণ : টিপকল বসানোর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একটি ঢেঁকিপাম্প. মোটা প্লাস্টিকের রশি, তিনটি চেইন টোন, স্লাইরেঞ্চ, লম্বাবাঁশ, মোটারশি সহ নানান উপকরণ।

ব্যহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে সবচেয়ে ব্যায় বহুল হলো ঢেঁকি পাম্প। এটির দাম প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। মোটা প্লাস্টিকের রশির দাম ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। প্রতিটি চেইন টোনের দাম ১৫শ টাকা করে। সব মিলিয়ে ৫০/৬০ হাজার টাকার যন্ত্রপাতি ও নানান উপকরণ লাগে একটি কল বসাতে।

পাইপ কে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখার জন্য কাচেঁর গোলাকৃতির মার্বেল পাথর এক প্যাকেট । ভু-গভর্স্থ গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কয়েক মণ গোবর, পরিস্কার পানি সরবরাহের জন্য দুইটি ফিল্টার পাইপ ইত্যাদি। লাভ-তির অংক : হেড মেস্তুরী টিপকল বসানোর দরকষাকষিতে মালিকের সাথে অংশ নেন। অর্থাৎ অর্থের লেনদেন চুক্তিনামা তিনি মুখ্য ভুমিকা পালন করেন। সাধারণত ফুট হিসেবে টিপকল বসানোর চার্জ ধার্য্য করা হয়।

ফুট প্রতি ১৮ থেকে ২০ টাকা। কারও কারও কথা যার কাছ থেকে যত লওয়া যায়। একটি টিপকল বসাতে ৮/১০ জন শ্রমিকের ৮/১০ দিন সময় লাগে। আর যদি ভু-গর্ভস্থ মাটির স্তর খারাপ হয় তাহলে ২০/২৫ দিন পর্যন্তও সময় লাগে। টিপকলের পাইপ বসানোর কাজ বিরতিহীন ভাবে করে যেতে হয়।

কারণ ঘুরানো বন্ধ থাকলে মাটির চাপে পাইপ স্থির হয়ে একবারে অচল হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা থাকে। তাই এক মিনিটও পাইপ ঘুরানো বন্ধ রাখা যায় না । এজন্য কল বসানোর কাজে নিয়োজিত কল শ্রমিকরা স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে বেশী খাবার খেয়ে থাকে। তাই খাবার খরচ বেশী হয়। তাছাড়া এসব খরচের সাথে যুক্ত রয়েছে চানাস্তা পান বিড়ির খরচ।

মসজিদ,মন্দির, মাদ্রাসায় টিপকল বসালে হেড মেস্তুুরীর নেতৃত্বে নিজেদের খাবার নিজেদের খেতে হয়। কোন গ্রামে কারও বাড়িতে টিপকল বসালে যিনি কল বসান তিনিই খাবারের খরচ বহন করে থাকেন। বর্তমানে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে টিউবওয়েল স্থাপনের দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে টিউবওয়ের স্থাপনের কাজ করতে হয়। ১৫/২০টি টিউওয়েল নিয়ে একটি প্যাকেজ তৈরী করে ওপেন টেন্ডার দেয়। সেই টেন্ডারে অংশ নিতে হলে দীর্ঘ দিনের কল বসানোর অভিজ্ঞতা ও সরকারী লাইসেন্স থাকতে হবে।

তবেই টেন্ডারে অংশ নেওয়া যায়। একারণে যাদের বেশী বেশী টাকা রয়েছে তারাই কেবল বড় বড় দরপত্রে অংশ নিতে পারে। তাই ছোট ছোট টিউবওয়েল ঠিকাদার তির সম্মুখীন হচ্ছেন। বড় বড় কাজে রয়েছে নানান জটিল সব শর্তাদি। কোন কারণে যদি একটি টিউওয়েলে পানি না ওঠে তবে বিল আটকা পড়ে থাকে মাসের পর পর মাস।

পরে অফিসের বড়কর্তাকে বড় কিছু দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কে উদ্ধার হতে হয়। একটি টিপকল স্থাপন করে বড় জোর ৪/৫ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। হেড মেস্তুরী : যিনি টিপকল বসানোর প্রধান কৌশলীর কাজ করেন তাকে তাদের পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে হেড মেস্তুরী। তিনি মাটির স্তর একটি বিশেষ পদ্বতিতে পরীা করে কল বসানোর সঠিক স্থান নির্বাচন করেন। তিনি মুলত নির্দেশনা মুলক দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

কল বসানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের কাজের বিন্যাসও তিনি করে দেন। কে কখনও কোন অংশে কাজ করবে তা তিনি নির্ধারণ করে থাকেন। মালিক পরে সাথে যাবতীয় কথাবার্তা তিনিই করেন। টিপকল বসানোর কাজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার দায়ও দায়িত্ব অনেক। মালিক কে টিপকলের পরিস্কার পানি না সরবরাহের গুরুদায়িত্ব তিনি পারন করে থাকেন।

কালীপুর গ্রামে ২০/২৫ জন হেড মেস্তুরী রয়েছেন। তাদের অধীনে প্রায় ২ শত যুবক সুনামগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে টিপকল বসিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। কলের গ্রামের ঠিকাদারগণ কী বলেন : টিউবওয়েল ঠিকাদার দেওয়ান আলী বলেন, তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে এব্যবসায় নিয়োজিত একটা কল বসালে হাজার খানেক টাকা লাভ হয়। বর্তমানে বিভিন্ন গ্রামে কল বসানোর হার অনেক বাড়ছে মানুষ বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করতে পারছে। অপর একজন ঠিকাদার জানান , আগে মাসে ৬/৭ টি টিপকল বসানো যেতো বর্তমানে টিপকল, পাইপ সহ অন্যান্য উপকরণের ক্রমাগত মুল্য বৃদ্ধির কারণে এখন মানুষ আর টিপকল বসাতে আগ্রহী হয়ে ওঠছেনা।

এছাড়া লাইসেন্স জটিলতার কারণে ঠিকাদার এব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন লাইসেন্স পেতে কম পে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে, কোন ঠিকাদার টানা ৫ বছর কোন কাজ না পেলে তিনি দরপত্রে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। ঠিকাদার আব্দুল মান্নান জানান, ক্রমাগত মার খেয়ে তিনি এখন টিপকল বসানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। # # #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.