আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ভ্রমন ২০০৮ (৩য় পর্ব)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)
১ম পর্ব - Click This Link ২য় পর্ব - Click This Link ৩য় পর্ব - Click This Link ৪র্থ পর্ব - Click This Link ৫ম পর্ব - Click This Link আজ সারাদিন চরম দৌড়ের উপরে কেটেছে। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত একটার পর একটা লেকচার এবং প্রেজেন্টেশন সেশনের ধকল সামলে যখন একটু রেস্ট নেয়ার সময় এলো তখন বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ জানালো তারা তাদের রিসার্চগ্রুপের বিভিন্ন কর্মকান্ডের উপর একটা ট্যুর করাবে। ফলে আধো ঘুম, আধো জাগ্রত অবস্থায় আবার দৌড়াতে হলো তাদের পেছনে। সব শেষ হলে স্টুডেন্ট ভিলেজের রুমে ফিরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে আবার ছুটলাম ম্যাকডোনাল্ডসের দিকে, উদ্দেশ্যে ডিনার। ফিরে এসেছি একটু আগে।

এখন ক্লান্তিতে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে, কিন্তু তবুও লিখছি। সিরিজটায় যেন ছেদ না পড়ে সেজন্যই প্রধানত এই নির্ঘুম লেখালেখী। দিনের বর্ননায় ঢোকার আগে অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিগি ক্যাম্পাসের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এটা করার প্রধান কারন, আগের দুটো পর্ব পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে প্রেক্ষাপট বর্ননা না করেই আমি একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো লিখে গিয়েছি যা নুতন পাঠকদের (যারা আমাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চেনেন না) জন্য ঠিক বোধগোম্য হচ্ছে না। মার্থা মিগি নামে এক ভদ্রমহিলা ১৮৪৫ সনে ২০,০০০ পাউন্ড অনুদান দিয়ে ছিলেন স্থানীয় এক প্রটেস্ট্যান্ট চার্চকে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য।

ফলে তার নাম অনুসারে মিগি কলেজের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৫ সনে তৎকালিন আয়ারল্যান্ড এবং বর্তমান নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম অংশের ডেরি শহরে। প্রথমে এটা একটা ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র ছিল তবে পরবর্তিতে বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হতে থাকে। ১৮৮০ সনে কলেজটি রয়েল ইউনিভার্সিটি অব আয়ারল্যান্ডের একটি কলেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় কিন্তু কিছু দিন পরই রয়েল ইউনিভার্সিটির বিলুপ্তির পর এর অস্তিত্ব নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তখন এটিকে ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয় যা প্রায় পরবর্তি পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ১৯৫৩ সনে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্ট্যাটাস দেয়া হয় এবং ১৯৬৯ সনে কলেজটি নিউ ইউনিভার্সিটি অব অলস্টার নামে পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়।

১৯৭১ সনে জর্ডানসটাউন পলিটেকনিক, কলেজ অব আর্টস এন্ড ডিজাইন এবং নিউ ইউনিভার্সিটি অব অলস্টারের দুটো ক্যাম্পাস (মিগি এবং কলেরিন) একত্রিত হয়ে বর্তমান ইউনিভার্সিটি অব অলস্টার প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য যে অন্য তিনটি ক্যাম্পাসের নাম স্থানের নাম অনুসারে তথা বেলফাস্ট, কলেরিন এবং জর্ডানসটাউন রাখা হলেও মিগিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারনে ডেরী ক্যাম্পাস না বলে মিগি ক্যাম্পাস বলা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আয়ারল্যান্ড দ্বীপে অবস্থিত নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছাত্রসংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বড় এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি (অন্যটি কুইনস ইউনিভার্সিটি অব বেলফাস্ট)। গত ১৮ অগাস্ট থেকে মিগি ক্যাম্পাসে শুরু হওয়া একটা সামার স্কুল এবং ওয়ার্কশপে অংশ নিতে আমি ডেরি আসি। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী শিক্ষক ড. এন এইচ সিদ্দিকী স্যারের আমন্ত্রন এবং আন্তরিকতার জন্যই এখানে আসা।

দেখতেই খুব ভালো লাগছে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাম করা পন্ডিতদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এই ইভেন্টের মূল আয়োজন একজন বাংলাদেশীর হাতে। উপরের প্যারাটা যখন লিখছি তখন নীচে একটা গাড়ী এসে থামলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সিদ্দিকী স্যার সবাইকে গাড়ী দিয়ে যার যার বিল্ডিং-এ নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন (স্টুডেন্ট ভিলেজটা ছোটছোট বিল্ডিং-এ বিভক্ত)। আজকে পন্ডিতরা (ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল) সবাই মিলে পাবে গিয়ে একটু আদটু মজা করেছেন। যদিও রাত খুব বেশি হয়নি, ১১টা মাত্র; তবুও তারা ফিরে এসেছেন কারন কাল সকালে আমাদের পুরো নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ট্যুরে বের হতে হবে।

সবাই হয়তো আজ আগে আগেই ঘুমাতে যাবার পরিকল্পনা করছেন। যাইহোক, আজ বেশ কিছু লেকচার ছিল যা অনেক নামী-দামী প্রফেসাররা নিয়েছিলেন। ব্যাক্তিগত কারনে প্রফেসার হল্যান্ড আসতে পারেননি, তাই আমার বেশ আফসোস হচ্ছিল। যারা আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে কাজ করেন তারা ভালো করেই তাকে চেনেন। তিনি জেনেটিক এ্যালগরিদমের জনক এবং প্রবক্তা।

সিদ্দিকী স্যারের কাছে শুনলাম প্রতি ঘন্টার লেকচারের জন্য তিনি কতৃপক্ষের কাছে ১০ হাজার ইউ.এস. ডলার চেয়েছিলেন এবং কতৃপক্ষ সেটা দিতে হাসি মুখে রাজীও ছিল! দুপুরের দিকে মুক্ত আলোচনা নামক একটা সেশন ছিল। সেখানে ছাত্র এবং দর্শকরা পাইওনিয়ারদের প্রশ্ন করছিল এবং তারা তাদের দৃষ্টিকোন থেকে মতামত এবং উত্তর জানাচ্ছিলেন। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের উপর সন্ত্রাসী হামলা এবং তার ফল স্বরুপ প্রফেসারদের উপর নিরাপত্তা সংক্রান্ত চাপ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলো। অনেকেই হয়তো জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষনার ফান্ডিং-এর একটা বড় অংশ আসে সেনাবাহিনী এবং হোমল্যান্ড সিকিউরীটি থেকে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রফেসাররা বেশ কিছু অভ্যন্তরিন খবর জানতে পারেন।

তাই তাদের উপর মাঝে মাঝে অনুরোধের স্বরে প্রতিরোধের রেখা টেনে দেয়া হয়। এরকম একটা উদাহরন দিতে গিয়ে একজন ইরানের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। তাকে বলা হয়েছিল ইরানের প্রফেসার, গবেষনা (পেপার রিভিউ) এবং ছাত্রদের সাথে ইমেইলে যোগাযোগে সতর্কতা অবলম্বন করতে। আরেকজন জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসারকে বলা হয়েছিল ইরানী কোন ছাত্রের মেইলের যেন রিপ্লাই না দেয়া হয়। হঠাৎ এক সময় লক্ষ্য করলাম পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে অন্য ভাবে দেখছে, যেটা তারা ইরাক আক্রমনের সময় একদমই পরোয়া করেনি, তা হলো ইরানের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা।

যুক্তরাজ্যের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় ইরানী ছাত্র এবং প্রফেসারে ছেয়ে আছে। লন্ডনের তিন জায়ান্ট তথা ইম্পেরিয়াল, ইউ.সি.এল এবং কিংস-এর একটা বিশাল অংশ ইরানী। কিংস-এর সেন্টার ফর টেলিকমিউনিকশন রিসার্চে গতবছর পি.এইচ.ডিতে আমার এ্যাডমিশন হয়েছিল। সেই সূত্রে ওদের ব্যাপক ভাবে জানারও সুযোগ হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম সেখানে হেড থেকে শুরু করে প্রধান সব প্রফেসার ইরানের।

এখানেই মূলত ইরাক এবং ইরানের পার্থক্য। ইরাককে যতটা বুল-হেডেড হিসেবে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেন, ইরানকে ততটা নিতে পারছে না। তাই ইরান যখন পারমানবিক বোমার কথা বলে তখন তারা একটু হলেও ভীত হয়। আমি ইরানের সমর্থক নই, নই যুদ্ধ-নির্ভর বর্তমান বিশ্বরাজনীতির একনিষ্ঠ ভক্ত। এ উদাহরনটা দিয়ে আমি যেটা পাঠকের সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছি সেটা হলো শিক্ষার ক্ষমতা।

সম্ভবত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষনশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুধু জ্ঞান এবং শিক্ষার কারনে ইরান এই সম্ভ্রমটুকু আদায় করে নিতে পেরেছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে। ফিরে আসছি অলোচ্য প্রসঙ্গে। লেকচার সিরিজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিগি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গবেষনার কার্যক্রম দেখাতে। সত্য কথা বলতে কি, এখানে অর্থের অভাব রয়েছে, কিন্তু আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টার কোন কমতি নেই। যেহেতু নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যুক্তরাজ্যের চারটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত, তাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফান্ডিং-ও তেমন একটা আসে না।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উদ্যোগ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিকে আকর্ষন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু দারুন দারুন প্রজেক্টের কাজ সফল ভাবে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। একটা প্রজেক্টে দেখা গেলো মানুষের ব্রেন থেকে চিন্তাকে পড়ার যন্ত্র বানানো হয়েছে। যন্ত্রটা মাথায় লাগিয়ে দিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে দেয়া হলো। কম্পিউটার স্ক্রিনে দুটো বল ছিল, একটা লাল এবং একটা সবুজ।

শুধু মনে মনে চিন্তা করলেই কম্পিউটার বুঝতে পারছিল কোন বলটা নড়বে! এই যন্ত্র দিয়ে প্রধানত তারা একটা হুইল চেয়ার বানাচ্ছে যেটা সেই সব মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হবে যারা স্ট্রোকের কারনে কোমায় রয়েছে। এ ধরনের রোগীদের অভ্যন্তরিন চিন্তাশক্তি সম্পূর্ন সবল থাকে। যদিও তারা বাহ্যিক ভাবে প্যারালাইজড থাকে, কিন্তু শোনা এবং চিন্তা করার ক্ষমতা তাদের আগের মতই রয়ে যায়। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তারা চিন্তা করে করে চেয়ারে করে ঘুরে বেড়াতে পারবে। আরেকটা প্রজেক্টে একটা রোবট বানানো হয়েছে যেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার এমন একটা বিশেষ স্তরে পৌছে গিয়েছে যে এখন তার মধ্যে অনুভুতি এবং আবেগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই রোবটটার শরীরে প্রায় ত্রিশটা লেজার সেন্সর বসানো আছে যার একেকটার দাম ৬,০০০ পাউন্ড; অর্থাৎ রোবটের শরীরের শুধু সেন্সরগুলোর দাম আড়াই কোটি টাকার উপরে! এরপরও তারা বলে তাদের নাকি টাকা নাই গবেষনার জন্য!!! যাইহোক, ল্যাবগুলো সব ঘুরে দেখে, ফাইনাল ফটোসেশন করে আমি যখন রুমে ফিরছিলাম তখন বারবার ডাবলিনের কথা মনে পড়ছিল। মাত্র তিন দিন হয়েছে নর্দার্নে এসেছি অথচ মনে হচ্ছে যেন কতদিন ডাবলিনের বাহিরে। ইশ! কত্তদিন সিটি সেন্টারের স্পাইকটা দেখা হয় না, দেখা হয় না ট্রিনিটির অপরুপা ক্যাম্পাসকে। কি আজব! আমি ঢাকাকেও এভাবে মিস করি না যতটা করছি ডাবলিনকে। এ শহর আসলে আমার কাছে অন্যরকম ভালোলাগার শহর।

এ শহরইতো আমাকে শিখিয়েছে স্বাবলম্বি হতে, স্বনির্ভর হতে। আমাকে শিখিয়েছে নিজের পায়ে দাড়াতে। তাই জীবনে যেখানেই যাই, ডাবলিন এবং আয়ারল্যান্ড আমার কাছে প্রথম প্রেমের মত অমলিন হয়ে থাকবে চিরদিন। ২০ অগাস্ট ২০০৮ ডেরী, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য। দ্রষ্টব্য ১. সংযুক্ত ছবিতে মিগি কলেজের মূল ভবন দেখা যাচ্ছে।

ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। ২. ইরানী ছাত্রদের নিয়ে নিউজউইকের একটা তথ্যপূর্ন রিপোর্ট রয়েছে নিচের লিঙ্কে। আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন (রাগিব ভাইয়ার সৌজন্যে)। http://www.newsweek.com/id/151684
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।