আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ভ্রমন ২০০৮ (১ম পর্ব)

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

২য় পর্ব - Click This Link ৩য় পর্ব - Click This Link ৪র্থ পর্ব - Click This Link ৫ম পর্ব - Click This Link ইউনিভার্সিটি অব অলস্টারের মিগি ক্যাম্পাসের স্টুডেন্ট ভিলেজে বসে লিখছি। চারদিক নিরব, যেন আমি একাই জেগে আছি। মাঝে মাঝে দরজায় কেমন যেন একটা খট খট শব্দ হচ্ছে। সেটাই প্রধানত জানিয়ে দিচ্ছে লোকালয়ে আছি এখনও, না হলে শ্মশান বলে ভ্রম হতো; এত নিরব। সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশের রুপ দেখে ভীত হয়ে পড়েছিলাম।

বৃষ্টিতো ছিলই, সাথে ছিল কুয়াশা ভরা কেমন যেন দমবন্ধ করা গুমট একটা পরিবেশ। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে ডাইনিং-এ গিয়ে দেখি খাওয়ার মত তেমন কিছু নেই। কাল রাতে শখ করে ফ্রাইড চিকেন বানিয়ে ছিলাম। ওভেনে দিয়ে ফারহানের সাথে গুগলে গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। ফলাফল অর্ধেকই পুড়েছে।

রাতে ভালো কয়েকটুকরা খেয়েছিলাম, কিন্তু সকালের নাস্তার জন্য রাখাগুলো মুখে দিয়ে দেখলাম খাবার অবস্থা নেই। বাসায় পাউরুটিও নেই। মেজাজটা ততক্ষনে খারাপ হতে শুরু হয়েছে। দিনের শুরুটা সব সময় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন। শুরু ভালো না হলে পুরো দিনই আমার খারাপ যায়।

তার উপর আজকে ভিসা ছাড়া ইউ.কে. ঢুকবো। রীতিমত আল্লাহ-খোদাকে ডাকছি, এরকম সময় যদি এমন বেখাপ্পা অবস্থা দিয়ে দিন শুরু হয়, তাহলে পরবর্তিতে ভাগ্যে কি লেখা আছে সেটা অবচেতন মন বিভিন্ন কুভাবনা দিয়ে তৈরী করে নিতে সময় নেয় না। যাইহোক, কর্নফ্ল্যাক্স দিয়ে দুইগ্লাস দুধ আর আধপোড়া একটুকরা ফ্রাইড চিকেন খেয়ে যখন বের হয়েছি ঘড়িতে তখন প্রায় দশটা। দ্রুত বাসের জন্য গিয়ে দাড়ালাম। মনেমনে হিসেব করছি সাড়ে এগারোটার বেলফাস্টের ট্রেনটা ধরতে হবে।

সময় খুব কম, কিন্তু কাজ বাকি অনেক। ইউরোকে পাউন্ড করতে হবে, পাসপোর্ট-ইনভাইটেশন লেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ রুমের ড্রয়ার থেকে নিতে হবে, লাঞ্চ করতে হবে এবং সব শেষে কননি স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছিল। বারবারই মনে হচ্ছিল অবধারিত ভাবে কপালে লেখা আছে একটা শব্দ - ট্রেন মিস। ট্রিনিটিতে ঢুকে পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হবার আগে আমার গ্রুপমেট মার্ককে জিজ্ঞেস করতে গেলাম বেলফাস্টে মানি এক্সচেঞ্জার কোথায় আছে।

হায় কপাল! মার্ক যেই শুনলো আমি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যাচ্ছি, তার স্বভাবসুলভ লেকচার শুরু করলো। প্রথম প্রশ্ন ট্রেনের টিকেট কেটেছি কি না? জবাব দিলাম - না। শুনে তাকে বেশ পুলকিত দেখালো। অনেক সময় নিয়ে ওয়েব ঘেটে ডবলিন-বেলফাস্ট-ডেরীর কানেক্টিং ট্রেনের একটা ছক দাড় করিয়ে ফেললো। তারপর পকেট থেকে সেক্সি তরুনী মেয়েদের থেকেও রুপবতী আই-ফোনটা বের করে ভাড়া হিসেব করতে বসলো।

আমি গোবেচারার মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম মার্কের কীর্তি। এক সময় সে ভাড়ার সমস্যা সমাধান করে মন দিলো ভিসার দিকে। আমার আত্মা আবার খাঁচা শুন্য হবার দশা হলো। বললাম আমার কাছে ব্রিটিশ ভিসা নেই। সময় ছিলনা নেয়ার, তাই নেইনি।

শুনে মার্ক হাসলো। জানালো নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যাবার পথে কোন সমস্যা নেই তবে মাঝে মাঝে আসার পথে চেক করে। যেহেতু আমার আইরিশ ভিসা আছে, অতএব সেটাও সমস্যা নয়। বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেলো। মার্কের কথাকে আমি সব সময় খুব মূল্য দেই।

আজ পর্যন্ত মার্কের বলা কোন কথা ভুল হয়নি। সব শেষে আসলো মানি এক্সচেঞ্জারের বিষয়। শুনে মার্ক হেসে ফেললো। বললো, নর্দার্নে যে কোন এটিম মেশিনে আমার এটিএম কার্ড ভরে অনায়েসে আমি পাউন্ড তুলতে পারবো। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের এই এক সুবিধা, এখানে ইউরো পাউন্ড দুটাই চলে।

আসলে ইউকে এবং আয়ারল্যান্ড - দুটার মিলিত রুম এই দেশটি। যাইহোক, মার্কের লেকচারটা একটু বড়ই হয়ে গিয়েছিল; ফলে সাড়ে এগারোটার ট্রেন ধরার সম্ভাবনা শুণ্যের কোঠায় পৌছালো। এদিকে নর্দার্নে প্রচন্ড বর্ষার কারনে বন্যা হয়েছে, ফলে ট্রেনের টাইম টেবল এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আমিও ভাবলাম দেরী যখন হয়েছে তখন আরেকটু হোক। খেয়ে নিয়ে তার পর আস্তে ধীরে দেড়টার ট্রেন ধরাই সমীচিন মনে করলাম।

লাঞ্চের পর টেক্সি নিয়ে চলে গেলাম কননি স্টেশনে যেখান থেকে ডাবলিন-বেলফাস্টের এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ে। একদম ডেরী পর্যন্ত রিটার্ন টিকেট কেটে তারপর প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তাকিয়ে দেখছিলাম মানুষগুলোকে। কত মানুষ কত প্রান্ত থেকে আসছে, যাচ্ছে, ছুটছে। কাজের জন্য, জীবিকার জন্য, পেটের জন্য সবাইকে ছুটতে হয়।

নাকি জীবনই মানুষকে প্রতিনিয়ত ছোটায়? যেন আমাদের সবার সামনে একটা মুলা ঝুলিয়ে দিয়েছে জীবন। তারপর বাকি কাজটা আমরাই করি। নিরন্তর সেই মুলাটাকে ধরার চেষ্টা করি এবং অতঃপর ছোটা আর ছোটা। ধ্যাৎ! এই এক সমস্যা - ট্রেন স্টেশনে গেলেই কেন যেন আমার মনটা দার্শনিক হয়ে যায়। জীবনের বয়ে চলা দেখতে দেখতে জীবনকে নিয়ে কাটাছেড়া শুরু করে।

তবে কাটাছেড়া বেশি সময় চালাতে পারলাম না। ট্রেনে ওঠার ডাক আসলো। ফ্রি সিটিং - অতএব গিয়ে বসলাম বেশ আরাম করে চারটা সিট নিয়ে। বসার স্টাইলেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম অন্তত পাশের সিটে কাউকে বসতে দিতে নারাজ আমি। ট্রেন প্রায় ফাকাই যাচ্ছে।

ফলে সবাই মোটামোটি আমার মত অবস্থায় বসে আছে। আরাম করে বসে, ল্যাপটপটা বের করে সামনের টেবিলে রেখে চালিয়ে দিলাম। তারপর "খোদা জানে" গানটা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম ভিসা ছাড়া ইউকে ঢুকতে যাচ্ছি, খোদাই জানেন কি আছে কপালে! বাস্তবে দেখা গেলো কপালে তেমন কোন ফাড়া ছিল না। মার্কের কথাই সত্য। ইমিগ্রেশনতো দূরে থাক, বুঝতেই পারিনি কোন সময় রিপাবলিক থেকে নর্দার্নে ঢুকে পড়লাম।

হঠাৎ ভোডা ফোন থেকে এস.এম.এস এসে জানিয়ে দিল আমার রোমিং অপশন অন হয়েছে কারন আমি আন্তর্জাতিক বর্ডার অতিক্রম করে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছি। সাথে সাথে বাহিরে তাকালাম। আর তখনই বুঝতে পারলাম আসলেই আমি রিপাবলিক ছেড়ে এসেছি। দুই আয়ারল্যান্ডের চেহারার মাঝে একটা অদ্ভুত পার্থক্য আছে। যে কেউ দেখলেই সেটা ধরতে পারবে।

রিপাবলিকের বাড়ির রংগুলো ক্রিম, ব্রাউন অথবা ইয়েলিশ। আর নর্দার্নের প্রায় সব বাড়ি লাল ইটের। হঠাৎ করে যেন রঙের এই বিশেষ পরিবর্তনটা তিব্র ভাবে চোখে লাগে। তবে রঙের বৈষম্য ছাড়া আর সব এক। পরিবেশ, প্রকৃতি, পাহাড়, পশু-পাখি - সব এক।

আয়ারল্যান্ডকে যত দেখছি তত ভালো লাগছে। প্রকৃতি এত সুন্দর যে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পুরো দেশটাই পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো। উন্মুক্ত পাহাড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে ঘোড়া, গরু আর মেষ। সবুজ আর সবুজ চার দিকে।

অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি। ট্রেন চলছে কখনও পাহাড়ের গা ঘেসে, কখনও পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। দুদিকে পাহাড়, মাঝে সরু রাস্তা। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন পাহাড়ের সাথে এখনই বাড়ি লেগে যাবে। কয়েকবার গুল্ম লতার মত কিছু পাতা ট্রেনের জানালায় এসে বাড়িও দিয়ে গেলো।

বেলফাস্টে ট্রেন থেকে নেমেই আবার কানেক্টিং ট্রেন ধরলাম ডেরীরর উদ্দেশ্যে। যতই ডেরীরর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম ততই দেখছিলাম পাহাড়গুলো যেন অনেক শক্ত হয়ে আসছে। এক সময় একটা এলাকায় আসলাম যার নাম ক্যাসেল-রক। এই এলাকার সব পাহাড় রক দিয়ে তৈরী। পাহাড়ের রক খসে পড়ে যেন মানুষের বাড়ি-ঘর ধ্বংস না করে, সে জন্য পাহাড়কে লোহার জাল দিয়ে মুড়ে রেখেছে।

সেই পাহাড়ের নীচ ফুটো করে সুড়ঙ্গ তৈরী করে ট্রেন চলার পথ করা হয়েছে। অন্ধকার একেকটা সুড়ঙ্গে ট্রেন ঢুকছিল আর অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিল আমার মনে। গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে যাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখার আনন্দও ভয়ঙ্কর। হঠাৎ দেখলাম চমৎকার সব ঝরনা সুউচ্চ পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নেমে আসছে মাটির দিকে।

মুগ্ধতা আর বিস্ময় নিয়ে আমি অপরুপা আয়ারল্যান্ডের রুপকে দুচোখ ভরে দেখছিলাম। এ দ্বীপ দেশদুটো যে কি ভয়াবহ সুন্দর, নিজ চোখে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ডেরী পৌছাতে পৌছাতে প্রায় ছয়টা। সামার স্কুলের প্রথম দিন মিস হয়ে গেলো। একটু মন খারাপ লাগছিল, তবে অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার ক্যাম্পাস আর তার থেকেও চমৎকার তাদের মানুষের ব্যবহারে সেটা দূর হয়ে যেতে সময় লাগেনি।

কাছের একটা এটিএম থেকে পাউন্ড তুলে এনেছি। মার্কের কথাই সত্য। কোন সমস্যা ছাড়াই আমার এটিএম কার্ড দিয়ে পাউন্ড তুলতে পেরেছি। নিকটস্থ একটা ম্যাকডোনাল্ডস থেকে রাতের খাবার খেয়ে এখন চমৎকার স্টুডেন্ট ভিলেজের রুমে বসে নেট ব্রাউজ করছি। মন্দ কাটছে না সময়টা।

অন্তত নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের প্রথম দিন বেশ ভালোই কেটেছে। দেখা যাক অনাগত দিনগুলো কেমন কাটে! ১৮ অগাস্ট ২০০৮ ডেরী, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য। দ্রষ্টব্য: উপরের ছবিটায় ক্যাসেলরকে স্নো-এর ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আসা বেলফাস্ট-ডেরী ট্রেনকে দেখা যাচ্ছে। ছবিটা ফ্লিকার থেকে নেয়া। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের আরো কিছু ছবি নিচের লিঙ্ক থেকে দেখা যাবে।

আমার ক্যামেরায়ও তোলা হচ্ছে। ডাবলিন ফিরে তারপর আমার ফ্লিকারে আপ করবো। সবাইকে শুভেচ্ছা। Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।