আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুয়েত ফেরত বাঙ্গালী শ্রমীকদের যে কারনে আমি সহমর্মীতার বদলে জুতা-পেটা করার পক্ষপাতি

দ্য কাপালিক ইজ ব্যাক

কুয়েত থেকে ঢলের মতো ফেরত আসছে বাঙ্গালী শ্রমীক। কুয়েত সরকার নাকি যাকে সামনে পাচ্ছে ধরে ধরে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। এদের শরীরে মারের চিহ্ন দেখে সবাই "আহারে! কি অত্যাচারি দেশ!" বলে সমবেদনা জানাচ্ছে। পত্রিকায় প্রতিদিন এদের উপর অত্যাচারের ছবি আসছে। ব্লগাররা সমবেদনা জানিয়ে অনবরত পোষ্ট দিচ্ছে।

অনেকেই দেখলাম মন্তব্য করেছে "গালফ ওয়ারে আমরা কুয়েতকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলাম, এখন কুয়েত সরকার তার প্রতিদান দিচ্ছে। " এই ধরনের মন্তব্যকারীরা জানেও না বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমীকেরা কি ধরনের কাজ-কর্মে লিপ্ত থাকে, এবং এসব দেশের আইন-কানুন কেমন। ব্যাক্তিগতভাবে এই সব ফেরত পাঠানো শ্রমীকদের প্রতি আমি সহমর্মীতো নই-ই, বরং জুতাপেটা করার পক্ষপাতি। বাংলাদেশী শ্রমীকরা কুয়েতে যেই নজিরবিহীন ভাংচুর এবং অচলাবস্থা সৃষ্টির ঘটনা ঘটিয়েছে, তার পেছনে তাদের কারন ছিল "যথাযথ বেতন এবং ভাতা প্রদানের দাবী" জানানো। এই কাজটা করার জন্য তারা যথাযথ পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে ভাংচুরকে।

কাজটা করার সময় তাদের মাথায় একবারও আসেনি যে তারা অবস্থান করছে বাংলাদেশে নয়, মধ্যপ্রাচ্যের একটা দেশে, যেখানে অপরাধ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হয়, যার কারনে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় খুব উপরের সাড়িতে এদের অবস্থান। এই সব দেশে অপরাধ মূলক কর্মকান্ড ঘটেনা তা নয়। অপরাধ অবশ্যই ঘটে, কিন্তু আমাদের সাথে পার্থক্য হলো, সেখানে ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে সাথে সাথে সেই অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এসব দেশের সরকার তার নাগরীকদের সবচেয়ে বেশী যেই সেক্টরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সেটা হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। খুঁজলে বোধ হয় সব ঘরেই একজন করে পুলিশ পাওয়া যাবে।

এসব দেশের আইন-কানুন এতই কঠিন যে মানুষ অপরাধ করবে কি, চিন্তা করলেই ভয়ে আধমরা হয়ে যায়। সে আইন আবার আমাদের মত শুধুই খাতা-কলমের না, বাস্তবে তা প্রয়োগও করা হয় ১০০ ভাগ। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ কাতারে কিছু মাইনর অপরাধের শাস্তি কি হতে পারে তার উদাহরন দেই। রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় সিগনাল অমান্য করলে জায়গা অনুযায়ী ৫,০০০ থেকে ৩৫,০০০ রিয়েল পর্যন্ত জরিমানা। গাড়ি চালানোর সময় সীট-বেল্ট না বাধলে ৫০০ রিয়েল জরিমানা।

কোন ট্রাক ওভারলোড করে রাস্তায় বের হলে ৩,০০০ রিয়েল জরিমানা। সেই সাথে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ৩ পয়েন্ট মাইনাস। মোট ১৪ পয়েন্ট মাইনাস হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল এবং ড্রাইভার সোজা জেলে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ২৫,০০০ রিয়েল জরিমানা এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরত। ড্রাইভিং টেস্টের সময় চোখের সামনে দেখলাম এক নেপালী খাতায় ভরে পুলিশকে ৫০০ রিয়েল ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করায় তাৎক্ষনিকভাবে গ্রেফতার করে দেশে পাঠিয়ে দিল।

এইসব দেশে মেজর কোন অপরাধ করলে তার শাস্তি কি হতে পারে এবার সেটা কল্পনা করেন। কুয়েতে যারা ভাংচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কি ঘটনাটা ঘটানোর আগে সেখানকার আইন-কানুন কিছুই জানতো না বলে মনে হয়? অবশ্যই জানতো, এবং জেনে-শুনেই করেছে। বরং ঘটনাটা ঘটানোর আগে একবার চিন্তাও করেনি এটা তার নিজের পরিবার এবং দেশের প্রতি কি ভয়াবহ পরিনতি বয়ে আনতে পারে। এই চিন্তা না করার পেছনে কারন হচ্ছে বাঙ্গালীর মজ্জাগত স্বভাব। আসা যাক "যথাযথ বেতন এবং ভাতা" প্রসঙ্গে।

বাঙ্গালী শ্রমীকেরা যখন বিদেশে যায়, বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেনা কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে। সেখানে তার কাজ কি হবে, কত বেতন দেয়া হবে, যে ভিসায় সে যাচ্ছে তা পালন করার মতো যোগ্যতা তার আছে কি না। বেশিরভাগ শ্রমীক নিরুপায় হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যায় এ কথা সত্যি। কিন্তু তাই বলে তো পেটে ভাত নেই বলে আগুনে ঝাপ দিলে কোন লাভ নেই, বরং আগুনে পুড়ে যাবে। এরা যখন বিদেশে যাওয়ার দেয়ার কথা চিন্তা করে, মনে মনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে কোন স্বপ্নপুরীতে যাচ্ছে, সেখানে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

একবার পৌঁছাতে পারলে শুধু টাকা আর টাকা। দুনিয়ার সব সুখ এই টাকায় কিনে ফেলা যাবে। কিন্তু আসার পরে যখন আগুনের তাপটা গায়ে লাগে, তখন বাস্তবতা বুঝতে পারে। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে অনেক। এই আসাটা কিভাবে হয় দেখা যাক।

কোন একটা কোম্পানীর হয়ত কিছু দক্ষ শ্রমীক দরকার, যেমন মেসন বা কার্পেন্টার। তারা যখন সরকারের কাছে শ্রমীক নেয়ার আবেদন জানায়, তখন সরকার তাদের পলিসি অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমীক নেয়ার অনুমতি (ভিসা) দেয়, যেমন নেপাল থেকে ২ জন, শ্রীলঙ্কা থেকে ১ জন, বাংলাদেশ থেকে ২ জন ইত্যাদি। এই পেপারগুলো কোম্পানীর লোকজন তখন সংশ্লিষ্ট দেশের পরিচিতি কাউকে দিয়ে দেয় শ্রমীক এনে দেয়ার জন্য। বিশেষ করে ছোট কোম্পানীগুলো ট্রাভেল এজেন্সীর ঝামেলা এড়াতে এই ধরনের কাজ বেশী করে। কোম্পানীর মধ্যবর্তী কেউ হয়ত কিছু পয়সার বিনিময়ে কোন দালালকে ভিসাগুলো দিয়ে দেয়।

এই দালালেরা তখন নিজের আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনদের মোটা অঙ্কের পয়সার বিনিময়ে এইসব ভিসায় বিদেশে আসার সুযোগ করে দেয়। এক্ষেত্রে ভিসা অনুযায়ী কাজের যোগ্যতার কোন বিচার করা হয় না, বরং বিচার করা হয় টাকার পরিমানের। এইভাবে কোন কিছু না জেনে যখন ইন্টারমিডিয়েট-পাস-করে-বেকার-হয়ে-ঘরে-বসে-থাকা একজন মোবারক ১২০০ রিয়েল বেতনের আশ্বাস পেয়ে কার্পেন্টার হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে চলে আসে, তখনই ঘটে বিপত্তি। কোম্পানী দেখে, তার সদ্য আসা স্কিলড কার্পেন্টার আসলে হাতুড়ি কিভাবে ধরতে হয় সেটাই ভালো ভাবে জানে না, সাটারিং করা দূরে থাক। তখন আবার নতুন লোক আনার ঝামেলা এড়াতে, কিছুটা বা মানবতার খাতিরে দেশে ফেরত না পাঠিয়ে তাদের কাজে রাখা হয় অদক্ষ শ্রমীক হিসেবে।

১২০০ রিয়েলের জায়গায় সঙ্গত কারনেই তার বেতন ধার্য্য করা হয় ৬০০ রিয়েল, সাথে কাজ শিখলে বেতন বাড়ার আশ্বাস। স্বাভাবিকভাবেই এটা মোবারকের কাছে "ন্যায্য বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ"। এই মোবারকেরা বিদেশে এসে কি ধরনের আচার-আচরন এবং জীবন যাপন করে পুরো বাঙ্গালী জাতীর মুখে কলঙ্ক লেপন করে সেটা অন্য এক সময় বলা যাবে। এরাই কিছুদিন পর আইনের নিষেধের কোন তোয়াক্কা না করে যখন লুকিয়ে বাইরে কাজ করা আরম্ভ করে এবং দেখে যে বাইরে কাজ করলে কোম্পানীর চেয়ে ৩ গুন পয়সা পাওয়া যায়, তখনই এরা কোম্পানী থেকে পালিয়ে অবৈধ শ্রমীকের খাতায় নাম লেখায়। আর যদি না-ও পালায়, প্রতিক্ষন "ন্যায্য বেতন" না পাওয়ার রাগে ফুসতে থাকে।

একসময় এরাই "বহুত কামাইছি, কি করবো? বেশী হইলে বাইত পাডায়া দিব" মনোভাব নিয়ে অতি উৎসাহে ভাংচুর করতে ঝাপিয়ে পড়ে। এরা একবারও চিন্তা করে না এই ভাংচুরের ফলে সরকার তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি না করে বরং গন হারে সব বাঙ্গালী শ্রমীক দেশে ফেরত পাঠাবে এবং নতুন শ্রমীক নেয়া বন্ধ করে দেবে। এটা শুধু কুয়েতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং সমগ্র গালফেই ঘটবে। এরা যদি ভাংচুর করার আগে একবারও চিন্তা করতো যে তারা যা করছে তার পরিনাম শুধু সে একাই ভোগ করবে না, সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যাক্তিটির উপার্জন বন্ধ হওয়ায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে তার পুরো পরিবার, এবং শুধুই তার নিজের পরিবারই না, বিদেশে অবস্থানকারী প্রতিটি বাঙ্গালী শ্রমীকের পরিবার, নতুন করে যাদের বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল যা এবার বন্ধ হচ্ছে তাদের পরিবার, তাহলে কোনভাবেই তারা পারতো না এই সহিংস পথ অবলম্বন করতে। বরং তারা সমস্যার কথা সেদেশে তার দেশের রাষ্ট্রদূতকে জানাতো, কাজ না হলে বাংলাদেশ দূতাবাস ঘেরাও করতো, অহিংস পদ্ধতিতে আমৃত্যু অনশন করতো, কিন্তু নিজের দেশ এবং পরিবারকে এইভাবে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতো না।

অর্থনৈকিভাবে চরমতম পঙ্গু একটি দেশের লাখ লাখ পরিবারকে যারা শুধুমাত্র নিজেদের উশৃঙ্খল স্বভাবের কারনে চরমতম হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের প্রতি এই কারনেই সহমর্মীতার কোন প্রশ্নই আমার মনে উদয় হয় না, বরং এদের দেখা মাত্রই দুই গালে চপেটাঘাতই এদের ন্যায্য পাওনা বলে মনে হয়। -------------------------------------------------------------------- আমার ইংরেজি ব্লগ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.