আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরশুরামের কুঠার অথবা জিন্দা লাশের আয়ুষ্কাল

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনাবিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে?লরেন্স লিফসুলজ (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল) ১. পরশুরাম নামে এক পৌরাণিক বীর ছিল। স্বর্গের দেবতাদের বরে সে মহাপুরুষ হয়ে জন্মেছিল।

সে মাতৃজঠরে থাকতে মা রেণুকা দেবতাদের কাছে মিনতি করে, সন্তান যেন ক্ষত্রিয় না হয়। দেবতারা হ্যাঁ করে। রাজা জমদগ্নির ঔরসের সন্তান, মাতার মানসপুত্র এবং মর্ত্যে ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠতম অবতার হয় পরশুরাম। অবতারেরা মর্ত্যে আসেন মানুষিক জীবন-যাপনের জন্য নয়_ মহত উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে। পরশুরামের জীবন সেই উদ্দেশ্য সাধনের অটুট কাহিনী।

আসুন আমরা তার গল্প শুনি। পরশুরামের তরুণ বয়সে মাতা রেণুকার প্রতি পিতা রুষ্ঠ হন। পাঁচ পুত্রকে ডেকে পিতা বলেন মাতাকে হত্যা করতে। একে একে চার পুত্র নারাজ হয়। রাজা জমদগ্নি তাদের শাস্তি দিয়ে নির্বোধ প্রাণীতে পরিণত করেন।

এবার পঞ্চম পুত্রের পালা। পুত্র পরশুরাম বিনা বাক্যব্যয়ে মাতার শিরোচ্ছেদে করে। সেই-ই শুরু। এরপর পরশুরাম বিবিধ হিংসায় মত্ত হয়ে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করে। দেবতারা এ কাজে তাকে পরশু নামক ব্রহ্মাস্ত্র বর দিয়েছিল।

সেই পরশু বা কুঠারই ছিল তার নরহত্যার অমোঘ অস্ত্র। দেবতারা বলেছিল, ক্ষত্রিয়নাশে তার পাপ হবে না। তাই পরশুরাম ভেবেছিল সে শুদ্ধচিত্ত। ‘শুদ্ধচিত্তেই’ সে কুঠার চালনা করে যেতে থাকে। কিন্তু সে বোঝে নাই যে, সেই কুঠার আর তাকে ছাড়বে না।

ছাড়ে নাই। হাতের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল সেই কুঠার; আর সেই অবস্থায় সে পাপস্খালনের জন্য ঘুরতে ঘুরতে এক নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। সেই নদীর জন্ম হয়েছিল শিবের হাত ধোয়া জল থেকে। দেবস্পর্শী সেই জল অতি পবিত্র। পরশুরাম তাতে হাত ডোবায়।

এবং দৈববলে, কুঠার তার হাত থেকে খসে যায়। একদা কলিকাল আসে। এবং অন্য আরেক পরশুরাম তততম অবতার হয়ে দেবতার বর নিয়ে মর্ত্যে নামে। তারও ব্রত হয় ক্ষত্রিয়নাশ। দেবতারা স্বর্গে বসে অঙ্গুলি হেলন করেন, আর মর্ত্যে নতুন বিধান জারি হয়।

সেই বিধানের বলে পরশুরামের ফেলে যাওয়া কুঠারটি তুলে দেয়া হয় কলিযুগের এই পরশুরামের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে সেটিও তার অঙ্গ হয়ে যায়। এই কুঠারধারী এখন দিনে-রাতে যত্রতত্র মনুষ্যনাশ করে চলে। তারও পিতা তাকে দিয়েছে অনুশোচনাহীন নির্দয়তা, দেবতারা দিয়েছে অভয় । তার বলে বলীয়ান হয়ে বঙ্গদেশে সে চার বছরে পাঁচশ হত্যা করে।

তার ভয়ে দেশের মানুষ জিন্দা লাশ হয়ে ঘোরে। জিন্দা লাশেরা খায়-দায়-কর্ম করে, সাহিত্য করে, সড়কে-সভায় চেঁচায়। আর রাত হলে জান হাতে নিয়ে বসে থাকে, পরশুরামেরা এলে যে তুলে দিতে হবে তা! তারা স্বপ্নে দেখে, অতিকায় কুঠার হাতে অন্ধকারের মূর্তিরা এসে দাঁড়াচ্ছে, কুঠার উঠছে আর নামছে আর শব্দ হচ্ছে। ২. আমার একটা ভিন্নমত আছে। আমার একটা ক্ষোভ আছে, তা আমি প্রকাশ করতে চাই।

কেবল এটুকুর জন্যই আমি মারা পড়তে পারি। কারণ রাষ্ট্র সহিংস হয়ে উঠছে, কারণ রাষ্ট্র 'অতিমানবিক' হয়ে উঠছে। মার্কিন মডেলের শাসনকাঠামোয় একদিকে সে র্যাডিক্যাল বিরোধীদের হত্যা-হুমকি-বন্দি-জনবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে অধিকারবাদী নাগরিক-স্পেস সৃষ্টি করছে। সেই নাগরিক মাঠে মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে, কিন্তু কেউ বিপরীত মত উচ্চারণ করা মাত্রই তা হাওয়া হয়ে যাবে।

বলা যাবে, কিন্তু শোনা হবে না। কেউ শুনবে না তা। বিচারবিভাগ স্বাধীন হবে, কিন্তু আইনের সার্বভৌমত্ব রদ হয়ে যাবে। কিছু দুর্নীতি নিয়ে তাওয়া গরম হবে, কিন্তু রাষ্ট্র নিজেই বহুজাতিক দুর্নীতির একচেটিয়া খুলবে। এই দুনিয়ার সুখী মানুষেরা দেখবে রাষ্ট্র হচ্ছে ডক্টর জেকিলের মতো ভাল।

আর ঐ আনন্দলোকের বাইরে যারা, তারা দেখবে মিস্টার হাইডের ভয়াল মুখ। কিন্তু এই দুই তরফের কখনো দেখা হবে না। তাই তারা জানবে না, পর্দার ওপারে 'দুনিয়ার সুখ' হাতোর মুঠোয় নিয়ে কিছু মানুষের সদম্ভ উল্লাস চলছে; ঐ সুখী-সুন্দর-শোভন মানুষেরাও জানবে না পর্দার ওপারে জিন্দা লাশ ছিঁড়ছে হায়েনারা। মিডিয়া-আইন-অধিকার-জনমত সব ঐ আলোকিত মানুষদের কথা বলে। আর যা, তা অন্ধকারে_ ফলত অদৃশ্য।

তাই তারা যখন বলে জানি নাই, দেখি নাই, শুনি নাই, তাই প্রতিবাদে নামি নাই; তখন তারা একরত্তি মিথ্যা বলে না। আমাদের বিচারবিভাগ, আমাদের রাজনৈতিক ক্লাস, আমাদের মিডিয়া আমাদের আমলাতন্ত্র পরশুরামের বাকি চারভাইয়ের মতো জড়ভরত হয়ে ব্যবহারের পদার্থমাত্র। তারা বিজ্ঞাপনের সেই বানরদল: যারা নিজ হাতে চোখ ঢেকেছে, মুখ ঢেকেছে, কানে ছিপি চাপা দিয়েছে। কিন্তু তাদের গুহ্যদ্বার খোলা। সেখানে পরশুরামের হাতল পিচ্ছিলানন্দে মাতোয়ারা করছে তাদের।

তাদের উপাঙ্গের স্থানে বিদেশ থেকে আনা কামান বসানো। সময়ে সময়ে তারা সেই কামান দেগে চলে। আমরা শুনতে পাই ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’। এদের বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভগবান কৃষ্ণের সাক্ষাত শিষ্য। তাঁরা জানেন, ঐ যারা তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা সব জিন্দা লাশের দল।

ভগবান তো বলেইছেন, ‘কার জন্য তুমি শোক করছ, অস্ত্র চালনায় দ্বিধা করছ; তুমি মারবে কি, আমি তো আগেই ওদের মেরে রেখেছি’। ভগবান আরো বলেছেন, ‘যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে, যা অতীতে হয়েছে তাও ভালই হয়েছে, আর যা যা হবে, তার সবও ভালই হবে’। এবং এরপর ইতিহাসে ভাল মানুষের যুগ শুরু হলো। দুই বছর ধরে আমরা ভাল মানুষদের শাসনে রয়েছি। এবং ভালই আছি।

জিন্দা লাশের আবার মন্দ কিছু থাকতে পারে নাকি? কারণ সে তো নিজেই মূর্তিমান মন্দ। আমরা সেই মন্দদের দলে থেকে কাকুতি করি, ‘ভগবান আমাদের মারো ক্ষতি নাই, কিন্তু ভাল রেখো। ’ ৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ইতালিতে ফ্যাসিস্ত বাহিনী এবং জার্মানির এসএস বাহিনীর লোকেরা যথেচ্ছ রাজনৈতিক হত্যা করতে থাকে। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ে তা সাদরে সমর্থিত হয়। তারা যে কোনো প্রকারে নৈরাজ্য ও হতাশা থেকে মুক্ত হতে চাইছিল।

ফ্যাসিস্টরা একেই মোক্ষম সুযোগ গন্য করে। জার্মানীর বিপ্লবী মহিয়সী রোজা লুক্সেমবার্গ এবং ইতালির বিপ্লবী নেতা কলিয়াত্তি এই ধাক্কাতেই শহীদ হন। খুন হয় অজস্র বামপন্থি কর্মী। গণতান্ত্রিক শিবির এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে এই বীরত্বকেই জনগণের একটা অংশ যোগ্যতা ভাবতে শুরু করে। এই সাময়িক শিথিলতার ফল তাদের শুধতে হয় লক্ষ গুণ বেশি হারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশ দুটির শাসকেরা নিজের এবং অপর দেশের কয়েক কোটি মানুষকে হত্যা করে। বাংলাদেশে এখন সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই। তবে মিল আছে একটা বিষয়ে। বিচারবিহর্ভূত হত্যায় দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সায় আছে। তারা নিরাপত্তা চান, সুশীল কর্পোরেট-বন্দিত সমাজ চান।

কিন্তু এর দোহাই দিয়ে যে কেয়ামতের রাস্তা বাঁধাই করা হচ্ছে, তার দায় যে আমাদের কতভাবে শোধ করতে হবে তা কে জানে? এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করার মতো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আমাদের নাই। দিনে গড়ে তোলা বাঁধ রাতের জীবের ধাক্কায় ভেঙ্গে যায়। নাগরিকরা জোটবদ্ধ নয়। নিম্নবর্গের সংগ্রামকে নানান ফোক্করে ফেলে তছনছ করা সারা। রক্ষী বাহিনীর আমলে বিচার বহির্ভূত হত্যা বা নির্যাতন মোকাবেলায় নাগরিকদের মধ্যে থেকে আইনী সহায়তা কমিটি গঠিত হয়েছিল।

সিকান্দার আবু জাফর, বদরুদ্দীন উমর-রা সেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আজকের বুদ্ধিজীবী-শিল্পীরা ফৌজি ভিডিওতে তা রে না রে না গায় আর পাপের মেদ বাড়ায়। ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে সেই মানুষ নাই’। এই সিভিকো-মিলিটারিতন্ত্রের মডেল সবচে ভাল দেখা যায় বুশ প্রশাসনের মধ্যে। এর পরে নাম আসে ইসরায়েলের।

এসব সরকার মিয়ানমার আর পাকিস্তানের মতো নিছক সামরিক সরকার নয়। এটি নতুন ধরনের এক ব্যবস্থা। আমেরিকার নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার মতবাদ নিও লিবারেলিজমের এই-ই হলো তরিকা। আলোকিত বিশেষজ্ঞরা মগজ বেচে এরই খয়েরখাঁগিরি করে। সিভিকো-মিলিটারি জোট কর্পোরেট পুঁজির পথের কাঁটা সরায় বলপ্রয়োগের হস্তে।

সাম্রাজ্যবাদের ঢালাইমেশিনে এরা এখন এক ছাঁচে গড়া হচ্ছে। ষাট থেকে আশির দশকে ল্যাটিন আমেরিকায় যে কায়দায় গণআন্দোলন দমন করা হয়েছিল, এখানেও সে কায়দায় এলিট বাহিনী দিয়ে রাষ্ট্রের শঙ্কা নাশ করা হচ্ছে। ভারতে মাওবাদী উত্থান আর মুসলিম মিলিট্যান্সি সামাল দিতে এবং নেপালের মাওবাদী জোয়ার এদিকে যাতে না ছড়ায় তার জন্য অটুট নিরাপত্তাজাল তৈরি করা হচ্ছে। দুই দেশের পরশুরামেরা এই ব্যাপারে ভাই ভাই। ওদিকে কয়েদখানাগুলিতে বাঘ আর মোষ, সাপ আর বেজি, বিড়াল আর ভোঁদড়, উকুন আর বাঁদর সব একসঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

সময় মতো পাবলিককে ভাওতায় মজিয়ে রাখার জন্য এদের খাঁচাছাড়া করা হবে। তাদের আমরা চিনি। কিন্তু এই সিভিকো-মিলিটারি জোটের সহিংস ক্ষমতাপনাকে চিনে নেয়া কঠিন। চিনে রাখা দরকার এদের সামাজিক ভিত্তিকেও। যে সমাজ এদের জন্ম দিয়েছে, এবং মিনতি করেছে এরা যাতে সুবোধ হয়, সেই সমাজকে এরা স্বৈরশাহীর নির্দেশে একজোট হয়ে হত্যা করেছে।

বিদেশি ভগবানের বরধন্য হয়ে এরা জাতির সকল সম্ভাবনাকে বারেবারে হত্যা করছে। রাষ্ট্র এখন রক্তের স্বাদ পেয়েছে। রাষ্ট্র সর্বদাই মখমলের নেকাবে ঢাকা বলপ্রয়োগের যন্ত্রমাত্র। দরকারে সেই নেকাব সরতে মুহূর্তও বিলম্ব হয় না। সেই যন্ত্রকে দশ হাতে সশস্ত্র করার জের সহজে শেষ হবার নয়।

চাইলেই একে নিরীহ করা যাবে না। সেই উপায় রাখা হয় নাই। কুঠার এখন পরশুরামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ না ক্ষত্রিয়কুল নাশ হয়, ততক্ষণ সে আঘাত করতেই থাকবে। তারপর নিজেকে খাবে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান একদা দেখতে চেয়েছিলেন যে, সিভিল সোসাইটির উদ্যোগ-আয়োজন সংঘাতের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে (১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০০, ডেইলি স্টার)। সেই চ্যালেঞ্জের ফজিলত যা ফলেছে, তাতে তাদের মনে শোচনা জাগা উচিত। কারণ যা ভোগ করা অবৈধ তা তাঁরা ভোগ করেছেন। যা তাঁদের করার কথা নয়, তা তাঁরা নির্দ্বিধায় করেছেন। আমরা জানি, সেই শোচনা আর জাগবার নয়।

একইরকম অপরাধে অয়দিপাউসের নিজের প্রতি ঘৃণায় নিজের দুই চোখ অন্ধ করে পথে পথে মানুষকে হুঁশিয়ার করে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন; এদের ততটা পাপবোধও নাই। চোখ খোলা রেখেই এরা দেশমার্তৃকার হত্যা ও ধর্ষণ উপভোগ করবে। প্রভুরা বলেছে, যখন ধর্ষণ অনিবার্য তখন উপভোগ করাই শ্রেয়। এমনকি সয়ে গেলে আনন্দও লাভ হতে পারে। এতদিন পর, দেখা যাচ্ছে তারা পরমানন্দেই আছেন।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।