আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেনেভায় সাভারের ঘটনার ছায়া

জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশ-বিষয়ক পরিবীক্ষণ সভায় ঘুরেফিরে নারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা, সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধতা ও অনেক ক্ষেত্রে অক্ষমতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
পুরো অধিবেশনেই সাভারের ভবনধসের মর্মান্তিক ঘটনা ছায়া ফেলে। সাধারণভাবে সব দেশের প্রতিনিধিরা সমবেদনা এবং শোক প্রকাশ করলেও পাশ্চাত্যের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করতে না পারার জন্য উদ্বেগ জানিয়ে দ্রুত সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে।
আইনের শাসন প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, বিনা বিচারে হত্যা, গুম বা অপহরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাবের মতো বিষয়গুলো। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন দাতা দেশগুলোর প্রতিনিধিরা।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক কার্যক্রমে নিরপেক্ষতা ও এটিকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করার বিষয়ও আলোচনায় আসে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে গত চার বছরে গৃহীত এবং সূচিত বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ প্রশংসা পেলেও সেগুলোর অপূর্ণতা এবং যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে না পারায় দেশটিকে জাতিসংঘ ফোরামে অনেক বিষয়েই গুরুতর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় বাংলাদেশের পরিস্থিতির যে পরিবীক্ষণ সভা গতকাল সোমবার জেনেভায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ঘাটতির প্রসঙ্গ তুলে প্রধানত উন্নয়ন-সহযোগী দেশগুলো তাদের উদ্বেগ প্রকাশে সরব ছিল।
প্রতিটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার অনুসৃত চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত সর্বজনীন পরিবীক্ষণ বা ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউতে (ইউপিআর) এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় পরিবীক্ষণ। এ অধিবেশনে প্রথমে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বাংলাদেশের নিজস্ব মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

এতে গত চার বছরে তাঁর সরকার যেসব আইনগত এবং নীতিগত সংস্কার সম্পন্ন করেছে এবং যেগুলো বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোর বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চার বছর আগে প্রথম ইউপিআরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব পরিকল্পনা এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে।
অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা আলোচনায় অংশ নেন। সময়স্বল্পতার কারণে অধিকাংশই তাঁদের বক্তব্য সুপারিশ পেশ করার মধ্যেই সীমিত রাখেন। দীপু মনি মোট তিনবার আলোচনায় অংশ নেন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের প্রশ্নের জবাব দেন।


যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ কতটা অনুপযোগী, তার দৃষ্টান্ত হিসেবে সাভারের ভবনধসের ঘটনার উল্লেখ করে শ্রমিকদের নিরাপত্তার মান উন্নয়ন এবং সমিতি বা ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেন। এ ছাড়া যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর তদন্ত ও বিচার এবং র‌্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ঘটনাগুলো তদন্তের আহ্বান জানানো হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) মান উন্নয়ন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক ছয়জন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার যৌথ বিবৃতিতে যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলোর সমাধান এবং স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাতে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জাপান এবং আরও কয়েকটি উন্নয়ন-সহযোগী দেশের কূটনীতিকেরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার বিষয় উল্লেখ করে তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।


র‌্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিনা বিচারে হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের অন্য দেশগুলোর মতো নেদারল্যান্ডসও উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়মুক্তির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানায়।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি খুব খোলামেলাভাবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার উল্লেখ করে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি এ ধরনের সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।
কানাডা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে নাগরিক গোষ্ঠী বা সুশীল সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর হয়রানি এবং চাপ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করে তারা যাতে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে, সে রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়। শরণার্থীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়ারও আহ্বান জানায় কানাডা।


সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এসব দেশের প্রতিনিধিরা নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের সুরক্ষার বিষয়ে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়ে অধিকাংশের সুপারিশ হচ্ছে পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর ওপর সহিংসতাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলার অপব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে নরওয়ে এ বিষয়ে আইন সংস্কারের সুপারিশ করেছে।
ডেনমার্ক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে একটি সময়সূচিসহ পথরেখা ঘোষণার আহ্বান জানায়।

সেখানকার ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির কাজে অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে তারা।
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে কিছু অপ্রীতিকর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে, দ্বিতীয় পালায় অস্ট্রিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, জাপান, হাঙ্গেরির বক্তব্যে এসবের প্রতিফলন দেখা গেছে। অস্ট্রিয়ার দূত বলেছেন, নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিষয়ে আইন থাকলেও তা প্রয়োগে ঘাটতি দেখা যায়। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল, দাতারা ছাড়াও অধিকাংশ দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলোপের আহ্বান জানিয়েছে এবং অন্ততপক্ষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা পুরোপুরি বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে।

প্রতিবেশী ভারতের প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংস্কারগুলোর প্রশংসা করেছেন। তিনি কোনো সুপারিশ করেননি।
দীপু মনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় তাঁর সরকারের পাশে দাঁড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। দীপু মনি আইসিটির বিষয়ে বলেন, এ ক্ষেত্রে সবকিছুই আন্তর্জাতিক মান অনুসারে করা হচ্ছে এবং এই ট্রাইব্যুনাল পুরোপুরি স্বাধীনভাবে ন্যায়ের নীতিতে কাজ করছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দেশের আইনে এর কোনো সুযোগ নেই।

নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, অপহরণের ঘটনা ঘটে থাকে এবং অনেক সময় অপরাধীরা নিরাপত্তা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে। বিদেশে যাঁরা এ অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন, তাঁরা আসলে একটি প্রচারণার ফাঁদে পড়েছেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বা বাড়াবাড়ির অভিযোগ সব সময় ঠিক নয়। আইন অনুসরণ করেই তারা শক্তি প্রয়োগ করে এবং সে জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা এই পর্যালোচনার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করবে কাল বুধবার এবং এ বিষয়ে ভোট গ্রহণ হবে বৃহস্পতিবার।


জেনেভার জাতিসংঘ দপ্তরে এই আলোচনার সময় বাইরে একদল বাংলাদেশি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রতি সমর্থন চেয়ে এবং সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন ফেস্টুন নিয়ে অবস্থান করে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.