আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মামার বিয়ের শাড়ী, আমাদের পুতুল খেলা আর ছড়িয়ে যাওয়া জীবন |

সবকিছুতেই নির্মোক থাকছি, সবকিছুই ইদানীং অর্থহীন মনে হয়; নিজের এই নেতিবাচক প্রবণতায় নিজেই লজ্জিত ।:(

আমরা থাকতাম উনিশ নাম্বার বিল্ডিং এর গেট ‘এ’ তে,পিছনে বিশাল মাঠ আর সামনে রেললাইন| মাঠ পেরিয়ে একটু পরেই ছিলো পাহাড়| নিচতলার কামরুল মঞ্জু দুই জমজ ভাই আর দোতালার পিংকি দের পুতুল বরের সাথে আমাদের তিনতলার পুতুল কনের বিে| আয়োজন মোটামুটি সম্পন্ন, কাঠি আর দর্জির দোকানের টুকরো কাপড়ের তৈরী আসবাবপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে , রেললাইনের পাশের বুনোফুল কুড়িয়ে এনে বিয়ের আসর সাজানো ও হয়ে গেছে; বাকী আছে শুধু খাওয়া দাওয়া আর বিয়েটাই| পিচ্চি রুমিকে লাগিয়ে দিয়েছি রান্নাবান্নায়, সোৎসাহে সে পোলাও োরমা কালিয়া রেজালা সব রেঁধে ফেলছে (উপকরণ - গুড়ো মাটি, ... ফুলের গোটা, এন্না গোটা, নারকেলের মালা)| হঠাৎ বরপক্ষের ব্যাংগ , ‘তোমাদের মেয়েকে লাগতেছে ফকিরনীর মতো, এইটা কী পড়িয়ে আনছো?’ সাথে সাথে নাজমুনের ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না| রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে হচ্ছিলো কামরুলটাকে দুহাতে ধরে দোতলা থেকে ড্রেনে ফেলে দেই, কিন্তু ও যে বরপক্ষ! তারউপর ওই গাধা তখনই ছিলো সাড়ে তিন মণ আটার বস্তা| পিচ্চি পিচ্চি দুটো হাতে সব খাবার-দাবার ছিটাতে লাগলো নাজমুন, খেলাই বানচাল হয়ে যায় এই অবস্থা| হঠাৎ আমার খেয়াল হলো আম্মু, ছোটখালা আর বড়মামা তো গতসপ্তাহে সুন্দর সুন্দর শাড়ীকাপড় এনেছেন (বড়মামার বিয়ের আয়োজন চলছিলো তখন)| নাজমুনকে বললাম , ‘জানিস আম্মুর আলামারিতে না খুব সুন্দর সুন্দর শাড়ী আছে| কান্দিস না , আমরা ওইগুলা দিয়ে আমাদের মেয়ে বিয়ে দিবো’| নাজমুন তো খুব খুশী, কান্না থেকে ফিক করে হেসে দিয়ে একলাফে দুইটা সিঁড়ি ভাংতে লাগলো, একলাফে দুইটা সিঁড়ি ভাঙ্গাই ছিলো তখন আমাদের মহা গর্বের ব্যাপার| ওর আম্মুর সেলাইকলের ড্রয়ার থেকে কাঁচির জোগাড় হলো, আমার আম্মুর আলমারিও খোলা হলো, গোল বাধলো প্রথমে শাড়ী নিয়ে| অনেকগুলা শাড়ীর মাঝে তিনটা শাড়ী খুব সুন্দর (পরে জেনেছিলাম ওগুলোকে বিয়ের মূল, প্রথম আর দ্বিতীয় শাড়ী বলে)| কিন্তু ওইগুলার মধ্যে কোনটা নেবো তাই বুঝতে পারছি না, সবই সুন্দর লাগে| অনেক তর্কাতর্কির পর লাল-সোনালি জমকালো শাড়ীটাই আমাদের পছন্দ হলো| আবার বাধলো গোল, কারণ আমাদের লাগবে অল্প একটুকু , আর এই শাড়ীটা বিশাল| তাই মহা বুদ্ধি করলাম, ভাঁজ না খুলেই মাঝখানে পুতুলের মাপে কিছুটা কেটে নিলাম| ভাঁজ খুললে যদি আম্মু বুঝে যায়! ওমা , এদিকে দেখি অনেকগুলো টুকরো হাতে চলে এসেছে| যাই হোক কয়েকটা নিয়ে আমরা পুতুলের শাড়ীতো বানালামই , খাট ও সাজিয়ে ফেললাম| বরপক্ষ এইবার লা-জওয়াব| বিয়ে টিয়ে তো শেষ হলো, ধুমসে খাওয়া-দাওয়া ও হলো; হাপুস হুপুস কেঁদে কেটে আমরা আমাদের মেয়েকে ও বিদায় দিলাম| দুপুরের খাবারের পরই ডাক পড়লো আমাদের , আমরা তখন পিঙ্কিদের বাগানে হল্লা করছি| সবাই মিলে বাসায় এসে দেখি, আম্মু ওই শাড়ীটা হাতে ধরে আছেন নির্বাক| ভাবগতিক সুবিধার না তা বুঝতেই পারছিলাম, কিন্তু কতটা খারাপ তা ওই ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আন্দাজ করতে পারিনি| ‘আন্টি আমারে কয়েকটা দেন এই কাপড়ের টুকরা, পরের বার বিয়েতে আমরা মেয়েপক্ষ’, পিঙ্কির আবদার! আম্মার প্রশ্ন,‘ কে কাটছে এইটা?’ আমরাতো মোটামুটি নিশ্চিত , কারণ বেশী তো আর কাটি নাই, অল্প (!) একটু আর কী| তাই নাজমুনের উত্তর, ‘কাকীমা আমাদের মেয়ের কাপড় সাজানোর জন্য অল্প একটু নিয়েছি|’ আমাদের পাশাপাশি দুই বাসায় একটা অলিখিত নিয়ম ছিলো, সেটা হচ্ছে আমাদের মধ্যে যেই অকাজ করুক না কেন সেটাকে যৌথ অবদান ধরা হতো| সুতরাং একজন কিছু করলেই পিটুনি জুটতো দুজনের| মাঝে মাঝে যোগ হতো কামরুল আর মঞ্জু| আবার আন্তঃবাসীয় বিচারিক চুক্তি ছিলো মনে হয়| যেকোনো বাসায় পিটুনি খাবার অবাধ সুযোগ (?) ছিলো আমাদের, গেট উনিশের ‘এ’ হলেই চলবে| সুতরাং আমার ও নাজমুনের শৈশবের সবচাইতে স্মরনীয় ‘পিটুনি’টা খেলাম ওই দিন| নাজমুনের আম্মুও পাশের বাসা থেকে এসে আম্মুকে বেশ কিছু উপকরণ সরবরাহ করলেন| আমরা দুজন বারবার বলে কয়েও এই বুড়ো বোকাদের বুঝাতে পারছিলাম না যে, আমরা খুব বেশী নেইনি| শুধু যদ্দুর লাগবে তদ্দুর নিয়েছি| কিন্তু কে শোনে কার কথা| বড়োরা যে বড্ডো বোকা হয় তা ওইদিনই বুঝতে পেরেছিলাম| কান্না-ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে দুজন কাঁদতে লাগলাম, তারপর কেনো জানি আম্মুর খাট আর দেয়াল আলমারির ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়লাম| এদিকে বিকালে মামা এসেতো এই অবস্থা দেখে মাথায় হাত, কিন্তু আমাদের খোঁজ করে আর পাননা| খোঁজ খোঁজ খোঁজ| নিচে মাঠেও নাই, সিঁড়িতেও নাই, কোথাও আমাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না| পরে শুনলাম, সবার মাঝে কান্নাকাটি পড়ে গেছে – দুপুরের পর আমরা কোথাও বেরিয়ে পড়েছি এরকমই ধারণা সবার| ঘুমের মাঝে বোধহয় কোঁ কোঁ করছিলাম, মামাই খুঁজে পেলেন আমাদেরকে| দুহাতে দুজনকে কোলে নিয়ে আম্মুদের উপর রেগেমেগে যে বকাবকি শুরু করলেন , তা আর বলার মতো নয়| পারলে ওনারা তখনই সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে বনবাসী হন| মামা খুব পছন্দ করতেন পিচ্চিদের , আর আমরা আমাদের সেই ‘অল্প কেটেছি’ যুক্তি মামাকে বলতে লাগলাম| মামাও অম্লানভাবে মেনে নিলেন , সবাইকে বললেন ,’সত্যি অল্পই কেটেছে তো’(!)। শাড়ীটা বড়মামী রেখে দিয়েছিলেন স্মৃতি হিসাবে| অনেকদিন পর বড়ো হলেও বড়মামী আমাকে খেপানোর জন্য বলতেন,’তোর বিয়ের সময় আমি এটা দিয়ে তোর বউকে আনবো’; আমি হাসতাম | নাজমুনের সাথে দেখা হলেও খেপাতেন খুব| বড়মামী খুব অকালে ভুল চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে , তার চারটি ছোট মেয়েকে রেখে| ওনার রুমে এখনো রাখা আছে সেই শাড়ীটা| মাঝে মাঝে গেলে দুহাতে গন্ধ নেই, সরল শৈশবের| সেই মুখগুলো আজ ভাসে নস্টালজিক স্বপ্নের মাঝে, কচি সেই কান্নাভেজা মুখ, বড়োমামার বুকে জড়িয়ে আছি দুজন, খাটের নিচের অভিমানী ঘুম , লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি ভাঙ্গা ; ঘূর্ণিঝড়ের মতো বয়ে যাওয়া এখনকার জীবনের মাঝে একমাত্র যারা তৈরী করতে পারে স্থিতিজড়তা – কিন্তু সব্বাই আজ কোণ সৃষ্টিকারী দুটো সরলরেখার মতো অপসৃয়মান| দূরে থেকে কেবলই দূরে যায়|

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।