আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদরের সহোদর

"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"

এখন একটি স্লোগান প্রায়ই শুনি, পড়ি - 'ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট'। আবার চীন নামক দেশে না কি একটির বেশি সন্তান কেউ নিতেই পারবে না। এগুলো যখন ভাবি তখন মনে হয় ভাগ্যিস আমার বাবা মা দেশের চলিত স্লোগানের সময় পিতৃত্ব মাতৃত্ব পাননি, তার আগেই তারা সেই খাতায় নাম লিখিয়েছেন তা না হলে তো আমার কোন ছোট ভাই থাকতো না! আমার ছোট ভাই আমার চাইতে কত ছোট? মাত্র তিন বছরের। ওর কাছে বয়সের এই ফারাক কোন ব্যাপারই না।

ও তাই মুখে কথা ফোটার বয়স থেকেই আমাকে বীরদর্পে নাম ধরে ডেকে যাচেছ। এখনো ডাকে। আম্মু কতবার বলেছে 'তোর একটা মাত্র বোন, তাকে আপু ডাকিস না কেন?' উত্তরে ও না বলেনি কখনোই কিন্তু আপু ডাকেনি। ভাইবোনদের ভেতর যেগুলো মেজ থাকে সেগুলো না কি শয়তান হয়। আমি কম দুষ্টু না।

ভাইদের নানা ফন্দি ফিকির করে আমি বরাবরই মার খাইয়ে এসেছি। বিশেষ করে আমার চাইতে চার বছরের বড় ভাইকে। একমাত্র কন্যা সন্তান তার উপর শারিরীকভাবে একটু দুর্বল হওয়াতে আমার মায়ের আমার প্রতি একটু বেশিই পক্ষপাতিত্ব ছিল, এখনো আছে। তো আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার, অপব্যবহার কোনটা করতেই কখনো কসুর করিনি। আমার ছোট্ট ভাইটা একদম নীরবেই বড় হয়েছে।

কোন গোলমাল করেনি, পড়াশুনা নিয়ে গ্যাঞ্জাম করেনি, বিশেষ কিছুর আব্দার ও কখনো করেনি। আজকে হঠাৎ মনে হলো পিচ্চি আর পিচ্চি নেই, বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে নিজে নিজে রান্না করে চাকুরী করে নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকার মতো বড় ও হয়ে গেছে। যতই মাস্তান হই পিচ্চিকে মনে মনে অনেক আদর করি, সেটা ও দূরে যাওয়াতে প্রতিদিন টের পাই। আহা আমার রাগী ভাইটা! মাত্র দাঁড়াতে শিখেছে, হাঁটতে শিখেছে- ও কি যেন দিতে বললো, কাজের মেয়ে বুঝতে পারেনি তাই দেয়ওনি, পিচ্চি সুজন ডাইনিং টেবিলের উপর দাঁড়ানো, রেগে পানি খাওয়ার ছয়টা গ্লাসই লাত্থি দিয়ে নীচে ফেলে দিলো, কাঁচের গ্লাসগুলো নিমেষেই চুরচুর। আমাদের আম্মু চাকুরী করতো, তাই সুজন সেভাবে আম্মুকে সারাদিন পেতো না, কাজে কাজেই ও একটু জেদি, একটু গোঁয়ার হলো।

বড় হতে হতে যুক্তি দিয়ে চলা শিখলো, গোয়ার্তূমি তিরোহিত হয়ে গেল সময়ের ফাইন টিউনিং এ। কাজের মেয়ের তত্ত্বাবধানে বাচ্চা মানুষ করার যন্ত্রণা মা'দের চাইতে ভালো আর কে জানে! সুজন আটমাসের, বিছানার উপর হিসু করে দু’হাত দিয়ে মজা করে ছপছপ শব্দ করে খেলছে, কাজের মেয়ে মেঝেতে বসে খাটের উপর মাথা রেখে ঘুম। আম্মু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে সেদিন, জানালা দিয়ে কাজের মেয়ে ফুলিকে ডাকতে গিয়ে দেখে এই দৃশ্য। ও যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি তখন যদি ওকে জিজ্ঞেস করা হতো সারাদিন কি করেছো? ও বলতো আমার কত কাজ! দাঁত মাজা, মুখ ধোয়া, কাপড় পরা, নাশতা খাওয়া... আমি স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়ে এলাম, ওকে রেখে আমি আর আববু এতক্ষণ কোথায় ছিলাম এই জিদে ও আমাকে পিঠের মাঝখানে দিলো মার। তখন ব্যথা পেয়েছি।

এখন তা কতই না মধুর, হাহ্ হাহ্ আব্বু সাইপ্রাস থেকে এসেছে, সুজনের জন্য একটা গোলাপী গেঞ্জি স্যুট নিয়ে এসেছে। ও যেখানেই যাবে ঐ ড্রেসটা ছাড়া পরবে না। সে এক মহা অবস্থা...ভেজা থাকলেও ও ঐটাই পরবে! তারপর তো একদিন পিচ্চি আমার স্কুলেই ভর্তি হলো। দু ভাইবোন একসাথে যাওয়া আসা করি। একদিন কি বৃষ্টি, রাস্তায় পানি, ক্ষীণকায় আমি ভাইকে ঠিকই কোলে করে পানিটুকু পার করলাম।

আমি যে জামা পরতাম, যেই টিপ দিতাম ও সেটাই দিতে চাইতো দু তিন বছর বয়স পর্যন্ত। ও ক্লাসে ফার্স্ট বা সেকেন্ড এর বাইরে কখনো হতো না। আমি আমার সীমিত জ্ঞানে ছোট ভাই এর টিচার হতাম, নিজের হোমওয়ার্ক করতাম আবার ওকেও দেখিয়ে দিতাম। ভাইয়া এবং আমি ওকে যারপরনাই ক্ষ্যাপাতাম। কি কি সব ছবি এঁকে বলতাম এটা তুই, ও কেঁদে দুনিয়া মাথায় করতো।

ভাইয়া একদিন আম্মুর সেলাই মেশিনে সেই হাবিজাবি ছবি প্লাস্টিক দিয়ে সেলাই করে আমাদের পেয়ারা গাছে ঝুলিয়ে দিলো। আমাদের অত্যাচারে ওর জীবন মোটামুটি অতিষ্ঠ ছিলো। একসময় ওর নাম হয়ে গেল 'সবুজ প্যান্ট'। কারণ ও যখন ফুলপ্যান্ট পরা শিখলো তখন ওর একটা প্যান্ট ছিলো সবুজ, আর যেখানেই যাবে ও সেই সবুজ প্যান্ট ছাড়া কিছুই পরবে না। এই স্বভাব ওর এখনো আছে, এখন পরে একটা ধূসর হয়ে যাওয়া নেভি ব্লু প্যান্ট, এমন কী দুবাই যাবার সময়ও ওটা নিয়ে গেছে; ব্যাংকক ট্রেনিং এ যাবার সময় ঐ প্যান্টটাই পরে গেছে।

জরি দেয়া কাপড়চোপড় আমরা তিনভাইবোনের কেউই পছন্দ করি না। এক ঈদে সুজনের জন্যে আম্মু জরি দেয়া টুপি আনলো, আমি আর ভাইয়া রায় দিয়ে ফেললাম জরি দেয়া কাপড় বিহারীরা পরে; ব্যস্ আর যায় কোথায় ওকে কোনভাবেই সেই টুপি পরানো যায়নি। আমরা দুভাইবোন পাল্লা দিয়ে কোরআন শরীফ খতম দিয়েছি। একসাথে খেলেছি, এই সেদিন পর্যন্তও আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যারম বোর্ড খেলেছি। আমার সেই ভাইটা এখন টাকা রোজগার করতে এত দূরদেশে চলে গেছে।

আমি অফিস থেকে এসেই আর বলতে পারি না 'জানিস আজকে কি হয়েছে... 'আমি অফিস ফেরত এসেই সুজনকে ফোন করতাম 'তুই কখন আসবি?'। আমার সেই রুটিন কাজ এখন আর নেই। আমার কোন কাজ করার জন্য বিরক্ত করব এমন কেউ এখন আর পাশে নেই। নতুন কি মুভি আসছে আমি জানি না, আমাদের সাপ্তাহিক মুভি শো এখন আর হয় না। আমি ওর কম্পিউটারটা মুছি মাঝে মাঝে।

এসএসসি পরীক্ষার সময় বেচারার চরম জ্বর, পক্স। আমার দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা। আমি অসুস্থ,হাসপাতালে। পিচ্চি নামায পড়ছে, আমাকে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। আমার বিয়ে পিচ্চি তার বন্ধুদের নিয়ে সব নীরবে করে যাচ্ছে।

আমার চোখের সামনে শত শত ক্লিপিং ভেসে যাচ্ছে, সময় দিনক্ষণের হিসাব না করেই। এই যে যে পিসিতে বসে আমি লিখছি সেটাও পিচ্চির কিনে দেয়া। বাসার বারোয়ারি পিসিতে আমার লেখালেখির সমস্যা হয় দেখে ও কিনে দিয়েছে। চাপা ভাই আমার, ভীষণ চাপা স্বভাব। আমি কলেজে পড়ি, দুপুরে বাসায় এসে দেখি ও ঘুমে।

কি ব্যাপার? এ সময় তো সুজনের ক্রিকেট খেলার কথা, ওর বন্ধুরা সবাই খেলছে, ও কাঁথা গায়ে শুয়ে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বর, বললাম কি হয়েছে? বলে হাতে একটু ব্যথা। ওমা, হাত ফুলে দুইটা হাতের সমান হয়ে আছে। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে হাত ভেঙ্গে শুয়ে আছে কাউকে কিছু না বলে। ওর এমনই সহ্য ক্ষমতা।

পরে নিজেই গিয়ে হাত প্লাস্টার করে এলো। ছুপে রুস্তম এইচএসসি তে স্ট্যান্ড করে ফেললো! আমাদের নিরানন্দ পরিবারে প্রথম সত্যিকারের সুখের মতো ঘটনা। রেকর্ড সময়ে বিবিএ পাশ করলো। সেই কুট্টি বয়স থেকে টিউশনি করেছে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে চাকুরীতে ঢুকেছে, নিজের যোগ্যতায়, কেউ জানেও না।

আমার ছোট্ট সোনা ভাই তৃতীয়পক্ষেও মতো নিশ্চুপে সব কাজ করে গেছে। কাউকে কোন অসুবিধায় না ফেলে। আমার ত্রিশ বছর বয়সে ত্রিশদিনও কোথাও থাকিনি, সুজনকে ছাড়া। এখন তো দুমাস হয়ে গেল। আমাদের বিচ্ছেদের সময় সমাগত।

তিনভাইবোন কোথায় কোন দেশে থাকব কে জানে! মা দিবস হয়, বাবা দিবস হয় পালিত, আমার বুকে প্রতিদিন ভাই দিবস। আদরের সহোদর, তোকে মনে পড়ছে নিরন্তর...

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।