আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২০১৫ সালের বাংলাদেশ- জ্বালানী সংকট এবং অন্যান্য ভাবনা ২



আকাশচারী যানবাহনে আকাশ পথে ট্রাফিক বসাতে হবে ভবিষ্যতে, আমার কল্পনার ২২ শতক এমন না। অন্তত হলিউডের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বাইভার্বলের দুঃস্বপ্ন দেখি না। আমার নিজের ধারণা ক্রমশ আমাদের অগ্রগতি পেছন দিকে হবে। বিশ্বব্যাপী খনিজ জ্বালানী সংকটে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আমরা খুব দ্রুতই প্রাণীচালিত বাহনে অভ্যস্ত হয়ে যাবো। আমাদের স্থানিক সরণ কমে যাবে, আমাদের কম্পিউটারের মাধ্যমে যোগাযোগ, অন লাইন ব্যংকিং বেড়ে যাবে।

মূলত বিদ্যুত চালিত যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাবে, শহরের রাস্তায় ট্রাম চলবে, ভবিষ্যতে ট্রামই হবে গণযোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বিশ্বের অনেক দেশে এখনও ট্রামের অবকাঠামো রয়ে গেছে, লাভবান হবে সেইসব দেশ। জেট ইঞ্জিন তখনও হয়তো থাকবে, বিজ্ঞানের উপর অবিচল আস্থা স্বত্তেও মনে হচ্ছে না এমন ব্যবস্থায় খুব বড় বিদ্যুতচালিত জেট ইঞ্জিন নির্মাণ সম্ভব। হয়তো বায়োফুয়েলে চলতে পারে এমন জেট ইঞ্জিন নির্মিত হবে। পৃথিবীতে পাম গাছের সংখ্যা বেড়ে যাবে, আমাদের ভবিষ্যত বিবর্তনের শুরু এমনই হবে আজ থেকে ১০০ বছর পরে আমাদের পুনরায় স্বপ্ন দেখতে হবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার।

বোরাকের স্বপ্ন দেখে কালাতিপাত করতে হবে। সে বিশ্ব এখনকার তুলনায় অনেক সবুজ হবে সেটাতে সন্দেহ নেই। মানুষ পুনরায় যন্ত্রযুগ ছেড়ে কৃষিযুগে প্রত্যাবর্তন করবে একটু ভিন্নভাবে। সে জগতে বিদ্যুত চাহিদা পুরণের জন্য আমাদের প্রকৃতিক উৎসের উপরে নির্ভরশীল হতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক শক্তির মূল উৎস সূর্য্য।

সূর্যের তাপ ব্যবহার করে বিদ্যূত উৎপাদন কিংবা বায়ুচালিত বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র কিংবা পানিবাহিত বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প, আমাদের সামনে এই কয়েকটা পথই খোলা। এর বাইরে আছে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যূত উৎপাদনের ধারণা। বিশ্বের কয়েকটি দেশ বিদ্যতের জন্য সম্পূর্ণ ভাবেই পারমাণবিক শক্তির উপরে নির্ভরশীল। তবে বাংলাদেশ এখন ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করে পারমাণবিক জ্বালানী ব্যবহার করে। ভবিষ্যত বাংলাদেশে পরিকল্পনা আছে পারমাণবিক জ্বালানী ব্যবহার করে ২০০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প শুরুর।

তবে সেটা শুরু হবে কবে আমরা জানি না। আপাতত যতটকু জানি বাংলাদেশ ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটা কেন্দ্র স্থাপন করতে আগ্রহী যেটার মূল জ্বালানী হবে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ। প্রাকৃতিক উৎসকে ব্যবহার করবার বিকল্প আসলেই নেই, আমাদের প্রকৃতি নির্ভরতা বাড়াতেই হবে। খনিজ তেল এবং গ্যাস উত্তোলন করে দীর্ঘ মেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখা সম্ভব না। বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ বিদ্যুত নির্ভর যন্ত্র, কল কারখানাও মূলত বিদ্যুত নির্ভর।

বিদ্যুত উৎপাদন কমে যাওয়া মানে কল কারখানাগুলো বেকার হয়ে যাওয়া। ভবিষ্যত বাংলাদেশ কি এমন সারি সারি কারখানার এপিটাফে ভরে থাকবে? বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোনো দিন কি বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত হবে? বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিশ্বের প্রতিটা দেশই বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করেছে, তাদের বাৎসরিক বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধির হার বাড়ছেই। শ্রমিক নির্ভরতা কমিয়ে তারা আরও বেশী উৎপাদনশীল হওয়ার প্রচেষ্টা করছে। কায়িক পরিশ্রমকে দুরে সরিয়ে রেখে তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করছে সকল কাজের জন্য সহায়ক যান্ত্র নির্মানে। রোবটিক্সের রমরমা অবস্থা।

আমাদের বাংলাদেশে সস্তা শ্রম, শ্রমিক নিরাপত্তা নেই, শ্রম আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই, কল কারখানায় শ্রমিক নিরাপত্তার কোনো বিধিমালা নেই। অসংখ্যা ভাবেই ঝুঁজিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে তবুও মজুরের অভাব নেই। এই বাস্তবতা বাংলাদেশের অভাবের প্রকটতাকে পরিস্কার করে। বাংলাদেশের বিদ্যুত উৎপাদন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কমতি নেই। বিদেশী কোম্পানিও বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহী।

তাদের কাছে আমাদের বিদ্যুত কিনতে হবে। এবং বিদ্যুতও মহার্ঘ হবে সময়ের সাথে। বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বিদ্যুত আমদানি করে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠবার প্রয়োজনীয়তা আছে কি আদৌ? যদি বাংলাদেশের সরকার কোনো পরিকল্পনা না করে, যদি বাংলাদেশের সরকারের এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না থাকে তবে বাংলাদেশকে বিদ্যুতের জন্য নেপাল কিংবা বার্মার কাছে কিংবা ভারতের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। তাদের শর্তে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুত ক্রয় করতে হবে। বাংলাদেশের সরকারের নিজস্ব আয়ের উৎস নেই, জনগণের ট্যাক্সের টাকাই বর্তমানে সরকারের আয়ের প্রধান উৎস।

বাংলাদেশ সরকারে অনেক উৎপাদনমুখী শিল্প ছিলো, উৎপাদনমুখী এবং সেবামূলক খাতগুলোকে প্রতিদিনও বিরাষ্ট্রীয়করণের ভুতটা কবে থেকে চেপে বসলো বাংলাদেশের সরকারে কাঁধে? এরশাদ সরকারের সময়? জিয়ার সময়? মুজিবের সময়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে কল কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান ছিলো। সেবামূলক খাতের বাইরে বেসরকারী পর্যায়ে কল কারখনা থাকলেও এখনকার মতো প্রতিষ্ঠান ছিলো না কোনো। হয়তো বেসরকারী উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রন এবং এটাকে উৎপাদনশীল করতে অধিকতর যোগ্য, তবে যোগ্য পরিচালকের পরিচালনায় যেকোনো প্রতিষ্ঠানই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার সকল উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ্যা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, এমন নিখুঁত লাইগেশনে সরকার নিজেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এখন রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের ঘাড়ে বোঝা।

হয়তো আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, কাঁচামালের অভাব কিংবা অব্যবস্থাপনা, কিংবা এসবের সম্মিলিত প্রভাবেই এই বেহাল অবস্থা। সরকার নিজের খরচে একটা বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে পারবে না। সরকারের কর্মচারীর বেতন এবং নানাবিধ ভর্তুকি দিয়ে সরকারের হাতে তেমন উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকে না। সরকার দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ গ্রহন করতে পারে। তবে সরকারের প্রতিষ্ঠান চালানোর অদক্ষতা এবং পরিকল্পনার অদক্ষতায় এই উদ্যোগও ব্যর্থ হতে পারে।

কিন্তু এর বাইরে কোনো বিকল্প কি আছে? সরকার নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৮টি রাষ্ট্রায়ত্ব পাট কল বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দিবে। আবারও সরকারের ভেতরের বিরাষ্ট্রীয়করণের মামদোবাজি শুরু হয়েছে। এখানের ছাটাই করা শ্রমিকদের কোথায় নিয়োগ দেওয়া হবে এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। সরকার কোনো রকম দায়বদ্ধতার নিদর্শন রাখছে না। তাদের বক্তব্য এই ছাটাইকৃত শ্রমিকদের যদি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় তবে তারা সেখানে কাজ করতে পারবে।

গত বছর সেপ্টেম্বরে যা হয়েছিলো, দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ থাকা এবং লে অফ থাকবার ফলে সেখানের শ্রমিকদের অনেকেই অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছিলো। চিকিৎসার অভাবে, খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবনযাপণে বাধ্য হয়েছিলো শ্রমিক পরিবারগুলো। এবং সেখানের শ্রমিকের স্ত্রী-কন্যারা পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছিলো ক্ষুধার তাড়নায়। ক্ষুধা মারাত্বক মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের পাটকলগুলোতে যখন পর্যাপ্ত কাঁচামাল নেই তখন বাংলাদেশ থেকে পাটজাত কাঁচামাল রপ্তানির হার বেড়েছে ৮ শতাংশের মতো, সেই পাটজাত কাঁচামাল ভারতের কল কারখানায় রপ্তানী হয়েছে এবং বাংলাদেশের পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানীর হার কমেছে ১০ শতাংশ।

আমাদের বিনিয়োগের লক্ষ্য আদতে কি? বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়া কোনো সুবিবেচনার কাজ নয়। বিশেষত যখন সরকার নিয়ন্ত্রনও করতে পারে না বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আমাদের ভবিষ্যত বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা এবং বিদ্যুত সঞ্চালন পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত ভাববার অবকাশ আছে। এই নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.