আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপন্ন মাজার সংস্কৃতি ( একটি কপিপেস্ট পোস্ট)



সাইমন জাকারিয়া একটু নজর দিলেই বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের পাশেই একটি না একটি মাজারের অবস্থান লক্ষ করা যায়। বঙ্গভবন থেকে শুরু করে হাইকোর্ট, মেডিকেল কলেজ, কেন্দ্রীয় কারাগার, এফডিসি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, এমনকি বাংলা একাডেমী ও বাংলাদেশ পরামাণু শক্তি কমিশনের কোল ঘেঁষেই পীর-দরবেশদের মাজার দৃশ্যমান। কিন্তু কেন? পাশাপাশি আরো কয়েকটি প্রশ্ন আসতে পারে – ১.এই সব মাজার প্রতিষ্ঠার পিছনে তবে কি জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো স্বীকৃতি রয়েছে? ২.নাকি প্রতিষ্ঠানের পাশে পড়ে থাকা সরকারী জমিনের উপর মাজার প্রতিষ্ঠান এদেশের ভাববাদীদের জন্যে সহজতর উপায়? ৩.এদেশের আইন-আদালত থেকে শুরু করে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, এমনকি চলচ্চিত্রশিল্পের কারখানা পর্যন্ত কেন মাজার থেকে দূরে নয়? —————————————————————– বাংলাদেশের মাজারগুলোর অতীতের চিত্র এখন পুরোটাই বদলে গেছে। এদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিয়তী ইসলামপন্থী রাজনৈতিককর্মী ও নেতাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে মারফতী মাজার সংস্কৃতি পড়েছে বিপন্নতার মুখে।

—————————————————————– এই সকল মাজারে গত কয়েক বছরের বোমা হামলার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর নিয়ম করে বাৎসরিক ঔরস যেমন ঘটা করে পালিত হত তেমনি সপ্তাহান্তে প্রতি বৃহস্পতিবারের গান-বাজনা-জটলা সবই হত। মাজারের আশেকানদের আনন্দের সেই সব আয়োজনের ইতি ঘটেছে সিলেটের শাহ জালাল মাজারের বোমা হামলার পর থেকে। এ বছরে সারাদেশের কিছু মাজারে ঘুরে দেখেছি এখন সব মাজারই তার পূর্বের আসল চরিত্র হারিয়েছে। ঢাকার মাজারের আদ্যকথা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা শহরের প্রথম দিকের ইতিহাস রচয়িতা শেফাউল-মূলক হাকিম হাবিবুর রহমান খান আখুন্দজাদা তাঁর রচিত …….. ঢাকার মাজারের প্রথম ইতিহাসকার হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭) …….. আসুদেগানে ঢাকা বা ‘ঢাকায় যাঁরা সমাহিত’ গ্রন্থে শুধু ঢাকা শহর ও শহরতলীর ১৬৯ টি মাজারের নাম ও পরিচিতি প্রকাশ করেছিলেন। এটা তাঁর শেষ বয়সে লিখিত গ্রন্থ বলে তিনি নিজের চলাফেরার অক্ষমতা স্বীকারপূর্বক ‘পেশ কালাম’ শীর্ষক ভূমিকাংশে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর এই তালিকার বাইরে আরো অনেক মাজারের অস্তিত্ব এই শহরে আছে যা তিনি শারীরিক অক্ষমতার কারণে ফিল্ডওয়ার্কের ভিত্তিতে তথ্যানুসন্ধান করে পাঠকের জন্যে দাখিল করতে পারেননি।

তিনি জানিয়েছেন, মাজার সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করার উপায় নেই, কারণ বাংলায় এই পীর-দরবেশরাই প্রকৃত অর্থে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ছিলেন এবং পরবর্তীকালের আশেকানরা সেই ধারাবাহিকতায় তাদের পীরকে বংশপরম্পরায় শ্রদ্ধা-ভক্তি জানিয়ে থাকেন। আসলে মাজার সংস্কৃতির আদ্যকথা এটাই। জানা গেছে বিগত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের ২০৬টি মাজারকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল। কিন্তু মাজার রাষ্ট্রীয়করণের বিষয়টি নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভিতরে ভিতরে বেশ বিব্রত ছিল। সর্বশেষ চারদলীয় জোট সরকার মাজার রাষ্ট্রীয়করণের বিষয়টি প্রত্যাহার করে নেয়।

মাজারকেন্দ্রিক কয়েকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বহু দিন ধরেই গ্রামে গ্রামে ঘুরছি, গান-বাদ্য শুনছি, অভিনয় দেখছি, আর এক মায়া-ছায়ার জীবন অতিক্রম করছি। এরমধ্যে একসময় আমার মন বলল, সরেজমিনে ঢাকা শহরের গান-বাদ্যের খোঁজখবর নিয়ে দেখা দরকার। তবে, বলে রাখি এটা কোনো হঠাৎ আগ্রহ নয়। আসলে, এমন আগ্রহটা দানা বেঁধেছিল বেশ ধীরে, কিন্তু গভীর বিশ্বাসে। ঢাকা শহরে চলতে পথে রিকশায় উঠলেই তার চালকদের সঙ্গে আমার কথা হতো, জানতাম তাদেরও কেউ কেউ গ্রামের গায়েন-বায়েন।

প্রথম পরিচয় : হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে রে হাইকোর্ট মাজারে কুমের বাদ্য বাজাচ্ছেন এক ভক্ত ২০০১ সালের একদিন সঙ্গী-সাথীহীন একা, হাইকোর্ট মাজারে যাই। হাইকোর্ট মাজারের শোনা প্রথম গানটিই আমাকে চমকে দেয় – যদি এসে থাকো দয়াল তরাতে কাঙ্গাল (দয়াল) আমারে নিয়ো পার করিয়া ॥ (আমি) নামাজ তো পড়ি না রোজা তো রাখি না পার করে দাও দয়া করিয়া ॥… আমি ভবেতে আসিয়া মায়াজালে পড়িয়া গিয়াছি তোমাকে ভুলিয়া ॥ ও দয়াল আমারে নিয়ো পার করিয়া ॥ এই গানটি কোথায় যেন শুনেছি আমি, কোথায়? ভাবনার মধ্যেই উত্তর পেয়ে যাই — এ তো কালীগঞ্জের রঘুনাথপুরে শোনা গাজীর গানের সুর-কথা। গানে তবে গ্রাম-শহরের ফারাক কোথায়? আমার আকাক্সক্ষা এবার অন্যদিকে মোড় নেয় — আমি আরো ছড়িয়ে পড়তে চাই। আলাপ করি হাইকোর্ট মাজারের আসরে উপস্থিত কাচপুরের বাউল পাগল সুরুজের সঙ্গে। তিনি আমাকে ঢাকা শহরের মাজারগুলোর একটা তালিকাসহ কোন মাজারে কবে গান হয় তার তথ্য জানান।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ মাজারেই গানের আসর হয় বৃহস্পতিবার, দু-একটি মাজারে বৃহস্পতিবারের সঙ্গে রবিবারেও আসর হয়। আমার জন্যে এটা একটা মুশকিলের ব্যাপার, কারণ আমি প্রতিটি মাজারকে বহুভাবে দেখতে চাই। এজন্যে ঢাকার মাজারের গানের আসর দেখতে বহুদিন সময় ব্যয় করতে হয় এবং এক পর্যায়ে মাজারের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ তৈরি হয়, টান তৈরি হয় সুফিবাদের মোহনীর দর্শন ও জীবনচর্চার প্রতি। আমার মনে পড়ে যায় অগ্রজ কবি সৈয়দ তারিকের কথা। কবি সৈয়দ তারিক সুফি তরিকার দীক্ষা নিয়ে তাঁর কবিবন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন, এমনকি কবিতাচর্চা থেকেও, কিন্তু মানুষ হিসেবে পেয়েছেন মোহনীয় এক আকর্ষণ।

যাকে দেখলেই সাধারণের চোখে-মনে মায়া জাগে। আমিও মাজারে ঘুরতে ঘুরতে সুফিবাদের পোশাকি আকর্ষণের সঙ্গে আত্মিক আত্মীয়তায়ও মুগ্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে খুব পিচ্ছিল পথ দিয়ে হাঁটছি আমি। তবে, এ-ও ঠিক, সব মাজারই মোহনীয় নয়, ঢাকা শহরের এফডিসি গেট সংলগ্ন পন্থীশাহ মাজার আমার ধ্যান ভেঙে দেয়। পন্থীশাহের মাজারে যাই আমি সবার শেষে। সে কথা না হয় শেষেই বলব।

শাহ আলীর মাজার ঢাকা শহরে আমার দেখা সব থেকে বড় মাজার চত্বর মিরপুর ১-এর শাহ আলীর মাজার। ২০০১ সালে প্রথম যেদিন শাহ আলীর মাজারে যাই সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন কবি মজনু শাহ। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেদিনের টিপ টিপ বৃষ্টিতে কোনো গান আমাদের শোনা হয়নি। এরপর যেদিন যাই, সেদিন আমি একা। দক্ষিণ দিকের মূল প্রবেশপথে মফিজ পাগলার বিশাল আকৃতির তালপাখার বাতাসের নিচ দিয়ে শাহ আলীর মাজারে ঢুকে সেদিনই প্রথম গান শুনলাম — আল্লা নবীর নাম লইয়া আসরেতে দাঁড়াইলাম।

বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম ॥ প্রথমে বন্দনা গো টানি… মক্কাতে লইলেন জন্ম মুহাম্মদ নবী। হযরত আলী মা ফাতেমা ইমাম হুসেন যাহার নাম। বিসমিল্লা বলিয়া মুখের জবান খুলিলাম ॥ এক কিশোরী দাঁড়িয়ে তার পীর বাবার সাজানো আস্তানার সামনে এই গান গাইছে আর তার সঙ্গে দোহারকি করছে অন্য তিন কিশোরী। তাদের কারো হাতে হারমোনিয়াম, কারো হাতে মন্দিরা এবং কাঠজুড়ি। ঢোলবাদনে একজন তরুণ পুরুষ।

আসরের সামনে ভিড় করে আছে ভক্তরা। এই গান শেষে ছুটে গেলাম আমি পাশের আসরে। সেখানে এক মেয়েশিশু ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে গাইছে – খাজাবাবা খাজাবাবা মারহাবা মারহাবা গেয়েছিলো নবীর গুণগান ॥ তার পাশের আসরটি আরো জমানো মনে হলো — সেখানকার বাদ্যবাদন এবং এক সুরেলা নারীকণ্ঠ আমাকে টানতে থাকে। আমি ছুটে যাই। শুনতে থাকি জিকির তোলা সুরের গান – আমার শাহ আলী বাবার লীলাখেলা দেখবি যদি আয়।

আমার মাইজভাণ্ডারীর লীলাখেলা দেখবি যদি আয়। আয়, দমে দমে মাইজভাণ্ডারীর লীলা দেখা যায়। আয়, দমে দমে আলী বাবার লীলা দেখা যায় ॥ গান নয়, তারা যেন সুরের জিকিরই করছেন। এ জিকিরে নারী-নরে কোনো ভেদ নেই। সকলে এইখানে সুরে সুরে প্রেমভক্তিতে একাকার।

তাই তো আকুল হয়ে সকলে মিলে বাদ্যবাদনে, দোহারকিতে প্রেম-ভক্তি যোগে গাইতে থাকে — আমার মন মজাইয়া রে দেল মজাইয়া তুমি কোন দেশেতে যাও। একে আমার ভাঙা নাও তার উপরে তুফান বাও ছলকে ছলকে ওঠে পানি রে ॥… সবার আছে জায়গাজমি টাকা পয়সার নাই কমি আমার মাঝে আছো বাজান তুমি রে জীবনে মরণে ঠাঁই দিও সাঁই চরণে। তুমি বিনে আর কারো নাম জানিনে। আমার মন মজাইয়া রে দেল মজাইয়া তুমি কোন দেশেতে যাও ॥ মিরপুরে হজরত শাহ আলী কিংবা হাইকোর্টে হজরত শরফুদ্দিনের মাজারে সবখানেই এই একই গানের-সুরের-কথার গতিবেগ ও আবেগ দেখে আমি দিওয়ানা হয়ে যেতে থাকি। তেল শাহ ও নেজাম নিশতির মাজার ২০০২ সালের দিকে হজরত শাহ আলী ও হজরত শরফুদ্দিনের মাজারে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যান্ডপার্টিতে বেজে উঠত ক্ল্যারিনেট, ড্রাম, ঝাঝ।

তাদের সুরবাদ্যের সঙ্গে শুরু হত নৃত্য ও জিকির। ইসলাম ধর্ম চর্চার এই রূপ আগে আমার দেখা ছিল না। সেই প্রথম বিস্ময়ে দেখলাম। কারণ আমি নাগরিক, নগরে থাকি, মনে দেখি গ্রাম্য এক নগরের দাগ লেগে গিয়েছিল। সে সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের তেলশাহর মাজারে প্রাতিষ্ঠানিকতার ছোঁয়া দেখেছিলাম।

তখন সেখানে যা গান হত তা শুনতে গিয়ে বিব্রত হয়েছি। মেডিকেল কলেজের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ছিল তেলশাহের মাজারের হর্তাকর্তা। একই সময়ে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার বালুরঘাটের হজরত নেজামী চিশতীর মাজারে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হজরত নেজাম চিশতীর সন্তান বায়েজীদ চিশতী আমাকে আদর করে মাজারের খাসমহলে নিয়ে মিষ্টি করে কথা কয়েছিলেন। বাৎসরিক ওরস মোবারকে সেখানে আমি বিচার গানের দুটি আসর দেখেছিলাম।

তার আগে বালুরঘাট ঈদগাঁ ময়দানে বসে স্থানীয় এক ভক্ত আমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বলেছিল — ‘আপনে বায়েত নিয়ে ফেলেন…আপনার ভেতর জিনিস আছে…। ’ বহু কষ্টে তার হাত থেকে আমি আমার হাত ছাড়িয়েছিলাম। মাজারে প্রেমের দাবি ২০০২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর ঢাকার মাজারে মাজারে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম যে সেখানকার গানের কথাগুলো প্রেমের। সে প্রেমেতে দাবি ছিল, সে দাবি বড়ই কঠিন। এতসব বিবরণ বাচ্যের কথা রেখে দিয়ে আমরা বরং সে রকম একটি গানের বাণী উচ্চারণ করতে পারি – আমার কথা রেখেছি তোমায় ভালোবেসেছি তুমার সাথে ভালবাইসা হয়েছি উদাসী ॥ তুমি যে আমার হায়গো আমি যে তুমার আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যেয়ো না।

আমি যে কে তুমার সেকি জানো না। চাই না টাকা চাই না ধন চাই না জমিদারি॥ তুমার সাথে ভালরে বাইসা হইবো ভিখারি ॥’ ঢোল, হারমোনিয়াম, মন্দিরা, কাঠজুড়ির দমকে দমকে আকুল হয়ে নিবেদনমূলক এই গানে তারা অন্তরে জিকির জাগিয়ে তুলে ছিল। আর সেই জিকিরের ভালবাসাময় প্রেমের দাবিতে তারাই আবার গেয়ে উঠেছিল — তোমার রওজায় এসেছি খালি হাতে যাবো না॥ আশা পূরণ করে দাও শাহ আলী নিরাশ করো না। আমি গুনাগান ভরসা তুমার চরণছাড়া করো না॥ আশা পূরণ করে দাও খালি হাতে যাবো না ॥ আমি থমকে গিয়েছিলাম। এ আবার কেমন দাবি — ‘খালি হাতে যাবো না।

’ মনে মনে উত্তর পেয়েছিলাম — প্রেমভক্তির দাবি এমন হতে বাধ্য। প্রেমবাক্যে কিছু চাওয়া মানে অবশ্যই পাওয়ার দৃঢ়তা অন্তরে পুষে রাখা। ঢাকা শহরের মাজারের গানগুলোতে সেই প্রেমবাক্যই ঘুরে ফিরে আসতে শুনেছিলাম। ধন্দে পড়লাম পন্থীর শাহর মাজারে ২০০২ সালে আমি যখন ঘুরে ঘুরে ঢাকার মাজারে আশেকানদের ভক্তিগীতি দেখছিলাম এবং শুনছিলাম নিজ চোখে ও কানে। তখন একটি মাজারের যেয়ে আমার একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতাও হয়েছিল।

যেখানে আমি সব মাজারে অবাধ চলাচল করেছি সেখানে অভ্যাসসূত্রেই নিঃসংকোচে ঢুকে পড়ি এফডিসির সংলগ্ন পন্থীশাহর মাজার প্রাঙ্গণে। সঙ্গে সঙ্গে গেটের ওপাশের প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোক আমাকে অপ্রস্তুত করে দেয়: ‘ওই মিয়া মাজারে ঢুকছো, জুতা খোলনি যে, ওই মিয়া…। ’ আমি বলি, ‘মাজারের ঢুকলে খুলেই ঢুকবো, এখনও তো বাইরে আছি। আগে বাইরে থেকে দেখে নিচ্ছি তো…। ’ আমাকে তারা এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কই থেইকা আইছো?’ আমি আমার উদ্দেশ্য ভেঙে বললাম, ‘আমি মাজারে মাজারে ঘুরি, গান শুনি, ঢাকা শহরের মেলা মাজারেরই গিছি…এই মাজারে গান হয় না?’ লোকটা বলল, ‘হইবো, এইদিক দিয়া ওই ঘরে যাইয়া বসেন?’ আমি ঘুরে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই অন্যজন বলল, ‘দ্বারাই ঢুকতে হইলে মোমবাতি, আগরবাতি লাগব।

…মোমবাতি আগরবাতি আনেছেন?’ ‘না। ’ ‘যান মোমবাতি আগরবাতি লইয়া আহেন। ’ আমাকে সে মোমবাতি, আগরবাতি কিনে আনতে বলল। আমি গান শুনবার লোভে তা-ই করেছিলাম। কিন্তু বন্ধ ঘরে ঢুকে দেখি গাঁজায় ঘর ধোঁয়াময় — গান চলছে ফকির লালন সাঁইজীর।

বেশ কয়েকটা গান শুনলাম। কারো ভেতর তেমন ভক্তিভাব দেখলাম না। দেখলাম গাঁজাভাব। এর মাঝে আমি যখন গানের আসরের ছবি তুলতে চাইলাম তখন আমার সে অনুমতি মিলল না। তাই ভীষণ কষ্ট বুকে নিয়ে সে আসর থেকে বেশ তাড়াতাড়ি করেই বেরিয়ে এসেছিলাম।

মাজার কেন্দ্রিক সর্বশেষ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মাজারগুলোর অতীতের চিত্র এখন পুরোটাই বদলে গেছে। এদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় শরিয়তী ইসলামপন্থী রাজনৈতিককর্মী ও নেতাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে মারফতী মাজার সংস্কৃতি পড়েছে বিপন্নতার মুখে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাজারে ঘটেছে বোমাবাজির মতো ঘটনা। আর এই উছিলায় আশেকানদেরকে মাজারের বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে।

বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মাজারে প্রকৃত চিত্র — আশেকানদের সমাবেশ ও গান। তৎপরিবর্তে মাজারে এখন শরিয়তী ইসলামী নেতারা ঢুকে পড়েছেন। তারা এখন মাজার-সংস্কৃতির চর্চাকে বাদ দিয়ে মাজারকে শরিয়তী অনুসানের মধ্যে নিয়ে এনেছেন। এখন আর বাংলাদেশের প্রধান কোনো মাজারে গান ও আশেকানদের সমাবেশ দেখা যায় না। বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার সিলেট শাহ জালাল, শাহ পরানের মাজারে গিয়েছি।

একবার সেই মাজার এলাকায় শুনশান নিরবতা দেখে বিস্মিত হয়ে উঠেছিলাম। ব্যাপার কী! উত্তর পেলাম মাজার এলাকার বাইরে বসা কয়েকজন আশেকানের মুখে। তারা জানালেন, ‘মাজারে এখন আর কোনো গান-বাজনা হয় না। তবে, ভক্তরা তাদের মানত নিয়ে মাজারে আগের মতো এখনও আসে। কিন্তু সেগুলো এখন ভোগ করে মাজারের দখলদারী জামাতী নেতারা।

’ সিলেট শহরের মাজারে ঘুরে ঘুরে দুদিনেও কোনো গান শুনতে পারিনি। শেষকালে ফিরে আসার পথে শাহ পরানের মাজার প্রাঙ্গণের পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দোতরার সুর ভেসে আসতে শুনি। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সুরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। বহু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখি ফাঁকা মাঠের মধ্যে একটি গাছতলায় বসে দোতরা বাজিয়ে তরুণ এক ভক্ত গান গাইছে — ‘লা ইলা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদ রাসুল…। ’ গান শেষে তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে জানতে পারি, ‘মাজারের ত্রিসীমায় এখন আর গানের প্রবেশ নেই।

তবে, মিলাদ-নামাজ এই সব হতে পারে। আশেকান হয়ে আমাকে তাই দূরে বসে গান গাইতে হয় বাবা শাহ পরানের। ’ একই ধরনের কথা জানালেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলীর মাজারের খাদেম মোহাম্মদ মাসুদ, তিনি বললেন, ‘মাজার এখন আশেকানদের জন্য নয়। আগে যেখানে সারা রাত আশেকান-ভক্তে মাজার আলোকিত থাকত। এখন কি কোনো ভক্ত-আশেকান দেখছেন?’ আমি তার কথার ভিতর শাহ আলীর মাজার প্রাঙ্গণে তাকিয়ে দেখি, কোনো ভক্ত প্রাণীর হদিস শাহ আলীর মাজারে বৃহস্পতিবারেও নেই! অথচ এর আগে বহুবার আমি এই দিনে এই মাজারে গিয়ে দেখেছি আশেকান-ভক্তদের বিশাল সমাবেশ, গান-বাদ্য আর ভক্তির নিবেদনমুলক জিকির নৃত্য।

আর আজ সেই শাহ আলীর মাজার জনশূন্য। আমাকে খাদেম মোহাম্মদ মাসুদ আরো জানালেন, মাজার এখন জামাতের নেতাদের দখলে, তবে সভাপতি বিএনপির। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের ভার জামাতের নেতার হাতে। তারা মাজারে গান বন্ধ করে দিয়েছে। আসলে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির চেহারা একেবারে বদলে গেছে।

মাজার সংস্কৃতি রূপ নিয়েছে মসজিদ সংস্কৃতির কাছাকাছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাজার সংস্কৃতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবনার অবকাশ আছে বৈকি বিডিনিউজ২৪ডটকম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.