সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
সরদার ফজলুল করিম শান্তনু মজুমদারদের ক্লাসে তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ''প্লেটোকে বুঝতে গেলে অন্য যে-গ্রন্থ পড়তে হবে তার নাম 'জীবন', আর লেখকের নাম 'জীবন দত্ত'। '' গুরুর সাক্ষাৎকার যখন শিষ্য নিচ্ছেন তখন সেই গ্রন্থের নাম হচ্ছে 'জীবন জয়ী হবে'। সরদার ফজলুল করিম জীবনবাদী, সরল অর্থে আশাবাদী; এক রাশ হতাশার চিত্রপট তার সামনে মেলে ধরলেও, তিনি সেগুলোকে এক ঝটকায় গুছিয়ে-উল্টে রেখে ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'জীবন জয়ী হবে'।
এরকম সাক্ষাৎকার-গ্রন্থের সাক্ষাৎ আরও মিলেছে, বাংলাদেশের সাহিত্যগ্রন্থ হিসেবে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণও; কিংবদন্তীতুল্য মনীষী-অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এই সরদার ফজলুল করিমই, তিনি তখন শিষ্যের ভূমিকায়, গ্রন্থের নাম তখন 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ'। আরেক শিষ্য আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার-গ্রন্থ 'যদ্যপি আমার গুরু'।
নমস্তে আব্দুর রাজ্জাক, এখানেও গুরু আপনিই। দুর্বিনীত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তার 'সাক্ষাৎকার' গ্রন্থে যে-চারজন বাঙালি মনীষীকে ঠাঁই দিয়েছিলেন তার মধ্যেও ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। শাহাদুজ্জামানের 'কথা পরম্পরা' গ্রন্থের কথাও আমরা জানি। প্রত্যেকটি গ্রন্থই খুব উল্লেখযোগ্য, যেকোনো মনোযোগী পাঠকই গ্রন্থগুলো পাঠ করে উপকৃত-সমৃদ্ধ হবেন এবং হয়েছেন বলা যায়। এই ধরনের গ্রন্থমালায় যুক্ত হলো শান্তনু মজুমদারের নেয়া সরদার ফজলুল করিমের সাাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ 'জীবন জয়ী হবে'।
'জীবন জয়ী হবে' গ্রন্থটির সঙ্গে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ' গ্রন্থটির খানিকটা মিল আছে। মিলটা কেবল এই কারণে নয় যে দুই গ্রন্থেই সরদার ফজলুল করিম আছেন, বরং গ্রন্থ দুইটির ফরম্যাটেও সাদৃশ্য রয়েছে। দুটি গ্রন্থেই দেখা গেছে কথোপকথনের প্রসঙ্গানুসারে আলোচনাকে কয়েকটি চ্যাপ্টারে বিভক্ত করে তার একটি শিরোনাম দেয়া হয়েছে। সঙ্গে ঐদিনের তারিখ, যেদিন ঐ চ্যাপ্টারের অংশটি নিয়ে গুরু-শিষ্য আলোচনায় বসেছিলেন। আর দুই গ্রন্থেই প্রশ্ন লিখে কোলন দিয়ে এবং উত্তর লিখে কোলন দিয়ে উপস্থাপনের প্রথাগত মেকানিকাল কায়দাকে এড়িয়ে বর্ণনাধর্মী কেতাকে গ্রহণ করা হয়েছে।
কখনো কখনো কোন একটি নির্দিষ্ট দিনের আলোচনা শুরুর আগে একটি ছোট্ট ভূমিকা বা ঐদিনের প্রসঙ্গের প্রেক্ষাপট বর্ণনার মাধ্যমে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। গুরুর (সাক্ষাৎকারপ্রদানকারীর) উত্তর পাবার পরে আবার বর্ণনার ঢঙে কিছু বলে নতুন প্রশ্নে যাওয়ার মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের কাঠামোকে ভেঙ্গে মনোগ্রাহী করে তোলার প্রচেষ্টা দুই গ্রন্থেই দেখা যায়।
শান্তনু কী জিজ্ঞেস করলেন আর সরদার সেপ্রসঙ্গে কী বললেন? শিরোনামগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় 'প্লেটো আর মার্কসে দ্বন্দ্ব নেই', 'ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়', 'তোমরা কি পাকিস্তানিজমকে পরিত্যাগ করেছো!', 'বুশ অপরাজেয় নয়', 'শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই', 'আমি মৃত্যুর জিকির করি না' ইত্যাদি চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরদার বলেছেন। আরও বলেছেন শৈশবের কথা, ঢাকায় আসা, কমিউনিস্ট হওয়া, জেল খাটা, যুদ্ধের সময়েও বাংলা একাডেমীর চাকরি চালিয়ে যাওয়াসহ নানা প্রসঙ্গ।
শান্তনু একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রসঙ্গে স্যারকে ধরেন: আপনি আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট, আবার আপনি প্লেটো নিয়ে মাতামাতি করছেন।
শান্তনুর প্রশ্ন: "প্লেটো যেখানে সামাজিক বিভক্তি টিকিয়ে রাখতে চান, মার্কস সেখানে বিভক্তি দেয়াল তুলে ফেলে শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শকে আপনি কীভাবে নিজের মধ্যে লালন করেন?" স্যার বলেন: "প্লেটোর এত সরল পাঠ করেছো দেখে অবাক হচ্ছি। বর্বরকে আমি কেমন করে প্লেটো বোঝাবো?" আক্রমণের মাধ্যমে সরদার প্রসঙ্গ এড়াতে চান। কিন্তু শান্তনু ছাড়েন না: "বর্বরকে আপনিই জ্ঞানদান করুন"। চাপাচাপিতে সরদার ঝেড়ে কাশেন: "আমি মনে করি যে প্লেটো আর মার্কসের মধ্যে কোনো কন্ট্রাডিকশন নেই।
একটা সাধারণ কন্ট্রাডিকশন আছে। তা হলো প্লেটো আইডিয়ালিস্ট আর মার্কস হচ্ছেন রিয়ালিস্ট। ... মার্কস প্লেটোকে পৃথিবীর সবচেয়ে আইডিয়ালিস্ট ফিলোসফার মনে করেন। ... দু'জনের মধ্যে সময়গত ব্যবধানটা খেয়াল রেখো। ... প্লেটো যখন বলেন যে যার যা করা উচিত তা করাই হচ্ছে জাস্টিস -- এগুলোতো মহা অমূল্য কথা।
এগুলো আর কোথায় পাবা! মার্কসীয় দর্শনে আকৃষ্ট একজন লোক হয়েও এগুলোকে ধারণ করায় আমার কোনো অসুবিধা হয় না। ... একটা বিষয়কে অন্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা মার্কসিজম আমাকে শেখায় নাই। ফাইটটা হচ্ছে আইডিয়ালিজম এবং মেটেরিয়ালিজমের মধ্যে। ... অ্যারিস্টটল এ দু'য়ের মধ্যে একটা মিক্স-আপ করার চেষ্টা করেছেন। " (পৃ ৪৫-৪৬) শান্তনু এই উত্তরে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হন না, হওয়া একটু কঠিনও বটে।
যাক, সরদার দুই মনীষীকে একইসঙ্গে ধারণ করতে পেরেছেন, মতাদর্শিক সমস্যা থাকলেও, দু'জনেই গ্রেট। দু'জনকেই লালন করে সরদারও গ্রেট হয়েছেন, বুদ্ধির আকালে সরদার তো আমাদের কাছে গ্রেটই। কমিউনিজমের দুষ্কালে কমিউনিজম সম্পর্কে সরদার যা বলছেন তাও গ্রেট উক্তি: "কতকগুলো পার্টি গড়ে উঠলো বা ভেঙ্গে পড়লো তার সাথে কমিউনিস্ট থাকা না-থাকার ব্যাপারটা জড়িত থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। একজন কমিউনিস্ট তার বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতেই কমিউনিস্ট। অর্গানাইজেশন নিশ্চয় সাহায্য করে।
যাদের মধ্যে খানিক আগ্রহ আছে, পার্টি তাদেরকে আরো বেশি আগ্রহী করে তুলতে পারে। ... ডাকাত জীবন নেয় আর ডাক্তার জীবন রা করে। ডাক্তার ব্যর্থ হতে পারে তাই বলে তাকে ফাঁসি দেয়া হয় না। " (পৃ ৪৭-৪৮)
সরদারের আশাবাদিতা দেখলে অবাক হতে হয়। যখন বুশের বাহিনী ইরাকে সাধারণ মানুষ হত্যা করছে আর সন্ত্রাসীদের হাতে মরছে বাংলাদেশের নাগরিক তখনও সরদার বলেন: "কোথায় মৃত্যু দেখলে? আমি তো জীবন ছাড়া আর কিছু দেখি না।
গোর্কির কথাই আমাদের জীবন দর্শন হোক -- 'মানুষ ছাড়া আর কোনো দেবতা নাই'। ... আমরা তো রোজই মরছি। কিন্তু বুশ একথাটা বুঝতে চাচ্ছে না যে আমাদেরকে মেরে শেষ করতে পারবে না। ব্যক্তি মানুষকে মারতে পারে, কিন্তু প্রজাতি মানুষকে কি মেরে শেষ করতে পারবে?'' শান্তনুকে বরং তিনি উল্টো বকে দেন: "কোনো দায়িত্ব নেবো না, কেবল আমি ভোগই করবো, সারাক্ষণ খালি অন্যকে দোষী করবো এবং চারিদিকে আশা ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও হতাশায় ভেসে যাবে -- এটা হয় না। ... বুশকে ধন্যবাদ এজন্য যে সে সারা পৃথিবীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে, একটা তার ভাগ একটা আমার ভাগ।
আমি নিশ্চিত যে তার ভাগের তুলনায় আমার ভাগ অনেক বেশি শক্তিশালী। এই মূর্খ তা বুঝতে পারছে বলেই ভয় পাচ্ছে। " (পৃ ৫০-৫১)
সরদার ফজলুল করিম কেবল বয়সের সুবিধায় এই ভূখণ্ডের বিরাট কালখণ্ডের নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন। তাই তার কাছে তস্য তরুণ শান্তনুর অবধারিত প্রশ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আরও স্পষ্টভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে নিয়ে যে স্বপ্নভঙ্গ জাতির হয়েছে, সেই দিকটায় তিনি আলোকপাত করে তৈরী উত্তর সরদারের কাছ থেকে জানতে চান। সরদার বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার তেমন সাংঘাতিক কোন প্রত্যাশা ছিল না।
তার মতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করলেও পাকিস্তানিজমকে পরিত্যাগ করা যায় নি। সরদার বলেন: "শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়া হবে কি হবে না, শুধু এটুকুর মধ্যেই পাকিস্তানিজম ব্যাপারটা সীমিত নয়। এটা সুদীর্ঘকালের পরিকল্পনা প্রসূত। ব্লু-প্রিন্ট। ভারতীয় উপমহাদেশে যাতে করে একটা মানবিক সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে উঠতে না পারে, যাতে মানুষ কখনো মানুষ হতে না পারে, যাতে মানুষ মানুষকে মারে -- এসব ল্য থেকেই পাকিস্তানিজম তৈরী হয়েছে।
এটা একদিনে হয়নি। ... তাহলে কীভাবে আশা করবো যে স্বাধীনতার তিন-চার বছরের মধ্যেই সব একেবারে পাল্টে যাবে! এ হয় না। ... পাকিস্তানিজম ঠিকমতো বুঝতে না পারার কারণে শেখ মুজিব এমনকি নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থাটাও সেভাবে করেন নি। " (পৃ ৭০-৭১)
প্রচণ্ড আশাবাদী হলেও সরদার মাঝে মাঝে ভয় পান। তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে সরদার বলছেন: "তোমাদের ইয়াং জেনারেশনের ভাষা আমি বুঝতে পারি না।
তোমাদের ভাষাতো আমাদের ভাষা না। ... আজকে অবস্থা এমন অবস্থানে এসে পৌঁছেছে যে নিজের মনের কথা নিজের কাছে বলতে ভয় পাই। কেবলই মনে হয় দেয়ালেরও কান আছে। আমি ভয়ার্ত। না হয়েও উপায় নেই।
কেননা আমি দেখছি যে আমার তরুণ প্রজন্ম ভয়ে গুটিয়ে আছে। তাহলে আমি ভীত না হয়ে কী করবো। বর্তমান প্রজন্ম আর কিছু না করে শুধুই পূর্ববর্তী প্রজন্মকে দোষারোপ করেই পার পেতে চাচ্ছে। " (পৃ ৮৫) তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে সরদারের মূল্যায়ন যথার্থই। তরুণরা বিশ্বায়নের যুগে বাস করছে, তাদের অনেক অনেক চাহিদা।
চাহিদাগুলো পূরণের জন্য তারা ক্রমশ স্বার্থানুগ হয়ে পড়ছে, সমাজ-রাজনীতি নিয়ে ভাবনা তাদের মনে তাই ঠাঁই পায় না। সরদারের মতে তাদের স্যাক্রিফাইস করার প্রবণতা নেই। তারপরও তিনি বলছেন: "তবে এটাই আমার শেষ কথা নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি যে এত হতাশার মধ্যেও একটা তরুণ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা আশার ভিত্তিতে বাঁচতে চায়। সেজন্যই যতই চিৎকার করি না কেন, শেষ বিচারে আমি হতাশাবাদী নই।
আশাবাদী। " (পৃ ৮৫)
গ্রন্থটির ছাপা ভালো, প্রচ্ছদটি সাদামাটা। তবে বানান ভুলের প্রাচুর্যে পঠন বাধাগ্রস্ত হয়। ণ-ত্ব বা ষ-ত্ব বিধানের কোনো বালাই নেই। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের এত এত বানান বিভ্রাটের দায় প্রকাশক, লেখকের ঘাড়ে বর্তায়।
অসচেতন পাঠক হয়তো সরদার ফজলুল করিমকেও দায়ী করবেন: "স্যার, এমন দামি দামি কথা আপনি এত ভুল বানানে অবলীলায় বলে গেলেন!"
জীবন জয়ী হবে: সরদার ফজলুল করিমের সাথে কথোপকথন। শান্তনু মজুমদার। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: সময় প্রকাশন। ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০০৪।
মূল্য ৭৫ টাকা।
প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো।
প্রকাশকাল: অনুসন্ধানসাপেক্ষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।