আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার জীবনের চন্দ্রবিন্দুবিহীন বছরগুলো : দি যায়যায়দিন ইয়ারস

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

লাভ রোড নামটা তখনো পাকাপোক্ত হয় নাই। লাভরোড হয়ে সমকালে কাজ করেতে যাইতাম। যাইতে যাইতে যায়যায়দিনের সুরম্য অট্টালিকার দিকে তাকায়া থাকতাম। বেশি তাকাইতাম না।

কারণ পরিচিত অনেক লোক ওইখানে কাজ করতো। মনে হইতো, বেশি দেখলে ওরা মনে করবে চাকরি চাইতেছে। চাকরি অবশ্য চাইতেছিলাম আজকের কাগজে কাজ করার সময় থেকে। একদিন কামুদা সহ ইস্কাপনের টেক্কায় গেলাম। সেইখানে সঞ্জীবদার লগে পরিচয় হইলো।

অমিতদার সঙ্গেও পরিচয় হইলো। আজকের কাগজে কাজ করি বইলা ওনারা তেমন একটা পাত্তা দিল না। তবু বইসা বইসা দেখলাম ওনারা কম্পিউটারে টেবিল টেনিস খেলা নিয়া খুব ব্যস্ত। ফাঁকে সঞ্জীবদার একটা ফোন আইলো। উনি আধা ঘণ্টা ধইরা কারে জানি ইংরেজি শিক্ষার ফজিলত বুঝাইতেছিলেন।

কী ধৈর্য! প্রথম আলো থেকে দলে দলে লোকজন গিয়া জয়েন করতেছে। কিন্তু বাইরের কেউ চাকরি চাইলেই ওনারা বলেন, পরীক্ষা দেওয়া লাগবে। ভাষা লেখা শিখতে হবে। শফিক রেহমানের ভাষার মতো ভাষা হইতে হবে। সঞ্জীবদা কয়, টিনেজারদের জন্য একটা ম্যাগাজিন করবো।

তুমি একটা প্লান নিয়া আইসো। একদিন হেভি খাইটা প্লান নিয়া গেলাম। উনি কইলেন, এইবার একটা অনুবাদ কইরা নিয়া আসো। আমি কম আগ্রহ দেখাইলাম। বল্লাম, পরীক্ষা দিতে পারবো না।

তো একটু মনভার মনভার কইরা ফিরতে ফিরতে ওইদিন কামুদারে জিগাইলাম, কামুদা কী করা যায়? এই পত্রিকা কি বাইর হবে? লোকে তো কয় জমি দখল করার জন্য পত্রিকা বাইর করতেছে। কামুদা কয়, সাইটে গেছিলা কোনোদিন? লাভরোডে তখন অট্টালিকা তৈরি হইতেছে। অট্টালিকার জায়গাটারে ওনারা সাইট বলে। কামুদা কয়, ভাবেসাবে তো মনে হয় মেলা দেরি আছে। আমি জিগাই, তাইলে কি মনে করেন আমার এখন সমকালে যোগাযোগ করা উচিত? কামুদার পরামর্শ নিয়া আমি আমার গুরুস্থানীয় বন্ধু সাইমন জাকারিয়ার লগে যোগাযোগ করলাম।

উনি আমারে ইউটিসি বিল্ডিংয়ে নিয়া গিয়া মিজান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করাইলেন। মিজান ভাই সমকালের জন্য বিশাল এডিটোরিয়াল টীম গড়তেছেন। আমারে নিয়া নিলেন। কিছুদিন যাইতেই আমার প্রতিভা প্রকাশ হইলো। গুরুত্ব বাড়লো।

ভালই চলতেছিল। কিন্তু ইউটিসির মালিক নানা ফন্দিফিকির কইরা সমকালরে বিল্ডিং থিকা বাইর কইরা দিল। কাওরান বাজার থেকে আমরা তেজগা চইলা গেলাম। ফিচার আর এডিটোরিয়াল বারোতলা গার্মেন্টসে আর নিউজ কুনিপাড়ায়। ওই প্রথম তেজগাঁ গেলাম।

সে এক হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা। পরে আমরাও কুনি পাড়ার অফিসে চইলা আসলাম। অফিস যাইতাম ফার্মগেট থেকে রিকশায়। লাভ রোড হয়ে। সমকালে আমার চাকরির বছর খানেক পর যায়যায়দিনে লোকেরা ইস্কাটনের ঠেক থেকে লাভ রোডে আইলেন।

এইটাতে আমার নতুন মুসিবত তৈরি হইলো। আমি ওইদিক দিয়া গেলেই খালি বছরখানেক আগের চাকরি চাওয়ার স্মৃতি মনে হয়। মাঝে মাঝে কামুদারে দেখি। রাইসু ভাইরে দেখি। ওনারা মাসুদের দোকানে চা খাইতে ডাকেন।

আমি লাজুক লাজুক ভাবে চা খাই। রাইসু ভাই কয়, লজ্জা পান কেন। যারা চাকরি করতেছে, তারাও তো একদিন চাকরির জন্য আসছিল। এর মানে এই না যে আমি চাকরি চাইতেছিলাম বইলা রাইসু ভাই এই কথা বলে। কথার মর্তবা হইলো, ওনার একজন সহকারি দরকার, তাই জন্য উনি আমারে আরেঠারে পরখ করেন।

এইভাবে কথা স্পষ্ট হইতে থাকে। আমি বলি, আমি এডিটোরিয়ালেই যাইতে চাই। তো রাইসু ভাই একটা ফাঁকা দিন দেখে শফিক রেহমানের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। শফিক রেহমানকে দেখে আলগা হাসি ঝুলায়া বইসা থাকলাম। সমকালে ছাপা হওয়া অনুবাদ, এডিটোরিয়াল, কলাম দেইখা উনি কিছু প্রসন্ন হইলেন।

জিগাইলেন, মুভি দেখো? হ্যাঁ দেখি। শেষ কী মুভি দেখেছো। আকিরা কুরোশাওয়ার একটা সিনেমা দেখছিলাম। কইলাম। উনি বোদ্ধার মতো একটা হাসি দিয়া কইলেন, আমি আগেই বুঝেছিলাম।

আজিজ মার্কেটের লোকেরা তোমরা এইসবই দেখবা। আমি কইলাম, কেন হলিউডের মুভিও তো দেখি। বলে সে সময় দেখা একটা সিনেমার নাম কইলাম। যাই হউক, বিষয়টা চাপা পড়ে গেল। আমি কিছু লেখা আর সিভি দিয়া আইলাম কিন্তু কোনো রেসপন্স নাই।

হঠাৎ একদিন রাইসু ভাই যাইতে কইলেন। যায়যায়দিন তখন বের হয় বের হয় করতেছে। শেষ মুহূর্তে, রাইসু ভাইরে লোক দিবে। উনি এসিস্ট্যান্ট এডিটর, আমারে সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে নেওয়ার কথা। সাহিত্য ম্যাগাজিনে।

গিয়া একটা বিশাল ফিরিস্তির ফর্ম পূরণ কইরা আইলাম। দুই একদিনের মধ্যেই ব্যাপার ফায়সাল হইলো। ২০০৬ সালের পয়লা এপ্রিল জয়েন করলাম। হেভি অফিস। ফিটফাট।

স্মার্ট স্মার্ট লোক ঘোরাফিরা করে। হেভিওয়েট লোকদের ভিড়ে কথা বলারই জো নাই। আমি গিয়া রাইসু ভাইয়ের সিটে বইসা থাকি। উনি আইলে কথা হয়, আর কথা হয় কামুদা আইলে। বাকী সময় চুপচাপ থাকি।

আমার লগে কেউ কথা কয় না। রাইসু ভাইয়ের সিটে বইসা বইসা লক্ষ্য করতে থাকি আশপাশের ব্যাপার। সিটটা বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি জায়গায়। হঠাৎ একদিন দেভি বিল্ডিং কাঁপতেছে। ভয়ে তাকায়া দেখি কোনো ব্যাপার নাই।

পরে বুঝলাম লোকে হাঁটলেও বিল্ডিং কাঁপে। তবে সবাই হাঁটলে বিল্ডিং কাঁপতো না। দুইজন বিল্ডিং কাঁপায়া হাঁটতে পারতো। একজন ছোটন ভাই। আর শফিক ভাই।

একদিন শফিক ভাই রাইসু ভাইয়ের সিটের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। আমারে একা দেইখা বললেন, 'তুমি জয়েন করেছো। ' আমি বললাম, হ্যাঁ। উনি আমাকে নিয়ে ছোটন ভাইয়ের ঘরে নিয়া গেলেন। বললেন, আমরা গতানুগতিক সাহিত্য করবো না।

বিভিন্ন পত্রিকার নাম করে বললেন, এসব চলবে না। মনে রেখো, আমরা ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড কিছু করার চেষ্টা করছি। তুমি সব সময় বাইরের পত্রিকা ফলো করবে। আর শোনো, আমাদের পত্রিকায় আর এন ঠাকুর আর কে এন ইসলাম চলবে না। মার্কেজ চলবে না।

তোমরা এগুলো পঁচিয়ে ফেলেছো। নতুন কিছু আনো। নতুন মুখ আনো। না পেলে শুধু বিদেশী সাহিত্য ছাপো। পাঠককে শিক্ষিত করে তোলো।

বাংলাদেশে কেউ কিছু লিখতে পারে না, বুঝলে। আমার সঙ্গে কাজ করলে বুঝতে পারবে লেখা কী ব্যাপার। আমার মগজ বনবন করে উঠলো। বিদেশী সাহিত্য দিয়া ম্যাগাজিন? কিন্তু কাজ বলে কথা। ধীরে ধীরে বিদেশী পত্রিকা ঘাটাঘাটি শুরু কইরা দিলাম।

ম্যাটার কিছু অনুবাদ করা শুরু করলাম। রাইসু ভাই আর আমি সারাক্ষণ নানা প্লান করতাম। বিভিন্ন সংখ্যার লেখার কথা ভাবতাম। কাজ কিছু আগাইলো। শফিক ভাইয়ের মতো করেই।

আমার চিন্তায় বিদেশী সাহিত্য কিছু কিছু করে ঢুকতে থাকে। প্রথম একটা লেখা অনুবাদ করতে গিয়া আমি বুঝতে পারি আমার জীবনে বিশাল সর্বনাশ হয়ে গেছে। ছাত্রজীবনে গালিব একটা পত্রিকা করেছিল, যেইখানে মাতব্বরি কইরা নতুন বানানরীতি চালু করছিল সে। ণ ও ষকে নির্বাসন দিয়েছিল সেখানে। প্রতিবাদ হিসাবে আমি গালিবের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ১৮টি ভাষণ দিছলাম।

গালিবের সঙ্গে নয় দফা ঝগড়া করছিলাম। আর ওই পত্রিকায় কখনো লেখি নাই। এখন দেখি এমন এক চাকরি নিছি যেইখানে বাংলা বানানের সর্বনাশ হয়ে গেছে। ঋ-কারের আধিক্য। ইংরেজি শব্দে অনর্থক ব্যবহার চলছে।

বাংলা কোনো ভাল প্রতিশব্দ লিখে পাঠালেও প্রুফে দেখা যাইতো শব্দ ইংরেজি কইরা দিছে। সবচেয়ে বড় কথা চন্দ্রবিন্দুই নাই। চন্দ্রবিন্দু আমার প্রিয় বর্ণ। শব্দের মাথায় চাঁদের মতো। সবই ধীরে ধীরে মাইনা নিতে পারলে এখন পর্যন্ত চন্দ্রবিন্দুর ব্যাপারটা আমি মানতে পারি নাই।

ফলে, আমার যায়যায়দিনে কাজ করার দুইবছরকে আমি চন্দ্রবিন্দুর উদ্দেশে উৎসর্গ করছি। আমি চান্স পেলেই বিভিন্ন শব্দে প্রয়োজনীয় চন্দ্রবিন্দু দিতাম। আমার দুই বছরের কর্মজীবনে আমি কেএন ইসলাম বা আর এন ঠাকুরের নাম নেই নাই। মার্কেজকে নিয়া কোনো আয়োজন করি নাই। কিন্তু দুইতিনবার জবরদস্তি করে হেডলাইনে পর্যন্ত চন্দ্রবিন্দু দিছিলাম।

ছাপা হওয়ার পর চন্দ্রবিন্দুর দিকে তাকায়া হাসছিলাম। শফিক ভাইয়ের কথা মতো আমরা বিদেশী সাহিত্য ছাপতে থাকি। কিন্তু কোনোদিনই ওনারে খুশী করতে পারি না। কী ব্যাপার! দেশে বিদেশী সাহিত্যের জোয়ার তৈরি হইলো, কিন্তু উনি অতৃপ্ত। কারণ কী? গবেষণা কইরা আমরা বাইর করলাম, সহকর্মীদের অনেকেই রাইসু ভাইয়ের শত্রু, বাই ডিফল্ট আমারও শত্রু।

হেরা শফিক ভাইয়ের কান ভারী করে। আর সেইটা শুইনা তিনি আমাদের ওপর অখুশী থাকেন। আমি হিসাব কইরা দেখলাম চারটা ক শফিক ভাইয়ের পতনের জন্য দায়ী : ১. কমপ্লেক্স (সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স ও যায়যায়দিন মিডিয়া কমপ্লেক্স) ২. কিচেন কেবিনেট ৩. কানকথা ৪. ক্যামোফ্লেজ কানকথায় তিনি খুব বিশ্বাস করতেন। এতটাই যে, আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যেতাম একই ব্যক্তি কীভাবে আশি-নব্বই দশকে কীভাবে এত সফল একটা সাপ্তাহিক করতে পেরেছিলেন। শফিক ভাই সাপ্তাহিক ছাইড়া দৈনিক করলেও সাপ্তাহিক থেকে নিজের মনকে দৈনিকে আনতে পারেন নাই।

তিনি দৈনিক পরিচালনা করতেন সাপ্তাহিকের লোকদের কুপরামর্শে। এনারা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে দৈনিকের লোকদের দেখতে পারতো না। ফলে, একটা কিচেন কেবিনেটের আকার ধারণ করে প্রতিদিন শফিক ভাইয়ের কানভারী করতো। এই করে করে শেষ পর্যন্ত শফিক ভাই দৈনিকের ১০৪জনকে বরখাস্ত করে সাপ্তাহিকের সেই কিচেন কেবিনেটকেই শাক্তিশালী করে তোলেন। এই যে তিনি কানকথায় বিশ্বাস করতেন, কিচেন কেবিনেট রাখতেন তার মূল কারণ তিনি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন।

মানসিকভাবে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমি দেখছি, তিনি যে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙেন। প্রচুর হাঁটেন, অফিসে ছোটাছুটি করেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, প্রচুর লেখেন সেইটা আসলে তার ক্যামোফ্লেজ। তিনি মূলত বৃদ্ধই ছিলেন। কিন্তু বহু মানুষ তার ক্যামোফ্লেজ দেখে তাকে কর্মক্ষম মনে করতো।

আমি তার এই কর্মক্ষমতার প্রশংসা করতোম। তিনি দরকার পড়লে কখনো ডেকে পাঠাতেন না। নিজেই আসতেন। এটা আমার খুব ভাল লাগতো। বানান বিপর্যয় ছাড়া তার বাদবাকী ভাষা সংস্কার আমি সমর্থন করতাম।

বিদেশী সাহিত্য ছাপানো বিষয়ে আমি সহমত পোষণ করেছি, কিন্তু দেশীয় জিনিশ বাদ দেয়া সমর্থন করি নাই। তার ভাষা সহজ ও সুপাঠ্য। অল্পশিক্ষিত মানুষও তার কথা বোঝে। তিনি খুব সহজে মানুষকে কনভিন্স করতে পারতেন। জনপ্রিয় ব্যাপারগুলার প্রতি তার খুব আগ্রহ, সবসময় চাইতেন এভারেজ চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করতে।

তার নিজের চিন্তা এক্সট্রা অর্ডিনারি হলেও, নিজে প্রচুর ভাল বই পড়লেও, ভাল সিনেমা দেখলেও পাবলিক যেইটা পছন্দ করে তিনি সেইটার কথা লিখতেন ও বলতেন। আজ ইতি। । ইচ্ছা হইলে আবার লিখবোনে। ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.