আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি

১। ইদানীং মাথার কুলিং ফ্যানটা নষ্ট, অল্পেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। কোয়ান্টামের রাজ্যের আগের কিস্তিতে প্রোফেসর সা’ব জিগাইছিলেন উপ শিরোনাম কেন দেই। এই নিয়া ভাবতে ভাবতে “টাইটেল রাইটার্স ব্লকে” পড়ে গেছিলাম। প্রথমে এই শিরোনামটাই পরের পর্বের জন্য ঠিক করেছিলাম- কিন্তু বিষয়ের সাথে মিলিয়ে নিজেরই কেমন যেন পছন্দ হচ্ছিল না।

গত কয়েক দিন এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে খালি গেটের হাতিমার্কা তালাটাকে লকারের চাবি দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলাম, আর লকারের বাচ্চা তালাটাকে গেটের চাবি দিয়ে নির্যাতন করে ফেলছিলাম। ভাগ্যিস আমার বৌ-টৌ নাই, থাকলে নির্ঘাত নিশিরাইতে রোমান্টিক মুহূর্তে সে চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করতঃ “পড়াশুনা জানি কই? মাদ্রাসা না মিলিটারি ইস্কুল? সারাজীবন বয়েজ ইন্সটিটিউশনে পড়ে আসলে তো এই কাজই করবা!” ধুত, আবার যথারীতি বেলাইনে চলে যাচ্ছি। যাকগে, আজকে অর্ণবের একটা গান শুনতে গিয়ে ধুম করে নাম পেয়ে গেছি, কিন্তু নামের পরে যা লিখব ভেবে গুছিয়ে রেখেছিলাম সব হাওয়া। কারন কিছুই না, খবর দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে আবার।
২।

আচ্ছা, যে লোক ব্লগ খায় না মাথায় দেয় সেইটাও জানেনা অথচ ব্লগের গুষ্টি উদ্ধার করার জিহাদে রত তারে কি করা যায়? কিংবা ফেলানীর জন্য কেদে জারজার হয়ে যাওয়া যে লোকটাকে কোনমতে স্টারপ্লাস দেখা বন্ধ করানো যায়না, তাকে? আমি পদার্থবিজ্ঞানের মানুষ, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে বোধহয় আমার মাথা ঘামান উচিত না। কিন্তু সমাজ যখন “আমিতো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে” টাইপের কমান্ডো স্টাইলে ঘাড়ে এসে পড়ে তখন উপায়? আশেপাশে সবাই চোখ বন্ধ করেও চাঁদে সাইদীকে দেখে ফেলে, আমার খোলা চোখেও জোছনা ছাড়া কিছুই ধরা পড়েনা। জোকারের (তাস কিংবা ব্যাটম্যানের সাথে ইহার কোনও সম্পর্ক নাই) জ্ঞানগর্ভ জোক শুনে সবাই আহ্লাদে মাথা নাড়ে, আমার কেন জানি হাসি পায় (জোক শুনে হাসব না? ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে) আর মনুর কথা মনে পড়ে। মনুকে চেনেন না বুঝি, মনু থাকত আমাদের পাশের বাসায়। তেল চকচকে দুখানা শিং আর একগাছা দাড়ি নেড়ে নেড়ে যখন এগিয়ে আসত, ভয়ই পেতাম।

বাছুরের সমান রামছাগল দেখলে ভয় পাব নাইবা কেন? তখন ভয় পেলে তবু বড়দের কোলে চড়ার একটা অপশন থাকত, এখন তাও নেই। জানি হতাশা একটা বিলাসিতা মাত্র, তবু মাঝে মাঝে বড্ড হতাশ লাগে।
৩। মেজাজ খারাপ থাকলে খাবলা খাবলা বই পড়ি। কখনও মেজাজ ভাল হয়, কখনও উল্টোটা।

আজকে দ্বিতীয়টাই হল। কেন? কিছু শেয়ার করি বরং। অল্প যে কয়জন মানুষকে জাতিগত ভাবে পাকিস্তানী হওয়া সত্বেও শ্রদ্ধা করি তার মাঝে পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালাম একজন। তাঁর “আইডিয়াজ এন্ড রিয়ালিটিজ” পড়ছিলাম, একজায়গায় চোখ আটকে গেল। তিনি ইবনে খালদুনকে কোট করেছেনঃ “এটা স্পষ্ট যে আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে পদার্থবিজ্ঞানের কোনও গুরুত্ব নেই, অতএব সেগুলোকে আমরা বাদ দিতে পারি।

” এর প্রেক্ষিতে সালাম দুঃখভরে মন্তব্য করেছেনঃ “ইবনে খালদুন কোনও কৌতূহল প্রকাশ করেননি, কোনও আগ্রহ দেখাননি। শুধু ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন যা প্রায় বৈরীতার কাছাকাছি”। ইসলামের ইতিহাসের বইগুলো ঘেটেঘুটে দেখলাম, প্রাচীন গৃসে এরিস্টটল যেমন এখানে ইবনে খালদুন প্রায় তেমন গুরুত্ববাহী। আচ্ছা, এই জাতটার হজের ব্যাবসা আর তেলের পয়সার টাকা যেদিন ফুরিয়ে যাবে তখন ফুটানি আসবে কোথা থেকে? জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
৪।

এরপর আহমেদ ছফার “বাঙ্গালী মুসলমানের মন” পড়ে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। ছফা লিখেছেনঃ “বাঙালি মুসলমানের মন এখনও একেবারে অপরিণত। সবচেয়ে মজার কথা যে এই কথাটা ভুলে থাকার জন্য সে প্রানান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করেনা। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃৎ-কৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং তার একাংশ তার সুবিধাগুলো ভোগও করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়াচ্ছে ইঁচড়ে পাকা শিশুর মত। অনেককিছুরই সে সংবাদ জানে, কিন্তু চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, মনীষা দিয়ে আপনার করতে জানেনা।

” ছফার এই প্রবন্ধটি প্রকাশ পায় ১৯৭৬ এ। তারপর সাইত্রিশ বছর কেটে গেল, এরা আর বড় হলনা। কেবল বিকলাঙ্গের মত বংশবৃদ্ধিই করে গেল, আফসোস।
৫। অধ্যাপক কাজী নুরুল ইসলামের “সমকালীন জাপানীদের ধর্মবিশ্বাস” শীর্ষক একটা প্রবন্ধ পড়ে জাপানীদের হিংসেই হল।

সেখানে বলাঃ “জাপানের সংবিধানের ৮৯ ধারা মোতাবেক সরকারী কোষাগার হতে কোনও টাকা বা সম্পদ ধর্মীয় খাতে ব্যায় করা সম্পুর্ন বেআইনি। এমনকি ধর্মীয় সংস্থা দ্বারা পরিচালিত দাতব্য চিকিৎসালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কোনও সরকারী ব্যয় করা যাবেনা। ” আর আমাদের বোধহয় উল্টোটা না করলে ভাত হজম হয় না। প্রবন্ধটিতে আরও বলাঃ “জাপানের সংবিধানের ২০ ধারার তৃতীয় অধ্যায়ে বর্নিত আছে যে- কোনও মানুষকে বিশেষ কোনও ধর্মীয় কাজে বা আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বাধ্য করা যাবে না। এখানে একটি ঘটনা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।

এক খুনী আসামীকে জেল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত ধর্মীয় বানী শোনানোয় উক্ত আসামী অধিকার ক্ষুন্ন হবার অভিযোগে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে। ১৯৮৮ সালে অসাকার মাননীয় জজ এই মর্মে রায় দেন যে ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। ” আমাদের দেশে যারা যুদ্ধবিদ্ধস্ত জাপানের শনৈ শনৈ উন্নতির বিপরীতে আমাদের দেশের কিচ্ছু হবেনা সিন্ড্রোমে বড্ড ব্যাথিত- তারা কি এই ক্ষেত্রেও জাপানের পথে যেতে রাজী আছেন? কারো কারো মুখের ওপর প্রশ্নটা করতে বড় সাধ জাগে।
৬। গনমানস বড্ড ভয়ানক জিনিস।

১৯৭০ তে যেই ঐক্যবদ্ধ গণমানস বাঙ্গালীকে এগিয়ে দিয়েছিল, ২০১৩ তে সে একইরকম আছে ভাবার কোনই কারন নেই। জামায়াত-শিবিরের লাখো গোয়েবলসের মিঠেমুখের কাছে আমাদের তেতোমুখের সত্যিকথা গুলো যে নস্যি। যতদূর মনে পড়ে আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিযামী প্রথম গ্রেপ্তার হয় তারই পেয়ারা- “ব্লাস্ফেমী আইনে”। আচ্ছা, কোরানের প্রথম কথা না ছিল ইকরা- পড়। তাহলে এদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধিতার দায়ে বিচারের দাবি- মানে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় কি? মনে হয় যায়না।

নাহলে শয়ে শয়ে কোরআন পুড়িয়েও হেফাজতীরা দিব্যি ইসলাম কে হেফাজত করে চলেছে। আর জেলে যাচ্ছে, মামলা খাচ্ছে ব্লগাররা। যেহেতু পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে লিখি, কদিন পরে তারা নিশ্চয় ইবনে খালদুনকে সাক্ষী মেনে আমার “ইসলাম বিরোধী” কাজের অভিযোগে আমার কোমরে দড়ি বাঁধতে আসবে। আর আমি বোধহয় বিড়বিড়িয়ে কবিতা পড়বঃ “Then they came for me--and there was no one left to speak for me.”
৭। আমাদের এক বিশ্বপ্রেমিক বন্ধু ছিল।

তার কাছে জীবনটা ছিল ছেলেখেলা মাত্র, অর্থাৎ কিনা- লাইফ ওয়াজ জাস্ট এ প্লেবয়! নতুন বান্ধবীদের জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় কোটেশন ছিল নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা- “চাবি দিয়ে তালা খোলা শিখিয়েছি, তালা দিয়ে খোলো দেখি চাবি। ”
চাবি দিয়ে তালা খুলেছিলাম সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই, এখন কি তালা দিয়ে চাবি খুলতে হবে?

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.