আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবন একটা গম্ভীর বিদ্রুপ!



এটি কোনো সাহিত্য-আলোচনা নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্বন্ধে কিছু কথা বলেছি প্রসঙ্গক্রমে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর লেখালেখির প্রথম জীবনে 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলেন। একটি অসাধারণ পংক্তি দিয়ে গল্পটি শুরু হয়- 'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। ' এটি কি কোনো গল্পের লাইন, নাকি কবিতার? 'মনোরম' আর 'মনোটোনাস' এই দুই আপাত বিরোধপূর্ণ শব্দের সহাবস্থান এই প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈকি! কবিরা এমন লিখতে পারেন, লেখেনও।

কবিতার অ্যালিগরি বলে একটা ব্যাপার আছে, কিন্তু কোনো গদ্যকার কি সচেতনভাবে এমনটি লিখবেন? লিখলে- একটি শহর কীভাবে একইসঙ্গে মনোরম এবং মনোটোনাস হয়- গল্পকারকে এমন প্রশ্নে জর্জরিত হতে হবে। গল্পকাররা নানাদিক থেকেই দুর্ভাগ্যবান- পাঠকরা তাদের এতটুকু ত্রুটিও (!) ক্ষমা করে না। গদ্যের জন্য কাব্যিক ভাষাকে রীতিমতো নিন্দার চোখে দেখা হয় এদেশে, যেন গদ্যকে আবশ্যিকভাবে কাঠখোট্টা হতে হবে! গল্পের মধ্যে আবেগ থাকা তো গর্হিত অপরাধ, সমালোচকরা প্রায় মৃত্যুদণ্ডই দিয়ে দেন লেখককে। যেন 'নিস্পৃহ' 'নির্মোহ' 'নিরাসক্ত' হওয়ার কোনো বিকল্পই তাঁর সামনে খোলা নেই! যাকগে, এই আলোচনা বাদ দিয়ে বরং ওই একই গল্পের আরো কয়েকটি লাইন পড়ে নিতে পারি আমরা- "এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে...আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে।

ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্তকাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, 'তুই ফেলে এসছিস কারে' , সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে।

আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই। ..." মনে কি হয় না যে, একটি কবিতা পড়ছি? মনে কি হয় না, যেন কোথাও থেকে বিষণ্নতা ঝরছে! মনে কি হয় না যেন এইমাত্র একটা কথাহীন অব্যাখ্যাত সুর শুনে উঠলাম! এই পঙক্তিগুলো পড়ে মনে কি হয় না যে, এই ইলিয়াসকে আমরা চিনি না? গল্পটি নিয়ে আরও এগিয়ে গেলে আমাদের সঙ্গে রঞ্জুর পরিচয় হয়- এক বিষণ্ন একাকী যুবক, খানিকটা অস্বাভাবিক, হয়তো ব্যাখ্যহীন কোনো অসুস্থতায় আক্রান্ত। আমরা এগিয়ে চলি, তার মতো আমরাও বিষণ্ন হতে থাকি, একা হতে থাকি, আর পড়া শেষ হয়ে গেলে মনে হয়- একবার পড়ে এই গল্পটি বোঝা হয়ে উঠলো না। আবার পড়ার জন্য হাত বাড়াই, আবারও বিষণ্ন হই, কখনো হয়তো চোখের কোণ ভিজেও ওঠে, কিন্তু এবারও মনে হয়- আবার পড়তে হবে এই গল্প। কোনো কোনো কবিতা মানুষ ফিরে ফিরে পড়ে, বহুবার পড়ে, হয়তো সাধ মেটে না বলেই পড়ে কিংবা সেটি তার সূক্ষ অনুভূতিকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে বলে পড়ে।

কিন্তু গল্প? কোনো গল্প কি একই পাঠকের কাছে বহুবার পঠিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করে? সাধারণত করে না। যেটি করে সেটি উজ্জ্বলভাবে ব্যতিক্রম- 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' সেই ধরনের গল্প। কী হলো রঞ্জুর, কী হলো- এই ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে আমরা ইলিয়াস ঘাঁটি এবং বহুদিন পর তাকে পেয়ে যাই চিলেকোঠায়। সেই একইরকম- বিষণ্ন ও একাকী। অসুস্থ ও চলমান জীবনে অংশগ্রহণহীন।

অবশেষে তাকে হাড্ডিখিজিরের দেখানো পথে হারিয়ে যেতে দেখলে আমরা আবারও তার পরিণতি জানবার জন্য ইলিয়াস হাতরাই এবং দেখি তাঁর শেষ উপন্যাস 'খোয়াবনামা'য় এই রঞ্জুই তমিজের বাপ হয়ে উপস্থিত হয়েছে। দেখি, ইলিয়াস বারবার রঞ্জুর কাছে ফিরে এসেছেন। 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'র রঞ্জু, 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর ওসমান আর 'খোয়াবনামা'র তমিজের বাপ- এই তিনজন আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই চরিত্র। তিনজনই খানিকটা অস্বাভাবিক, অসুস্থই বলা চলে। তিনজনই ঘোরগ্রস্থ, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কহীন নিস্ক্রিয় মানুষ।

তিনজনের পরিণতিও এক- অস্বাভাবিক মৃত্যু। অথচ এর ঠিক বিপরীত চরিত্রও নির্মাণ করেছেন ইলিয়াস। 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর আনোয়ার কিংবা 'খোয়াবনামা'র তমিজ সেই ধরনের চরিত্র। আমাদের চারপাশেই এমন কিছু মানুষ আছে যারা বাস্তবতার মধ্যে বাস করেনা, করে ফ্যান্টাসি বা কল্পনার জগতে, সমাজে থেকেও এই লোকগুলো জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইলিয়াস তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি, এমনকি বিদ্রুপও করেননি তাদের নিয়ে, যেমন করেছেন মধ্যবিত্তদের, বরং তাদের প্রতি তাঁর এক গভীর সহানুভূতি টের পাওয়া যায়।

যে রঞ্জুকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর প্রথম জীবনে, তাকেই ফিরিয়ে এনেছিলেন ওসমান এবং তমিজের বাপের মধ্যে। আমার কাছে মনে হয়েছে -ওসমান ও আনোয়ার একই চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ, কিংবা তমিজ ও তমিজের বাপও একই চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ। একজন নিঃসঙ্গ, অসহায়, নৈরাশ্যপীড়িত, বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ; আরেকজন সক্রিয়, আশাবাদী, সমকালের আয়োজন ও প্রয়োজনের সঙ্গে একাত্ন। একজন মানুষের মধ্যে একইসঙ্গে পরস্পরবিরোধী মানুষ বাস করে- এইসব স্প্লিট পার্সোনালিটি নির্মাণ করে ইলিয়াস হয়তো সেটিই দেখাতে চেয়েছেন। আমাদের সবার মধ্যেই কি একই সঙ্গে একাধিক মানুষ বাস করে না? নিজেদের যে রূপটিকে আমরা সমাজের কাছে পরিচিত করে তুলি, সেটিই কি একমাত্র রূপ? তার আড়ালে কি আরো এক বা একাধিক রূপ লুকিয়ে থাকে না? একজন মানুষ কি আসলে একজনই মানুষ, নাকি একইসঙ্গে অনেক মানুষ? মামুন হুসাইন 'স্বগত মৃত্যুর পটভূমি' শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলেন ইলিয়াসকে নিয়ে।

সেই গল্প থেকে ইলিয়াসের জবানে কিছু কথা তুলে দিয়ে এই লেখা শেষ করা যাক : 'দেখেছি সরলতাই মানুষের স্বাস্থ্যের একমাত্র উপায়...' 'বড় দুঃখের চেয়ে ছোটো দুঃখ যেন বেশি দুঃখকর। ছোটো দুঃখের কাছে আমরা কাপুরুষ কিন্তু বড়ো দুঃখ আমাদের বীর করে তোলে...' 'আমি অনেক দিন ভেবে দেখেছি, পুরুষেরা কিছু খাপছাড়া আর মেয়েরা সুসম্পূর্ণ ...' 'দুনিয়া হলো চারদিনের আয়ু, তা দুদিন গেলো চাইতে চাইতে, দুদিন গেলো অপেক্ষায়...' (এটি মহাশ্বেতা দেবীর) 'জীবন একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত...' সত্যিই, জীবন একটা গম্ভীর বিদ্রুপ! এর সবকিছু তাই বুঝে ওঠা যায় না!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.