আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারী, গৃহ নির্যাতন ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নিয়ে একটি আলোচনাসূত্র

'... আমাদের আশার কোনো পরকাল নাই'

মাথায় গেড়ে বসা ধারনাগুলোকে একটুখানি ওলটপালট করে নিলেও গৃহে নারী নির্যাতন কিংবা নিপীড়ন বললে আমরা সবার আগে হাত-পাওয়ালা এক বা একাধিক আদম সন-ান খুঁজতে মন দিই। সত্যিই তো, মানুষ না থাকলে নিপীড়নটার চালক হবে কে? সপাং সপাং বেত্রাঘাত, বেল্ট খুলে প্রহার, চুলের মুঠি ধরে দানবীয় কণ্ঠে চিৎকার ইত্যাদি থেকে আমাদের নিপীড়ন ভাবনার শুরু হয় এবং তা শেষ হয় বড়জোড় ‘মুখে বিষ ঢেলে’, ‘শ্বাসরোধ করে’, ‘আগুনে পুড়িয়ে’ হত্যা অথবা এর চেয়েও বড় পর্যায়ে গেলে এলোপাথারি ছুরিকাঘাত বা জবাইয়ের মধ্য দিয়ে। আমাদের এই ধারনায় নির্যাতক বা নিপীড়কের যে স্পষ্ট চেহারা সামনে আসে, সেই চেহারা পতি, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ কিংবা পরিবারের এই স-রের সদস্যদের। আর কারণ হিসেবে উঠে আসে যৌতুক, কোন্দল, কলহ ইত্যাদি। আমাদের এই ধারনা পয়দা হবার পেছনের যে কায়দা তা নিয়ে একটু পরেই না হয় বলি।

আপাততঃ, আমরা যারা এই ধারনায় বিচরণ করি, তাদের জন্য একটু আরামের বিষয় আনি। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন মোকাবেলা করার ঠিকাকাজ আমরা যাদের হাতে তুলে দিতে পেরে দায়িত্ববোধের দমকে পরম আহ্লাদিত হই, তাদের এ যাবতকালের কাজকর্মে নারী নির্যাতনের যে চেহারা হাজির হয়, সেটিও আমাদের ধারনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থ্যাৎ এ সময়ের কাজকর্মগুলোর পরতে পরতে ঢুঁ মারলে নারী নির্যাতনের সংজ্ঞা হিসেবে যা আমাদের সামনে হাজির হবে তার গণ্ডি নারীর প্রতি শারীরিক সহিংসতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তা গৃহ (বেশিরভাগই যাকে পারিবারিক বলে তৃপ্ত হন) নির্যাতন হোক আর গৃহের বাইরের নির্যাতনই হোক। নারী নির্যাতনের এ জাতীয় সংজ্ঞায়ন ভীষণ পরিকল্পিত উপায়ে এটিকে সমাজের অন্য সব বঞ্চনা থেকে সযতনে আলাদা করে ফেলে।

নির্যাতকের সাধারণীকরণের বদলে ব্যক্তি চেহারাকে মুখ্য করে তোলে। ব্যক্তি চরিত্রের ওপর নির্যাতকের তকমা লাগিয়ে অথবা শুধুমাত্র পরিবার ও সমাজকে অগণতান্ত্রিক অথবা বড়জোড় পুরুষতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করে আমরা আমাদের দায়িত্ব খতম করে দিই। এর ফলে যে সমস্যাটি তৈরি হয়, তা হলো, আমরা আমাদের নিজেদের অজ্ঞাতেই ঢুকে পড়ি আগে থেকেই প্রস'ত করে রাখা নারী নির্যাতনের এক ধারনার মধ্যে। যে প্রাথমিক ধারনা নির্যাতনের শেঁকড়ে ঢুকে পড়ার জন্য কখনোই সহায়ক হয় না। যে ধারনা কেবল ব্যক্তি চরিত্র বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং নারী নির্যাতনকে আমজনতা তো বটেই, শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের কিংবা অভিজাত উচ্চবিত্তদের কাছেও হাজির করে বিচ্ছিন্ন এক প্রপঞ্চ হিসেবে।

আমাদের দেশে কালে কালে পুঁজির পাহাড়ের পাহারাদারের ভূমিকা নিয়ে গড়ে ওঠা মিডিয়াগুলোর কৌশলী ভূমিকা এই বিচ্ছিন্ন প্রপঞ্চটাকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রেখে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়। নারীর সত্তা: স্বাধীন নারী বনাম মুক্ত মানুষ নারী নির্যাতন নিয়ে যেকোনো আলোচনার শুরুতেই মানব সত্তা ও তার বিকাশের ধারার প্রতি মনোযোগ জরুরি। সত্তা জিনিসটা কী? মানব সভ্যতার যে ইতিহাস বিবর্তনের ধারায় তাকে মানুষ করেছে, সেই ইতিহাস আর মানুষের সত্তা বিকাশের ইতিহাস একই সময় ও পথের যাত্রী। সভ্যতার পথপরিক্রমায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী যে ধারনা আমাদের মধ্যে দৃশ্যমান, সেই ধারনায় আমরা যাকে স্বাধীন নারী বলি, সেই স্বাধীনতা আসলে কী? পুঁজিবাদী সমাজে এই স্বাধীনতার অর্থ হলো ব্যক্তির বড় হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে ব্যক্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে স্বাধীন বলে জাহির করা। অথচ এই স্বাধীনতার চেহারাটা ভালো মতোন আমলে নিলে দেখা যায়, চরম প্রতিযোগিতা হাজির করে এই পরিসি'তিটাকে এমন করে তোলা হয়েছে যে, এখানে ব্যক্তিক উন্নয়ন মূল কেন্দ্রে থাকায় সমাজের সব মানুষ সমানভাবে বিকাশের সুযোগ পেয়ে ওঠে না।

ফলে নারীর স্বাধীনতা তো দূরের কথা প্রানি-ক পুরুষরাও এই প্রতিযোগিতায় অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে মানব সত্তার বিকাশই যেখানে দুরূহ সেখানে স্বাধীন নারীর সত্তার বিকাশ আশা করা আর অশ্বডিম্ব প্রত্যাশা করা সমতুল্য? যে স্বাধীন নারীর ধারনা আমাদের মগজে বাসা বাঁধে সেই প্রক্রিয়াটির দিকে চাইলে বোঝা যায়, সভ্যতার ইতিহাসের মানুষের সব অর্জনকে বিবেচনায় নিলে এই প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অনবদ্য সৃজনশীল কর্তা হিসেবে বারবার আমাদের সামনে পুরুষ এসে হাজির হয়। নারী সেখানে গৌন। তার ভূমিকা কখনো সহকারী আবার কখনো উৎসাহদাতার। মানুষের ইতিহাস নির্মাণের বিচারে পুরুষ ‘কর্তাসত্তা’ আর নারী ‘কর্মসত্তা’।

তো সেই কর্তার কর্তৃত্বে আমাদের ধারনাগত স্বাধীন নারী চিড়েচ্যাপ্টা হন। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, এই যে মানব সত্তাকে অবরুদ্ধ করে প্রতিযোগিতার পথ তৈরি করা হচ্ছে এখানে নারীকে স্বাধীন তো করতে চাইছে, কিন' মুক্ত মানুষ হিসেবে বিকাশের পথ তৈরি করছে না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস'া: অধঃস-নের অধঃস-ন নারী শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস'ায় স্বাভাবিকভাবেই শোষণের শিকার হয় অধঃস-নরা। শোষণকে পাকাপোক্ত করে জিইয়ে রাখতে হলে উর্ধ্বতনদের কয়েক হাতিয়ারের মধ্যে নির্যাতন একটি। নির্যাতন আসলে শক্তির উন্মত্ত প্রকাশ।

অধঃস-নকে বশে রাখতে নিপীড়ন নানা রূপে ও স-রে নিপীড়কের কাছ থেকে হাজির হয়। আর শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস'ায় শোষক ও শোষিতের যাবতীয় সংঘাত আর কর্মের মধ্য দিয়েই তাবৎ উদ্দেশ্য হাসিল হয়। এই সম্পর্ক বা এই সংঘাতের নেপথ্যে প্রথমতই রয়েছে সম্পত্তি মালিকানা ও উৎপাদন ব্যবস'ায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। সম্পত্তি মালিকানা ও উৎপাদন ব্যবস'ায় নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতেই উর্ধ্বতনরা অধঃস-নদের ওপর তাদের শোষণের ছড়ি ঘুরিয়ে চলেন। সেই মালিকানা রক্ষার স্বার্থে হাজির করেন নানা ধরনের মূল্যবোধ আর সংস্কারের বেড়াজাল।

এই প্রশ্নে দুনিয়ার অধিকাংশ পুরুষই অধঃস-ন। আমার পাশের রহিমুদ্দি ইত্যাদি অধঃস-ন স্কয়ার, র‌্যাংগস, ট্রান্সকমের অধিকর্তাদের। এরকম অসংখ্য পুরুষ অধঃস-ন টাটা বিরলা বা মাইক্রোসফটের কর্ণধারদের। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীন সত্তার নামে পুঁজিবাদ যে ইঁদুর দৌড়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হবার তালিম আমাদের দেয়, তা আসলে এমন উর্ধ্বতন আর অধঃস-ন তৈরি করার। কিন' যেহেতু ইঁদুর দৌড়ে পরের বছর নিজেকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাবার স্বপ্ন এই কাঠামো আমাদের সামনে মুলোর মতোন ঝুলিয়ে রেখেছে, সেহেতু আমরা এই সিস্টেমের বাইরে আর কোনো কিছু দেখতে পাই না।

আমাদেরকে এই সিস্টেম বেঁধে ফেলে পুরো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অধঃস-ন হতে (কারণ সবাই তো সমানভাবে আর উর্ধ্বতন হতে পারেন না) আর এভাবেই অধঃস-নের ওপর ছড়ি ঘোরানোর বিষয়টি আমাদের সবার সম্মতি উৎপাদন করে নেয় ভীষণ কৌশলে। এবার শুধু নারীর প্রশ্নে যদি আসি, তাহলে দেখবো, সেখানে সমাজ কাঠামোর আরেকটা পর্দা টেনে রাখা হয়েছে। যে পুরুষটা দুনিয়ার সবচেয়ে অধঃস-ন হিসেবে নিজেকে দিনে কয়েকশ বার আবিস্কার করেন, সেই তিনিও জানেন, ঘরে তার অধঃস-ন একজন আছেন। এই অধঃস-নেরও অধঃস-ন হলো নারী। কাজেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস'ায় নারী হলো ‘তস্য’ অধঃস-ন।

কাজেই যে নারী উৎপাদন ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ নেই, এমন একজন মানুষের সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনে রয়েছেন, তিনি উর্ধ্বতনদের স্বার্থে পুরো সমাজের যে নিপীড়ন, তা সহ্য করেন। সেই সঙ্গে একই কায়দায় তাকে সহ্য করতে হয় তার অপেক্ষাকৃত উর্ধ্বতন কর্তার নির্যাতন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি সুনিপুণভাবে পরিচালনার জন্য একটি নিস্কণ্টক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলা হয়। এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ভাষা ব্যবহার থেকে শুরু করে আমাদের বোধের রাজ্য সবখানেই হানা দেয়। এর মাধ্যমে নারী সামাজিক সম্পর্ক ধরনেই (সোশ্যাল রিলেশনশিপ প্যাটার্ন) অধঃস-নতা প্রকাশ পায়।

পরিচিতির সংকট তৈরি করে। আর কে না জানে, যার পরিচিতির সংকট বিদ্যমান তার সামনে পেছনে দু’চারটে লাথি হাঁকালেও বলার কেউ থাকে না! গৃহী নারী, নির্যাতনও গৃহেই প্রাকশিল্প অর্থনীতিতে উৎপাদন হতো জ্ঞাতি সম্পর্ক, সমপ্রদায়, গোষ্ঠী বা পরিবারের ভিত্তিতে। সেখানে লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজন ছিলো নগণ্য। পরিবার ভিত্তিক এইসব উৎপাদন অর্থনীতিতে নারীর শ্রম বিবেচিত হতো নিখাদ শ্রম হিসেবেই। যাযাবর জীবনে (হান্টিং অ্যান্ড গ্যাদারিং) সন-ানের উপযোগিতা তাকে পেলে পুষে বড় করার তুলনায় কম ছিলো।

ফলে সভ্যতার ওই সময়টুকুতে নারীর মাতৃত্বের মহিমা উছলে ওঠেনি। কিন' কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি যখন শুরু হলো, তখন কিন' পরিসি'তি গেলো পাল্টে। সন-ান দুই কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো: এক, সম্পত্তির মালিকানার উত্তরাধিকার নির্ধারণ, দুই, কাজের হাত তৈরি। এরপর নারী সন-ান ধারন ও লালন আর গার্হস'্য কাজের জন্য তার শ্রম নির্ধারিত করার পর পুরুষেরা ক্রমেই বিস-ৃত করেছে তাদের সীমানা। নারী গৃহী হতে শুরু করে, পুরুষ হতে শুরু করে দিগ্বিজয়ী।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস'ায় উৎপাদনের মূল কেন্দ্র গৃহ থেকে সরে যখন কারখানা অফিসে স'ানান-রিত হয়, তখন গৃহী নারীদের শ্রম আর্থিক বিবেচনায় মূল্য হারায়। কারখানা শ্রমিকদের শ্রম যেহেতু অর্থের অঙ্কে নির্ণীত, তাই সমাজে তাদের কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি দেরি হয় না। গৃহী নারী পুঁজির রমরমা রাজত্বে গৃহে স'ান নেয় বিচ্ছিন্ন হয়ে। তাদের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্কও অবশ্য স'াপিত হয়, তবে তা পুরুষের মাধ্যমে। নারীর বিরামহীন গৃহসেবা নতুন শ্রমিক জন্ম দেয়, আবার চলমান শ্রমিককেও রাখে ফুরফুরে।

নারী পরিবার ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস'া থেকে সরে এসে থেকে গৃহী হয়েছে এবং গৃহেই তার শ্রম নিয়োগ করছে। কিন' পুঁজিবাদী সমাজব্যবস'া নিদারুন কৌশলে সেই শ্রম-মূল্য অস্বীকার করছে। পুঁজির প্রবাহের পথে কর্তৃত্বের সমস- জন-রমন-র স'াপিত হচ্ছে। এই পুরো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস'ায় পয়লা নির্যাতনের শিকার নারী এভাবে, এই কাঠামোতে তার গৃহেই হচ্ছে। বিষয়টি একটু পরিস্কার করতে হলে পরিসংখ্যানের আশ্রয় নেয়া জরুরি।

জাতিসংঘের দেয়া তথ্য মতে, নারী প্রতি বছর গৃহে যে শ্রম দেয় তার বাৎসরিক মূল্য দাঁড়ায় ১১ ট্রিলিয়ন ডলার। নারীরা গৃহে যে শ্রম দেয় তা বাজারমূল্যে জিডিপিতে যুক্ত করলে বিশ্বের মোট উৎপাদন পরিমাণ আরো ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এই পরিসংখ্যান তো পরিস্কারই বলছে, নারীর গার্হস' শ্রমকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যহীন করে তুলে একদিকে নারীর শ্রমমূল্য শোষণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে এই শ্রমকে মূল্যহীন বলে অধঃস-ন হবার মানসিকতা ও সেই মোতাবেক এই শোষণ ব্যবস'া টিকিয়ে রাখার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করা হচ্ছে। কর্তৃত্বের কারণে সমাজে যে পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারা তৈরি হয়, সেই ভাবধারা এমন ব্যবস'াকে পাকাপোক্ত করতে সাহায্য করে।

ফলে ব্যক্তিগত মালিকানা যতো বিস-ৃত হয়েছে কর্তৃত্ব ততো বেড়েছে এবং পুরুষতন্ত্র ততোই পাকাপোক্ত হয়ে আসন গেড়েছে। গৃহে অন-রীণ নারী আরো শৃঙ্খলিত হয়েছে। গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নির্যাতন শুধু নিছক লৈঙ্গিক বিবেচনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। যে সামাজিক সম্পর্কগুলো তাকে অধঃস-ন করে তুলেছে, সেগুলোর কর্তৃত্বের কেন্দ্রে বসবাসকারী নারীরাও (শাশুড়ী, ননদ ইত্যাদি) যোগ দিয়েছেন সেই নির্যাতনের মিছিলে। এই পুরো প্রক্রিয়া আরো সহজতর হচ্ছে সামাজিক প্রথা, রাষ্ট্রীয় আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কৌশলী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।

সামপ্রতিক সময়ে গৃহী নারীদের নানা কায়দায় স্বাধীন করে তোলা হচ্ছে এবং বাইরে আনা হচ্ছে। কিন' সেখানেও নজর দিলে দেখা মিলবে শুভঙ্করের ফাঁকির। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের পণ্যায়ন করা হচ্ছে। এই বিষয়টি আবার ছড়িয়েও দেয়া হচ্ছে নানান কায়দায়। ফলে গৃহের কর্তৃত্ববাদী নির্যাতকরা এই দোহাই দিয়েই নারীকে আরো বেশি শৃঙ্খলিত রাখতে চেষ্টা করছে।

আর উৎপাদন প্রক্রিয়ার যে অংশে নারীর শ্রম অপরিহার্য করে তোলা হয়েছে সেখানেও মজুরি বৈষম্যের মাধ্যমে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। মজুরি শ্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের পরেও দেখা যাচ্ছে, গৃহের দাসত্ব থেকে তার মুক্তি ঘটেনি। ফলে গৃহে সেই বাজারমূল্যহীন শ্রমের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের পরতে আটকাই থেকে যাচ্ছে। আর সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে চমৎকার কৌশলে স্বামীর ঘরকেই নারীর ঘর বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর্থিক পুঁজি সঞ্চয়ে গৃহ নির্যাতন বিশ্ব স্বাস'্য সংস'া ২০০৫ সালে ১০টি দেশের ২৪ হাজার নারীর ওপর গবেষণা কাজ চালিয়েছিলো।

বাংলাদেশও সেই গবেষণায় অন-র্ভুক্ত ছিলো। এতে পাওয়া যায়, ইথিওপিয়ার গ্রামীণ সমাজে সর্বোচ্চ ৭১ শতাংশ নারী গৃহ নির্যাতনের শিকার। তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী গৃহ নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে, ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের শহুরে সমাজে এ হার পঞ্চম সর্বোচ্চ, ৫৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি ৬ জন নারীর একজন নির্যাতনের শিকার।

আর প্রতি ৬ জনের ৩ জনই এই নির্যাতনের বিষয়টিকে গা সওয়া বা এমন তো হয়ই বলে মনে করেন। অর্থ্যাৎ ‘স্বামীরা তো এমনই...’। সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠনের কাজ কী চমৎকারভাবেই না করে ফেলা হয়েছে! ওই গবেষণায় আরো দেখা যায়, যারা নির্যাতনের শিকার হন, তাদের বেশিরভাগই ভগ্নস্বাস'্য। মূলত দারিদ্র্য পীড়িত এলাকাগুলোতে এই হার বেশি হলেও সম্পদশালীদের গৃহেও এ ধরনের ঘটনা বিদ্যমান। গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, গৃহ নির্যাতনের প্রথম শুরুটা হয় আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে।

বাংলাদেশে এক্ষেত্রে যৌতুক বা শ্বশুরের সম্পদের হিস্যা উল্লেখযোগ্য। এখানে লক্ষণীয়, কর্তৃত্ব রয়েছে বলে নির্যাতন হচ্ছে ঠিকই, কিন' সেই নির্যাতনের সূচনা কিন' হচ্ছে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিকে ঘিরে। এর মাজেজা কী? নারীর শ্রমের মূল্য নাই বা থাকলো। যৌতুকের কিন' বাজারমূল্য রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য শ্বশুরের সম্পদের হিস্যার ক্ষেত্রেও।

ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে চাই পুঁজি। আর সেই পুঁজি সঞ্চয়ের অভিপ্রায়ে গৃহে নারীর ওপর নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে। নারীদের ক্ষমতায়ন ও তাদের এইসব নির্যাতন থেকে মুক্তি দিতে তাদেরকে পুঁজির মালিক হবার চকচকে লোভ দেখিয়ে আমাদের দেশে অনেক আয়োজনই হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি নির্ভর এই দেশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আয়োজন হলো তত্ত্ব হিসেবে বিদেশে ‘রফতানি’যোগ্য ক্ষুদ্র ঋণ (অন-তঃ উদ্যোক্তারা তো তাই বলেন)। কিন' প্রত্যাশিতভাবেই এই ক্ষুদ্র ঋণে গ্রামীণ নারীদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি (সংশ্লিষ্ট অন্যদের বেলায় কথাটা উল্টো করে পড়তে হবে)।

আমার কথা নয়, গবেষণার কথা। ২০০০ সালে আইসিডিডিআর,বি’র সোশাল ও বিহেভিয়ারাল সায়েন্স ইউনিট থেকে গ্রামীণ সমাজের ওপর ‘ঘধঃঁৎব ড়ভ ফড়সবংঃরপ ারড়ষবহপব ধমধরহংঃ ড়িসবহ রহ ধ ৎঁৎধষ ধৎবধ ড়ভ ইধহমষধফবংয: রসঢ়ষরপধঃরড়হ ভড়ৎ ঢ়ৎবাবহঃরাব রহঃবৎাবহঃরড়হং’ শিরোনোম একটি গবেষণা চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, গ্রামীণ সমাজে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করেনি এমন নারীদের তুলনায় ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করেছে এমন নারীর ওপর গৃহ নির্যাতনের হার বেশি। কারণ পুরুষরা পুঁজি সঞ্চয়ের অস্ত্র হিসেবে স্ত্রীদের দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করায়। এরপর যখন সেই মহান ঋণের ফাঁস গলায় চেপে বসে, তখন তার জের এসে পড়ে স্ত্রীদের ওপর।

নির্যাতনের মাত্রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন স'ানে পৌঁছে যে, অনেক নারীকে ঘর ছাড়া হতে হয়। সম্ভ্রম খুঁজতে হয়রান মিডিয়া গত ১৮ এপ্রিল সমকালের ১২ পৃষ্ঠায় দুই উন্মত্ত ষাঁড়ের লড়াইয়ের ছবির ঠিক নিচে ‘সম্ভ্রম হারানোর ১৭ দিন পর উলিপুরে কিশোরীর আত্মহত্যা’ শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়েছে। ১৩ বছরের এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর সে আত্মহত্যা করেছে- এটিই খবরের বিষয়বস'। শুধু শিরোনামেই নয়, পত্রিকাটির দাবি অনুযায়ী ওই স্কুলছাত্রী যে সম্ভ্রম হারিয়েছে, সে কথা খবরের ভেতরেও একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এতোক্ষণ ধরে নারী নির্যাতনের যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো, তার ভেতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্যাতনের অনুকূল নিরাপদ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার প্রক্রিয়া।

আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর কল্যাণে নারী নির্যাতন কমছে বলে অনেকে দাবি করেন অবশ্য। আমি সেই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়ে কিংবা মিডিয়ার অবদানকে ছোট বড় করার দিকে না গিয়ে শুধু বলতে চাই, সেই নির্যাতনের জন্য নিরাপদ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে ভাষা-সংস্কৃতি নির্মাণ করছে মিডিয়া। ধর্ষণের শিকার একজন নারীর সম্ভ্রম খুঁজতে হয়রান হওয়াটা তারই অংশ। মিডিয়া এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সম্মতি উৎপাদনের জন্য যে ভাষা সংস্কৃতি নির্মাণ করে তাতে আবশ্যিকভাবেই নারীকে দুর্বল, অধঃস-ন হিসেবেই হাজির করা হয়। এই যে সম্ভ্রম, তা কিন' নারীর কোনো সম্পদ নয়।

কিন' মিডিয়া নারীর প্রতি চুক চুক শব্দ করে সহমর্মিতা জানানোর আড়ালে সম্ভ্রমের মতো একটি শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক শব্দ ও নির্যাতনের ভাষাগত অস্ত্র নিপীড়কদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর বাংলা শব্দ ভাণ্ডার অস্বাভাবিক সীমিত, অথচ এসব শব্দ ভাণ্ডার যেনো অফুরন-। আমরা মাঝে মধ্যেই মিডিয়াতে ধর্ষক বা নিপীড়কদের পাষণ্ড, নরপশু বলে চালান করি। এতে যে ভাষিক বৈধতা নির্মিত হয়, তা হলো, নির্যাতনের আসল তাৎপর্য চাপা পড়ে যায়। নির্যাতনকে তখন বিচ্ছিন্ন বলে মনে হতে থাকে।

মনে হয়, এসব কাজ আসলে মানুষের নয়, অমানুষদের। মনে হয়, এর পেছনে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক কারণ নেই। এর পেছনে পুরো কারণটাই ওই ‘নরপশু’ ইত্যাদিদের মানসিক বিকৃতি দায়ী? কিন' আসলে কি তাই? মিডিয়া প্রতিনিয়ত যে কাঙ্ক্ষিত বাস-বতা উৎপাদন করে চলেছে তা আসলে কী? মিডিয়াগুলো যে নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজেদের উচ্চকিত হিসেবে জাহির করে তার তো আলাদা কোনো অবস'ান আমরা দেখতে পাই না। মিডিয়া বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্রের এজেন্ডাই বাস-বায়ন করে। কারণ নিপীড়িত নারীর প্রতি সহানুভূতি আনতে যে ভাষাগুলোকে মিডিয়া বৈধতা দান করছে তা থেকে পরিস্কার তারা নারীকে মানুষ হিসেবে নয়, মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যার চিরাচরিত রূপেই রাখতে আগ্রহী।

মিডিয়া সমাজে এইসব নির্যাতনকে যে ঘৃণ্য কাজ বলে উল্লেখ করে তার নেপথ্যে এটা নেই যে, নারীরা যাতে মানুষ হিসেবে তাদের ন্যায্য অধিকার পায়। বরং তার নেপথ্যে সেই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, নারীকে সন-ান উৎপাদনের জন্য ও সমাজের নির্ভরশীল অংশ হিসেবে রক্ষা করার জন্য। এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন- নারীর অসি-ত্ব রক্ষার জন্য পুরুষের প্রতি নির্ভরশীলতাকে প্রকাশিত করে, যা নারী নির্যাতনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কাজেই চলমান সমাজ কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস'ায় নারী নিপীড়ন রোধ বা নারী মুক্তি তো দূরের কথা মানুষের মুক্তিই কষ্টকল্পনা হতে চলেছে। আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীদের একটি অংশ নারীমুক্তির লড়াইয়ে সক্রিয় অংশ নেন না।

তারা মূলতঃ সামাজিক কিছু অসুবিধার জায়গা থেকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হন। তথাকথিত পুরুষদের বড় অংশের অবস'াও আলাদা কিছু নয়। কিন' এর নেপথ্যে যে মুনাফালোভী পুঁজিবাদ তা আড়াল করে রাখাও তাদের বড় ধরনের প্রচেষ্টায় থাকে। আর এই ছোট খাট উচ্চকণ্ঠ পুঁজিবাদ ধারন করে এবং তা প্রত্যাশাও করে। কারণ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ অমিত বলশালী ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।

কাজেই ছোট ছোট প্রতিরোধ সেইসব মানুষের পিঠ খানিকটা দেয়াল থেকে এগিয়ে আনে, শোষণ আরো দীর্ঘস'ায়ী করে। আমরা কি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার অপেক্ষায় অনন-কাল থাকবো? # লেখাটি ২০ এপ্রিল রাজশাহীতে বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা'র সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পাঠ করা হয়েছিলো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.