আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেরালী কুড়ি/মুক্তিযুদ্ধে নিহত শিশু



অনেক আশার বহু বেদনার কাঙ্খিত স্বপ্নের ভোরে, শত্রুর সুখে রোপিত বীজের পুষ্পেরা আজ ফোটে। এ মাটির বুকে যায়নি গাঁথা পরাধীনতার মন্ত্র, রেখে গেল তায় তপ্ত ধরায় অমানবিকতার চিহ্ন। মৃত্যু কোটর হয়তো গ্রেনেট অথবা একটি মাইন, অবুঝ শিশু দেয় ফাঁদে তার সবুজ চপল পা। পরাজয়ের গ্লানির বদলে নিস্পাপ শিশুর প্রাণ, খুনী ধর্ষক শত্রুর মুখে আনে তৃপ্তির বান। তিরিশ লাখের রক্তে এদের তৃষ্ণা দূর্ণিবার, রক্ত ঝরুক রক্তে লেখা স্বাধীনতার নাম।

যুদ্বোত্তর সংকটের সমাধান এত কঠিন! তা এখনো কেউ বুঝতে পারেনি। তাই যদুর চায়ের দোকানে পান প্রার্থীদের আড্ডায় দুঃশ্চিন্তার লেশ মাত্র নাই। ওহেদ আলী বয়াতীর দোতারায় যখন মুক্তি বাহিনীর বীর গাঁথা মূর্ত হয়ে উঠে, তখন শ্রোতারা হাত তালি আর হাত খরচ দুটোই অকাতরে দান করে। ভজনের ফেরার অপেক্ষায় অতিষ্ঠ নমিতার সময়গুলো, স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ গড়তে, আগামী দিনের সৈনিকদের অক্ষর জ্ঞানদানে ব্যায় করছে। ভজন ফিরে এলে নিশ্চই খুব মুগ্ধ হবে।

পাড়ার যুবকেরা বাঁশ যোগাড় করে ছনের চালার নীচে আমাদের গ্রামের প্রথম পাঠশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। তার ছায়ায়, নমিতাদির মায়ায়, শেরালীর বর্ণমালা শেখার প্রয়াস চলে। জানিনা কি কারণে এক একটা বর্ণমালা আমার সামনে নতুন দিগন্তের দ্বার উম্মোচন করে দিতে লাগল! মধুর স্বাদ ও রংয়ের মরুভূমির বালুর মত ছাতু হাতের তালুতে নিয়ে চাটতে চাটতে বাড়ী ফেরার সময় মনে হত; মায়ের কাছে যদি নমিতাদীর ছাতুর বস্তাটা থাকতো! আকাশে মেঘের পাল, নদীতে জোয়ারের জল, বেন্না আর হিজলের থোকা থোকা ফুলের ডালি হয়তো একটি সুন্দর নবান্নের সূচনা সংগীত। মেঘের গুরু গুরু গর্জন, বাজায় তারই ঢাক। এই বৈশাখে আমাদের মত আরো অনেকের ছনের চাল, মাথা গোজার আশ্রয় হয়ে থাকবে কিনা, সে ভাবনার আতঙ্ক দোলায় প্রকৃতির সুন্দরের দান আর অকুন্ঠ চিত্তে পান করা হয়ে উঠে না।

বৈঁচি, বেতুমের লোভে পাল বাড়ীর পরিত্যাক্ত জঙ্গলে একদল ছেলেমেয়ে অভিযানে বেড়িয়েছে। অভিযাত্রী দলের কারো কঁচি পা একটা কঠিন কিছুর দলায় হোচট খেলো। দলের বাকীরা তা আবিষ্কারের নেশায় খুঁজে পেল একটা শক্ত বল। ব্যাস খেলা শুরু হয়ে গেল। এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে আবার কুড়িয়ে পাওয়ার আনন্দ! কিন্তু বলটা কিসের তৈরী? সে প্রশ্নের উত্তর বড় কঠিন, বড় নির্মম।

ছোট মাথায় এতকিছু ঢুকে না। বল নিয়ে সবাই বাড়ী এল। পুরুষরা বৈশাখের আর্শিবাদী বর্ষনের আগেই আমনের আগাছা নিড়ানীতে, ক্ষেতে। কৃষানীরা বর্ষায় ঘরে বসে রান্নার চুলো আর খড়ি সাজিয়ে রাখছে। উঠোনে অদ্ভূত বল নিয়ে, ছোটদের খেলায় মনোযোগ দেয়ার সময় কারো হাতে নেই।

আঙ্গিনায় শিমের শুকনো লতা পোড়ানো হচ্ছে, হুকোর তামাক সাজায় তার ছাই দিয়ে বাতাসার মত টিক্কা হবে। তাতে একটু আগুনেই আরাম করে তামাক টানা যাবে। কে যেন বলটা সেদিকে গড়িয়ে দিল! তামাসা দেখার জন্য সবাই সেখানে জড়ো হল। বিকট শব্দে গ্রামটা কেঁপে উঠল। যুদ্ধের বিভীষিকা এখনো শেষ হল না! সবাই এবার অকুস্থলের দিকে ছুটল।

বিরাট একটা গর্ত ঋতুশ্রাবের রক্তে ক্ষানিকটা পূর্ণ। জরায়ূতে এই কিছুদিন আগে এমন রক্তেই এ শিশুরা বসবাস করতো। এখন সে রক্তেই আবার মিশে গেল। যাদের জীবিতাবস্থায় পাওয়া গেল, তাদের নৌকা বোঝাই করে বোয়ালমারী বাজারের দাতব্য চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হল। এদিকে রক্তে নৌকা প্রায় ডুবুডুবু।

কে একজন নৌকাডুবী রহিত করতে সেওতি দিয়ে সে রক্ত গোমতীর ঘোলাজলে সেঁচে দিচ্ছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতায় এদের রক্ত যোগ হবে? অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দাতব্য চিকিৎসালয়ে পৌঁছার আগেই অনেকের কঁচিপ্রাণ অসীমের সন্ধানে উড়াল দিয়েছে। গোমতীর তীরে শোল মাছের সোনালী পোনার মত কঁচি দেহগুলো সারি বেঁধে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। বৃন্ত থেকে ছেড়া, জল দিয়ে ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখা গোলাপের মত, এখনো এদের দেহ থেকে প্রাণের খুশবো ছড়াচ্ছে। ক্রোধ না দ্রোহ, শোক না সংশয়, অযত্ন না অবহেলায়, কার বেখেয়ালে শেরালীর বৈশাখের ভৈরবী এমন করুণ ধারায় ঝরছে!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.