আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মদীনার জীবন-চিত্র

আমি হিমেল, আমার ব্লগে আপনাকেস্বাগতম।

রাতের আধার শেষে দিন হল। লোকজন মসজিদে নববী হতে শান্ত ও গাম্ভীর্যের সাথে ফিরছে। তবে তারা চঞ্চল, তৎপর। এখানে বাজারে একটি দোকান খোলা হচ্ছে।

ওখানে ক্ষেতে একটি লাঙ্গল চলছে। এটি একটি খেজুর বাগান, এতে পানি সিঞ্চন করা হচ্ছে। উনি একজন দিনমজুর। মজুরির বিনিময়ে একটি বাগানে কাজ করছেন। সন্ধ্যায় মজুরি গ্রহণ করবেন।

তারা সবাই নিজ নিজ কাজে ছুটে গেছে। কারণ, হালাল উপার্জন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণের ফযীলত তারা শুনেছে। তোমরা তাদেরকে দেখবে- কাজে-কর্মে তারা সুচতুর, আল্লাহর যিকিরে তাদের রসনা সিক্ত, সওয়াব ও প্রতিদান অন্বেষণে তাদের মন সদা প্রস্তুত। তাদের পার্থিব কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা এ পরিমাণ, যে পরিমাণ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য আজকের নামাযির স্বীয় নামাযের মধ্যেও নেই। তাদের দেহ কর্মে নিয়োজিত, আর মন আল্লাহর প্রতি ধাবিত।

মুআজ্জিন মাত্র আজান দিল। সাথে সাথেই তারা যে কাজে ছিল তা থেকে নিজেদের হাত ঝেড়ে নিচ্ছে। যেন এর সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না। সে সব লোকেরা মসজিদ অভিমুখে দ্রুত ছুটল, যাঁদেরকে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে অমনোযোগী করতে পারে না। তারা সেদিনের আশংকায় থাকে যে দিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি উল্টে যাবে।

নামায শেষ করা মাত্রই তারা জমিনে ছড়িয়ে পড়েছে; আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করার লক্ষ্যে এবং তাঁকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ঝুঁকল, তখন তারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরল। পরিবার-পরিজনের সংগে সাক্ষাত করল এবং তাদের সামনে বসল। আল্লাহর পক্ষ হতে প্রতিদান ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাদের সংগে কথা বলছে। কোমল আচরণ করছে এবং তাদেরকে অন্তরংগ করছে।

এশার নামাযের পর ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ দেখি কি! শেষ রাতে ওরা গুন্‌গুন্‌ করছে এবং তাদের বুক হাঁড়ির উথলানোর ন্যায় উথলিত হচ্ছে। ফজর নামাযের পর তারা সৈনিকের উদ্যম ও শক্তিসহ নিজ নিজ কাজের প্রতি একাগ্রভাবে মনোনিবেশ করছে; যেন দিনে তারা ক্লান্ত হয়নি এবং রাতে জাগ্রত থাকেনি। মসজিদে যিকির ও ইলমের আসরগুলো দেখো, তাতে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক একত্র হয়েছে। ইনি ঐ কৃষক যাকে দিনে তুমি ক্ষেতে দেখেছে।

ইনি ঐ দিনমজুর যাকে বালতি টেনে এক ইহুদির বাগানে খেজুরগাছ সিঞ্চন করতে দেখেছ। ইনি ঐ ব্যবসায়ী যাকে মদীনার বাজারে বিক্রি করতে দেখেছ। আর ইনি ঐ কারিগর যাকে তুমি তার পেশায় নিয়োজিত পেয়েছ। এখন তারা তালিবুল্‌ ইল্‌ম (ইল্‌ম অন্বেষণকারী) ব্যতীত আর কিছুই নন। তারা বিশ্রাম বর্জন করেছে।

অথচ দিনের ব্যস্ততার পর তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। নিজেদের পরিবার-পরিজন বাড়ীতে রেখে এসেছে। অথচ তারা তাদের প্রতি ব্যাকুল। কারণ, তারা শুনেছে- ‘অবশ্যই ফিরিশতাগণ ইল্‌ম অন্বেষণকারীর সম্মানে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন, ইল্‌ম অন্বেষণকারীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে। ’ এবং এ কারণেও যে, তারা শুনেছে- ‘যারাই আল্লাহর যিকিরের উদ্দেশ্যে (কোন স্থানে) বসে, ফিরিশতাগণ তাদেরকে ঘিরে নেন।

রহমত তাদেরকে ছেয়ে নেয় তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয় এবং যারা আল্লাহর নিকটে আছে আল্লাহ তাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। ’ তুমি তাদেরকে নীরব দেখবে, যেন তাদের মাথার উপর পাখি। বিনয়ী, যেন অহী অবতীর্ণ হচ্ছে। ‘পরে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হয় তখন তারা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করে- তোমাদের প্রতিপালক কী বলেছেন? তদুত্তরে তারা বলে-যা সত্য তিনি তা-ই বলেছেন। তিনি সমুচ্চ, মহান।

’ ইলম ও বিনয় প্রতিযোগীতা করে। জানা যায় না, কোন্‌টি অগ্রগামী। ভাব অন্তরের দিকে ও শব্দ কানের দিকে ‘কে কার আগে এই মনোভাবে অগ্রসর হয়। বুঝা যায় না, কোনটি দ্রুততর। অনেকে পালাক্রমের উপর একমত হয়েছে।

তাদের কেউ রাসূলের মজলিসে অনুপস্থিত হলে তার প্রতিবেশী বা ভাই উপস্থিত থাকে। এভাবে প্রথমজন মসলিসে যে হাদীস আলোচনা হয় বা যে আয়াত অবতীর্ণ হয় তা দ্বিতীয়জনকে অবহিত করে। এঁরাই ছাত্র। এঁরা ইলমের নিরবচ্ছিন্ন সংগ নিয়েছে। রাত্র যখন তাদেরকে ঢেকে ফেলে তখন তারা মদীনায় এক শিক্ষকের কাছে ছুটে যায় এবং রাতভর পড়াশুনা করে।

সকাল বেলা যার শক্তি থাকে সে মিষ্টি পানির খোঁজে বের হয় এবং লাকড়ি সংগ্রহ করে। আর যাদের সামর্থ থাকে তারা একত্র হয়ে বক্‌রি কিনে এবং তা ভক্ষণ উপযোগী করে অতঃপর তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুজরা গুলোর (কামরা) সংগে লটকানো থাকে। মদীনার প্রত্যেকই হালাল-হারাম এবং স্বীয় জীবন, পেশা ও চাকুরী সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞাত। নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য যতটুকু কুরআন মুখস্থ থাকা অত্যাবশ্যক, ততটুকু কুরআন মুখস্ত পারে। তাছাড়া সে ইলম অন্বেষণে নিরবচ্ছিন্ন, নিরলস।

বিধি-বিধানের তত্ত্বজ্ঞান, ধর্মের দৃঢ়তা ও বদ্ধমূলতা, আমলের আগ্রহ ও নিষ্ঠা আখেরাতের প্রতি ব্যকুলতা ও ছওয়াবের আকাঙ্খা প্রত্যহ তার বাড়ছে। তাদের ফযীলত ও দ্বীনের মূলনীতি সংক্রান্ত জ্ঞান মাসআলা ও শাখা-প্রশাখা সক্রান্ত জ্ঞানের তুলনায় বেশী। তাদের অন্তর সর্বাধিক পুণ্যবান; ইলম সবচে’ গভীর এবং লৌকিকতা সবচে’ কম। তাদের কেউ যখন দ্বীনের কোন জ্ঞান অর্জন করে তখন নিজের ভাইদের দিকে দ্রুত ছুটে যায়। তাদেরকে তা শিক্ষা দান করে।

কেননা সে শুনেছে- ‘জেনে রাখ, উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। কারণ, কোন কোন এমন ব্যক্তি যার নিকট পৌঁছানো হয় শ্রোতা অপেক্ষা অধিক সংরক্ষণকারী হয়। ’ তারা তাদের নবীকে বলতে শুনেছে- ‘আমি শিক্ষক রূপে প্রেরিত হয়েছি। ’ তারা তাঁকে বলতে শুনেছে- ‘দু’ব্যক্তির সাথেই হিংসা করা যায়। এক, যাকে আল্লাহ কোন সম্পদ দান করেছেন।

আর সে তা অভাবীদের মধ্যে ব্যয় করে। দুই, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন। অতঃপর সে তার আলোকে মানুষের মধ্যে মিমাংসা করে এবং মানুষদেরকে তা শিক্ষা দান করে। ’ এভাবেই মদীনার মুসলমানগণ ছাত্র ও শিক্ষক দু’ভাগে ভাগ হয়ে পরে। হয়ত ছাত্র, অথবা শিক্ষক।

বরং তাঁদের প্রত্যেকে একই সময় ছাত্র ও শিক্ষক। এক স্থান হতে গ্রহণ করে এবং অন্য স্থানে অর্পণ করে। ইতিহাস কি এই নববী শিক্ষাঙ্গনের তুলনায় অধিক ব্যাপক কোন শিক্ষাঙ্গনের সন্ধান পেয়েছে, যার মধ্যে লেখাপড়া করে ব্যবসায়ী, কৃষক, দিনমজুর, কারিগর, পেশাজীবি, ব্যস্ত মানুষ, টগবগে যুবক ও অতিশয় বৃদ্ধ। তারা সেখানে নিজেদের সকল শক্তি ব্যয় করে শিক্ষা লাভ করে। কান শ্রবণ করে, চোখ দেখে, অন্তর অনুভব করে, মস্তিস্ক চিন্তা করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তা কাজে বাস্তবায়ন করে।

তারা সমাজজীবনের বিধি-বিধান জেনেছে সমাজজীবনের মধ্যে; মেলামেশার বিধি-বিধান মেলামেশা করে; ব্যবসা-বাণিজ্যের বিধি-বিধান ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে এবং পারস্পরিক আচার-আচরণের বিধি-বিধান পরস্পরের উঠা-বসার মধ্যে। ফলে সভা-সমিতি, বাজারের শোরগোল ও ঘর-বাড়ীর ব্যস্ততার মধ্যে অবস্থান করেও তারা নিজেদের দ্বীন, নিয়ত, বিনয় ও আল্লাহর যিকির বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাই তারা যখন জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় তখন কোন ক্ষেত্রে পরাজিত হয় না। ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে ব্যক্তি এক উত্তাল সমুদ্রে অথবা এক খরস্রোতা নদীতে সাঁতার শিখেছে। ফলে তাঁরা মসজিদ তেকে বের হয়েও মসজিদে থাকত এবং নামায সমাপ্ত করেও নামাযেই।

তাঁদের অন্তর পুণ্যবান। তাঁরা অঙ্গিকারে সত্যবাদী। মসজিদ ও বাজারে, এ‘তেকাফের স্থান ও দোকান, গৃহ ও প্রবাস মোটকথা সর্বস্থানে এবং বন্ধু ও শত্রু নির্বিশেষে সকলের সাথে তাঁদের কথা হত নির্ভুল, অভ্রান্ত। অবশেষে যখন জিহাদের প্রতি আহ্বানকারী আহ্বান করল- ‘তোমরা লঘু ও ভারী রণসম্ভারসহ বেরিয়ে পড়ো এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে লড়াই করো’ এবং জান্নাতের শ্লোগান দানকারী উঁচুস্বরে ডাকল- ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপলকের ক্ষমা ও এমন ঘন গাছ-গাছালিপূর্ণ উদ্যানের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও, যার বিসতৃতি নভোমণ্ডল ও ভু-মণ্ডলের ন্যায়’ তখন ব্যবসায়ী তার দোকানে তালা লাগিয়ে দিল; কৃষক তার লাঙ্গল ছেড়ে দিল; কারিগর তার যন্তপাতি নিক্ষেপ করল এবং মজদুর তার বালতির রশি ছেড়ে দিল। তাঁরা আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়ল।

কোন কিছুর দিকে ফিরে তাকাচ্ছেনা। যেন সময়টি তাঁদের পূর্ব নির্ধারিত ছিল এবং ঘর-বাড়ীও পরিবার-পরিজনের পক্ষ থেকে তাঁদের ছিল অনুমতি ও ছাড়। তোমরা তাঁদেরকে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে ও পৃথিবীতে বিচরণ করতে দেখবে। যেন ঘোড়ার পিঠেই তাঁরা সৃষ্টি হয়েছে, জন্ম লাভ করেছে ওঁরা উটের হাওদায়। আল্লাহর পথের সকাল ও সন্ধার একবারের গমনকে ওরা দুনিয়া ও দুনিয়ার সমুদয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম মনে করে।

তাঁরা দিনকে রাতের সংগে এবং শীতকালকে গ্রীস্মকালের সংগে মিলিয়ে দেয়। তারা যেখানেই সফর করে ও যাত্রা বিরতি করে, তা হয়ে যায় চলমান শিক্ষাঙ্গন ও ভ্রাম্যমান মসজিদ। এভাবেই তাঁরা পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এবং প্রাচ্য হতে পাশ্চাত্য পর্যন্ত ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছে। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।