আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিবর্তন, বৈষম্য ও সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত



বিবর্তন, বৈষম্য ও সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত ফকির ইলিয়াস ================================== রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের সব দেশেই আছে। একটি সমাজ নির্মাণে সে সমাজের মানুষের পরিশুদ্ধ অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর দিন। আর সে অংশগ্রহণ কিন্তু নারী এবং পুরুষের সমান ভাবেই হতে হয়। এমন এক সময় ছিল, যখন নারীশিশু জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত পুঁতে রাখার আদিমতা ছিল সামজে। অথচ মানুষ সে সময়ও ছিল বিবর্তনবাদী।

প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ যদি সভ্যতা সুন্দর এবং সত্যের স্বপক্ষে বিবর্তনবাদীই হবে, তবে মাঝেমাঝে এখনো আদিমতা গ্রহণ করবে কেন? আমরা কতগুলো উদাহরণ দেখি এখনো প্রাচ্যের সমাজে। পুরুষতান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার কখনো কখনো আমাদের ভুলিয়ে দেয়, এ সমাজে নারী নামের আরেকটি লিঙ্গের মানুষ আছে। শাসনের বিভিন্ন জাঁতাকলে আছে। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয়, তত্ত্বীয়, ধর্মীয় এবং সামাজিক শাসনগুলোই প্রধান। আমরা দেখব যারা ফতোয়া দিয়ে বেড়ান, তারা কিন্তু ফতোয়াগুলোর নিরানব্বই ভাগই জারি করেন নারীদের বিরুদ্ধে।

পুরুষের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে তাকে বড়জোর একঘরে করে রাখা যায় কয়েকমাস। তারপর সে আবার সমাজে উঠে আসে। কোনো পুরুষকে দোররা মারার ঘটনা আমরা কখনো শুনিনি। অথচ নারীকে দোররা মেরে মাটিতে পুঁতে হত্যা করার মর্মান্তিক ঘটনাও আমরা দেখেছি। ধর্ম এবং সমাজের মিশ্রণে এই যে পেশিশক্তির দাপট তা একটি শুদ্ধ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্মাণে হুমকি বৈকি! যেসব নারী গণিকাবৃত্তি করে তাদের সমাজ পতিতা বলে আখ্যায়িত করে খুব সহজে।

প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে এই আখ্যায়ন চলছে এখনো। কিন্তু যে পুরুষ গণিকালয়ে যায় তাকে ‘পতিত বলে’ সমাজ আখ্যা দেয় না। দিতে পারে না। কেন পারে না? এতে বাধা কোথায়? আজ থেকে তিন দশক আগেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর নারীদের কর্মসংস্থান বিষয়ে নানা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা এখন ক্রমশ সরতে শুরু করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সরকারি দফতর, ব্যাংক বীমা, হাসপাতাল, ডাকঘরসহ অনেক সরকারি বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠানে এখন নারীদের কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে সামাজিক ধ্যানি-চেতনার কারণেই। সামাজিক লিঙ্গ বৈষম্যের বিভিন্ন ধাপ আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করি। ইসলাম ধর্মে এক ছেলে সন্তানের সমান পরিমাণ মালামাল দু’মেয়ে সন্তান পাবে এমন একটি রেওয়াজ ছিল। তা বিভিন্ন দেশে এখন সংস্কার করা হয়েছে।

একটি মেয়ের যদি একটি ভোট হয়, একটি ছেলেরও তেমনি একটি ভোট। তাহলে রাষ্ট্রে পৈতৃক মালামাল, সম্পত্তি পেতে বৈষম্য হবে কেন? বলা যায় বিয়ের প্রথার কথাও। একজন পুরুষ একসঙ্গে চারজন স্ত্রী রাখতে পারবে। কিন্তু একজন নারী একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখতে পারবে না। এই যে স্বীকৃত প্রথা ইসলাম ধর্মে রয়েছে, এর সহজ কোনো সমাধান আপাত দৃষ্টিতে নেই।

যদি সামাজিকভাবে মানুষ তা গ্রহণ কিংবা বর্জনে রাজি না হয়। দুই. বিতর্কিত অনেক প্রথা অনেক ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্মে সতীদাহ, অকাল বৈধব্যের পর আর বিয়ে না করা প্রভৃতি কার্যক্রম কোনো সভ্য সমাজেই গৃহীত হতে পারে না। যারা কট্টরপন্থী জুইশ (ইহুদি) ধর্মাবলম্বী, সে সমাজের নারীদের বিয়ের পরই তাদের চুল কেটে ফেলতে হয়। তারপর তাদের পরচুলা ব্যবহার করতে হয়।

স্বামীর মনোরঞ্জন ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের যাতে দৃষ্টি কাড়তে না পারে সেজন্য হাইহিল জুতা, টাইট ফিটিংস কাপড়চোপড় তারা পরতে পারে না। এমনকি প্রচলিত আছে, জুইশ ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থী পুরুষরা তাদের স্ত্রীকে সন্তান ধারণে বাধ্য করে অনেকটা বলপূর্বক। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। ইউরোপ-আমেরিকার জুইশ ধর্মাবলম্বী কট্টরপন্থীরা তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে শাদীর ব্যাপারেও পরিবারের অগ্রজদের মতামতকে চাপিয়ে দেয়। অ্যারেঞ্জড কিংবা সেটেলম্যারেজ প্রথা শুধু বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় নয়, আইরিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, জুইশ, রাশিয়ান সমাজেও আমরা প্রত্যক্ষ করি।

আর এসব সমাজের দাম্পত্য জীবনে শান্তি এবং অশান্তি দুটোই কিন্তু থেকে যাচ্ছে সমানভাবে। এসব দায় থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সমঝোতাপূর্ণ জীবনযাপন। তা যে কোনো দেশে যে কোনো সমাজেই হোক। লিঙ্গের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন। গেল কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

এক দম্পতি ডিভোর্স চেয়ে পারিবারিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। এ সময়ে স্বামী স্টেট লটারিতে পাঁচ মিলিয়ন ডলার জিতে যায়। স্ত্রী আইনানুযায়ী তার অর্ধেক দাবি করে। স্বামী বলে আমরা ডিভোর্স ফাইল যেহেতু করেছি, তাই স্ত্রী অর্ধেক অর্থমূল্য পাবে না। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচে হেরে যায় স্বামী।

মাননীয় আদালত রায় দেন যেহেতু ডিভোর্স প্রক্রিয়াটি এখনো সম্পন্ন হয়নি তাই স্ত্রী লটারির অর্ধেক অর্থমূল্যের ভাগীদার। একটি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু আইনি বিচার এবং সততা থাকলেই সমঅধিকারের বিষয়টি পূর্ণতায় রূপ নেয়া সহজ হতে পারে। আবারও ধরা যাক বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামের কথা। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের যে স্বর্ণোজ্জ্বল অবদান, তা কি সরকারিভাবে ব্যাপক স্বীকৃত হয়েছে? না, হয়নি। এমনকি যারা বীরাঙ্গনা, যারা তাদের মহামূল্যবান সম্ভ্রম হারিয়ে ছিলেন আমাদের বিজয়ের জন্য তাদের কিন্তু প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা যথার্থ সম্মান দেয়নি।

কেন দেয়া হয়নি? কেন এই দীনতা! ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা আধুনিকতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আধুনিকতার লেবাসে উগ্রতা, বেহিসেবীপনা কোনো সমাজই গ্রহণ করে না। যেসব কর্ম সমাজ কিংবা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিতে পারে তাকে তো আর ব্যক্তিস্বাধীনতা বলা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইউরোপের কিছু কিছু দেশে যৌন উগ্রতার নামে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে। যেমন অবৈধ মাদক দ্রব্যের বিক্রি লাইসেন্স নিয়ে ইউরোপের কোনো কোনো দেশে আইনি দেনদরবার চলছে।

মাদক দ্রব্য গোটা মানব জাতির জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। সে নারী কিংবা পুরুষ হোক। সমান অধিকারকামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যা নারী-পুরুষের অধিকারের নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা দেবে। মানুষ মানুষের হাতে নিগৃহীত হবে না। মানুষ মানুষের কাছে প্রতারিত হবে না।

তারপরের শর্তটি হচ্ছে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মনে রাখতে হবে সৃজনশীল বিবর্তনই মানুষকে এ জন্য সাহায্য করেছে। এর পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতাই হতে পারে সমাজ নির্মাণের মূলমন্ত্র। ---*************------------------- দৈনিক ডেসটিনি। ঢাকা।

৯মার্চ ২০০৮ রোববার প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।