আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেবার দাপটে সর্বেসর্বা

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

১. জাপানের একটি শহর থেকে একদল তরুণ-তরুণী গিয়েছিল বাংলাদেশে বেড়াতে; এখানকারই একটি ক্লাবের সদস্য ওরা, ঐ ক্লাবের সদস্যরা কিছু চাঁদা দিয়ে থাকেন ময়মনসিংহের একটি এনজিওকে। ক্লাবের নীতিনির্ধারকরা ভাবলেন যে তরুণ সদস্যদেরকে, মানে যারা এখনও ছাত্র-ছাত্রী, তাদেরকে অকুস্থলে পাঠিয়ে সমাজ/পৃথিবী সম্পর্কে কিছু শেখানো যেতে পারে। সে উদ্দেশ্যেই ওদের দশবারোজনের একটা দল গিয়েছিল বাংলাদেশের ময়মনসিংহের এক অবহেলিত গ্রামে, ওখানেই হতদরিদ্র মানুষগুলোর বাসায় হোমস্টে করেছে। যে এনজিওটিকে তাদের ক্লাব চাঁদা দেয় সেখানে গিয়ে কাজকর্ম কিভাবে চালানো হয় এসবও দেখেছে। আমার সাথে কিছুটা খাতির ছিল ঐ দলের দুচারজনের, সেই সুবাদেই দায়িত্ব পড়েছিল এই দলটিকে কিছু ব্যবহারিক বাংলা শেখাতে হবে।

দলে একজন অভিজ্ঞ সদস্য ছিলেন, নাম মারি তোইয়ামা, আমরা বলি মারি-সান (জাপানীরা নামের শেষে "সান" শব্দটা যোগ করে, আমরা যেমন বলি "জাকির ভাই" বা "শায়লা আপা" বা "জনাব আসিফ" --অনেকটা সেরকম)। অনেকদিনপর গত উইকএন্ডে মারিসানের সাথে কথা হয়, দেশের এনজিওদের প্রসঙ্গ আসে। তিনি গত ত্রিশ বছরেরও বেশী ধরে সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো এত ভালো এনজিও ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে ওঠার পরেও দারিদ্র্য দূর হয়না কেন। সে প্রসঙ্গে আমরা সবাই জানি, এখানে নতুন করে আলোচনা করেও লাভ নেই। তবে মারিসানের কথায় এনজিওব্যবসার অন্য একটা দিক সম্পর্কে টের পেলাম, টের পেলেও সেটা যে এই প্রথম টের পেলাম তা না, সেটা আমাদের মজ্জাগতই, আমরা সেটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়ে ফেলেছি।

তবে সেদিন সেই ব্যাপারটাই নতুনভাবে টের পেলাম। সেটা হলো এনজিওসেবার নামে প্রভুত্ব অর্জন এবং প্রভুত্ব প্রদর্শনের যে স্পর্ধা, সেটা আমাদের সেবক-সেবিকাদের মাঝে কিভাবে ছড়িয়ে গেছে। ময়মনসিংহেরই এক এনজিওকর্মী, যাঁর দ্বায়িত্বে যে গ্রামে জাপানীরা হোমস্টে করেছিল সে গ্রামটি ছিল। ধরা যাক এই কর্মীর নাম মালতী। মারিসান বললেন যে অফিসে যখন মালতীর সাথে দেখা হলো, তিনি ভীষন অমায়িক, হেসে হেসে বিনয়ের সাথে কথা বললেন, তাকে বেশ কর্মতৎপরও মনে হলো।

কিন্তু যখনই তাঁরা গ্রামে গেলেন, তখনই দেখা গেল মালতী নিমিষেই বদলে গেলেন, তিনি আচরণ করা শুরু করলেন পালনকর্তার মতো। যেন তাঁর দয়াতেই গ্রামটা টিকে আছে। চারদিকে সবার সাথে তার আচরণ আর হম্বিতম্বি দেখে মারিসানই পারলে ভড়কে যান। তিনচারদিন ধরেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন তাঁরা, কিন্তু কি বলবেন। "যস্মিন যদাচার" ভেবে চেপে গেলেন।

পঞ্চমদিনে একটা ঘটনা ঘটল, গ্রামেরই এক পরিবার নিয়ে, যেটা মারিসান আর ভুলতে পারলেননা। পরিবারের মহিলাটি সন্তানসম্ভবা ছিলেন, হঠাৎ করেই ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে কিছু একটা ছিল সে অজপাড়াগাঁয়ে, তবে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মী এসে অবস্থা দেখেই বলে দিল যে অন্ততঃ উপজেলা হাসপাতালে নিতে হবে। এখন বাড়ীর কর্তা হরিদাস এত টাকা পাবে কই? আনা নেয়ার খরচ আছে, হাসপাতালের খরচ আছে। হরিদাস মালতীর দিকে চায়, মালতীরও কিছু করার নেই।

বেশ ভালো পরিমাণ টাকা দরকার, অন্ততঃ দু'তিন হাজার! মালতী মারিসানের সাথে কথা বললেন বিষয়টা নিয়ে। মারিসান বললেন জাপানী দলের বাকী সবার সাথে, সবাই মিলে দু'তিনশ টাকা করে তুলে দিল মালতীর হাতে। মালতী গিয়ে দাঁড়ালেন সেই বাসার সামনে। হরিদাসকে ডাকলেন, সে বেরিয়ে আসল, টাকা নিতে, কৃতজ্ঞ হতে। টাকাটা যে জাপানীরা তুলে দিয়েছে এটা মালতী লোকটাকে বলেনি, সেকথা আবার মারিসানদের কানে তুলে দিল দোভাষী মহিলাটি।

তবে তারচেয়েও যে ব্যাপারে মারিসান বেশী আহত হলেন সেটা হলো মালতীর আচরণে। বিশেষ করে যখন সে হরিদাসকে টাকাটা দিচ্ছিল। পাঠক, একবার টাকা নেয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করুন। হরিদাস হাঁটুগেঁড়ে মালতীর সামনে বসল, দুহাত সামনে তুলে প্রণামের ভঙ্গিতে টাকাটা ভিক্ষা চাইল। তারপর টাকা হাতে নিয়ে মহাদেবী মালতীর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

খানিক পরে উঠে গিয়ে স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবার জোগাড়যন্ত্র শুরু করল। ২. মারিসান বাঙালী নন, আবারও যস্মিন যদাচারের মতোই ব্যাপার ঘটল, মানে "যে দেশে যেরকম ভাবে"। তিনি জাপানে ফিরে এসে রিপোর্ট করলেন ক্লাবে, সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মিস মালতীর নিশ্চয়ই শিক্ষার অভাব। তাকে জাপানে এনে শেখাতে হবে লিডারশীপ কাকে বলে, লীডারশীপ মানে ঈশ্বর বনে যাওয়া না, লিডারশীপ মানে বাকী সবার দায়িত্ব নেয়া -- এটা মিস মালতীকে পদে পদে শেখাতে হবে। ভগবানের লীলা বোঝা ভার, এরকম বাজে আচরণের কারণে মানুষের হয় শাস্তি, আর মালতীর গেল কপাল খুলে।

তাকে একবছর জাপানে এনে ট্রেনিং দেয়া হলো, যে টাকাটা গরীবের জন্য ব্যবহার হতে পারত সে টাকাটা ক্লাব ব্যবহার করলো মালতীর শিক্ষার জন্য। তারা ভেবেছিল প্রশিক্ষিত হয়ে মালতী যখন দেশে ফিরে যাবে, তখন সে এর চেয়ে বেশী আউটপুট দেবে। জাপানে এনে একবছর তাকে লীডারশীপ নিয়ে বেশ কিছু ওয়ার্কশপ করানো হলো। নানান জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। স্কুল পরিদর্শনে নিয়ে গিয়ে দেখানো হলো হেডমাস্টারের ঘরে যখন কেউ অতিথি হয়, তখন হেডমাস্টার নিজে চা ঢেলে অতিথিকে আপ্যায়ন করছেন।

ক্লাবের প্রধানকে দেখা গেল একই গাড়ীতে অন্যদের সাথে গাদাগাদি করে কোনভাবে বসেছেন, অথবা মন্দিরে নিয়ে দেখানো হলো পুরোহিত নিজ হাতে পরিস্কার করছেন উঠোন। এমনকি তাকে শহরের মেয়রের সাথে দেখা করানোরও ব্যবস্থা করে ফেললেন এক সদস্য, মেয়র নিজ হাতে তাকে চা ঢেলে আপ্যায়ন করেন। আর সবার বিনয়ী ব্যবহার তো বলাই বাহুল্য। আরো দেখানো হলো কিভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ক্লাবের সদস্যরা মিলে হোমলেসদের সাহায্য করে, যখন কাপড় বিলাতে যায়, তখন হোমলেস লোকটার গায়ে কাপড়টা ঠিকমতো লাগল কিনা সেটা চেক করে, আনন্দে জড়িয়ে ধরে। আবার কোনকোন শীতের রাতে হয়ত হোমলেসদের মাঝে কমলা বিলানো হয় (কমলা ঠান্ডা রোধ করে), হোমলেস লোকটার পাশে বসে সেই কমলার এক-দুই কোয়া আবার যে বিলাচ্ছে সেই খাচ্ছে আর তার গল্প শুনছে।

সবই দেখানো হলো, মালতীকে সবার সেবাই দেয়া হলো। তাকে শেখানোর চেষ্টা করা হলো যে "দেখ, তোমার চেয়ে কত উঁচু পদমর্যাদার লোক কিভাবে আচরণ করে, তাই তোমার কি করা উচিত। " মারিসানের এসব কথা শুনে আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল? আমি মৃদু হেসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনার কি মনে হয় সে কিছু শিখেছে। " মারিসানও মৃদু হাসলেন, বললেন, " কয়েক বছর আগে আবারও গিয়েছি ময়মনসিংহে, মালতীকে দেখেছি, কিছুই বদলায়নি। " আমি বললাম, "গিয়ে দেখুন এখন সে বলছে, 'জানিস!! জাপানী মেয়রও আমাকে সম্মান করে!!!'" মারিসান অসহায় হাসি হাসেন।

সবশেষে যেটা বলেন সেটা হলো, এই মিস মালতীও একসময় হরিদাসের অবস্থাতেই ছিল, আজ কেন সে সব ভুলে যায়? মালতীরা কি জানেনা, তারা প্রত্যেকে একেকজন মাদার তেরেসা হতে পারত?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.