আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদিশার আত্মজীবনী: এরশাদ ও ভায়াগ্রা

৭১ এ ছোট ছিলাম, যুদ্ধে যেতে পারি নাই, এই আক্ষেপ ফুরাবার না

এই সময়ই আমার চিকেন পক্স হয়। শারীরীক এই সমস্যার পাশাপাশি দেখা দিল মানসিক চাপ। আর এই চাপ এলো রওশন এরশাদের কাছ থেকে। এরশাদের কাছে শুনতাম, প্রতিদিনই বাসায় তার সঙ্গে ঝগড়া করছে রওশন। নিজেকে খুবই তুচ্ছ মনে হলো।

আমার জন্যই বুঝি বৃদ্ধ এই লোকটি নিজের সংসারে প্রতিনিয়ত ঝামেলায় পড়ছে। অথচ আমি তো এটা চাই নি। সামাজিক স্বীকৃতির জন্য আমি কোন পীড়াপিড়ি করিনি। বিয়ে করতে তখনই রাজী হয়েছি, যখন সে জানিয়েছে তার আগের স্ত্রীকে সে ডিভোর্স দিয়েছে। এখনো সে বলছে একই কথা।

বলছে, ‘ডিভোর্স দিয়েছি, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে প্রকাশ করতে পারছি না। ’ বলছে বটে, কিন্তু এর সঙ্গে তার জীবন যাপনের কোন সামঞ্জস্যই খুঁজে পাচ্ছি না। রাতে সে এখনো তার ওই বাসাতেই থাকে। আমার এখানে আসে দিনে, তাও আবার তার সুযোগ সুবিধামত। লোকজন বলাবলি করে, আসলে সে তার আগের স্ত্রীকে মোটেই তালাক দেয়নি।

তা’হলে আমার অবস্থানটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই দ্বিতীয় স্ত্রী’র মতই। কিন্তু আমি এটা চাই নি। আমি শুরু থেকেই বলেছি, ‘স্বামী কে শেয়ার করতে পারবো না। তারচেয়ে বরং বয়ফ্রেন্ড হয়ে আছো, তাই থাকো। ’ সে ই জোর করেছে বিয়ের জন্য।

সে তার সন্তানকে বৈধতা দিতে চায়। আমি বললাম, “এভাবে চলতে পারে না। তুমি রাতে থাকবে ওই বাসায়, আর দিনে খেতে আসবে আমার কাছে- এটা হয় না। দুই নৌকায় পা রাখতে পারবে না। যে কোন একটা বেছে নাও।

” এরশাদ বললো, “বিদ, বিদ, তুমি রাগ করো না। আর মাত্র কয়েকটা দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি সব ঠিক করে ফেলবো। ” কিন্তু কিভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে, অথবা কিভাবে সে সবকিছু ঠিক করে ফেলবে- তার কোন ব্যাখ্যাতেই যায় না। পত্রিকায় এদিকে যেসব আবোল তাবোল আর অশ্লীল কথাবার্তা লেখা হচ্ছে- তা নিয়েও নেই তার কোনই মাথাব্যাথা।

আমার মহাবিরক্ত লাগছিল। বললাম, “আমি আর এখানে থাকবো না। লন্ডন চলে যাচ্ছি। ” এই বলে এরিককে নিয়ে আমি চলে গেলাম। লন্ডন যেয়ে ঠিক করলাম, অনেক হয়েছে আর ফিরে যাচ্ছি না বাংলাদেশে।

এখন থেকে থাকবো এখানেই। আমার ভাড়া দেয়া বাড়িগুলো থেকে কেনসিংটনের ক্রমওয়েল রোডের বাড়িটি খালি করলাম। এখানেই থাকবো এখন থেকে। এ সময়েই এরশাদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য উদঘাটিত হলো আমার কাছে। এরশাদকে নিয়ে যে বাসায় ছিলাম গত কয়েক মাস, সেটা তখনও ছেড়ে দেয়া হয়নি।

ওটা আসলে এক বছরের জন্য নিয়েছিলাম। এবার যখন নিজের বাড়িতেই উঠবো ঠিক করেছি, তখন ওই বাসার আসবাবপত্র নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দিল। আমি আর প্যাট্রিসিয়া একদিন গেলাম সব কিছু গোছগাছ করতে। সবকিছু গোছানোর শেষ পর্যায়ে প্যাট্রিসিয়া কার্পেটটা পরিস্কার করছিল ভ্যাকুয়াম কিনার দিয়ে। হঠাৎ খট্ করে কী একটা শব্দ হলো কিনারের মধ্যে।

কিছু একটা শক্ত জিনিস ঢুকলো ভিতরে। কী হতে পারে? প্যাট খুললো কিনারটি। ভিতর থেকে যে জিনিসটা পাওয়া গেল তা দেখে আমরা দু’জনেই হতবাক। নীল রঙের একটা ট্যাবলেট, ভায়াগ্রা! এখানে এটা এলো কীভাবে? প্যাট আমার মুখের দিকে তাকালো। যেন জানতে চাইলো-‘এরশাদ যে ভায়াগ্রা খেতো, বিষয়টা আমি জানি কিনা?’ আমিও অবাক।

আমি আসলেই কিছু জানি না। আমি শেষ চেষ্টা করলাম। “না, এটা এরশাদের হতে পারে না। ও ভায়াগ্রা খাবে কেন? ওর তো হার্টের সমস্যা আছে। এটা হয়তো অন্য কেউ এনে থাকবে।

” প্যাট হাসলো। বললো, “আর কত বিদ? আর কত নিজেকে প্রবোধ দেবে? এই বাসায় এরশাদ ছাড়া আর কোন পুরুষ মানুষ কি ছিল? তাছাড়া একটি মাত্র ট্যাবলেট পেলে না হয় কথা ছিল, এতগুলো ট্যাবলেট কে লুকিয়ে রাখবে?” ততণে আরও অনেক ক’টি ভায়াগ্রা উদ্ধার হয়েছে কার্পেটের নিচ থেকে। আমি আর কী বলবো? আমার মাথা ঘুরতে থাকলো। মনে হলো এতদিন যে বিশেষ যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এরশাদ আমাকে মুগ্ধ করেছে, সেটা আসলে সবটাই মিথ্যা! এ ক্ষেত্রেও নির্মমভাবে প্রতারিত হয়েছি! প্যাট বললো, “বিদ, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, এই বয়সের একটা লোকের পক্ষে সেক্সুয়ালি ক্যাপাবেল হওয়া সম্ভব নয়। তুমি তা মানতে চাও নি।

এবার দেখলে তো। পুরোটাই ফাঁকি। ” আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এরশাদকে আমি বিয়ে করে ফেলেছি। সকলের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে, সবকিছু ছেড়ে, নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছি এই লোকটিকে।

এখন এসব প্রকাশিত হলে সবার কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারবো না। তাছাড়া আরও একটা চিন্তা এসে গেল। শত হোক এই লোকটা আমার স্বামী। এতদিন একসঙ্গে থাকতে যেয়ে এতটুকু অন্তত টের পেয়েছি- সাংসারিক জীবনে এর আগে সে কখনো সুখ পায়নি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, বৃদ্ধ এই বয়সে আমাকে আঁকড়ে ধরে শান্তি পেতে চেয়েছে।

কে জানে, আমাকে ধরে রাখার জন্যই হয়তো ভায়াগ্রা খেয়েছে। ভেবেছে, আমার বয়স কম, এই চাহিদাটা মেটাতে না পারলে হয়তো তাকে ছেড়ে যাবো, তাই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও করেছে কাজটা। কে জানে ততদিনে হয়তো লোকটির প্রতি এক ধরণেরও মায়াও আমি অনুভব করতে শুরু করেছি। তাই মনে হলো, এভাবে চলতে থাকলে ও তো মারা যাবে। তাগিদ অনুভব করলাম তাকে এ পথ থেকে ফেরানোর।

ওদিকে প্যাট তখন রীতিমত ক্ষেপে গেছে। বললো, “বিদ, এখনই ফোন করো এরশাদকে। না হলে নাম্বার বলো, আমি কথা বলি। ” তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলাম। প্যাটকে আমি চিনি।

ওর মুখে কোন পর্দা নেই। এরশাদকে হয়তো যা তা বলে বসবে। টেলিফোনে এরশাদকে সব বলতেই সে উত্তর দিতে যেয়ে আমতা আমতা করতে থাকলো। আমি বললাম, “তা’হলে সবই ছিল নাটক, প্রতারণা? আমাকে এভাবে ঠকাতে পারলে?” এরশাদ কেবল বলতে পারলো, “প্লিজ বিদ, টেলিফোনে এসব কথা বলো না। জানোই তো, আমার টেলিফোন টেপ হয়।

গোয়েন্দারা সব শুনছে। ” “শুনুক, তাদের সব কিছু শোনা দরকার। সারা দেশের মানুষের শোনা দরকার। এভাবে একটা মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে সবার কাছে তুমি বাহদুরি করে বেড়াবে, এ প্রতারণা সবার কাছে প্রকাশিত হওয়া দরকার। ” ওপাশ থেকে এরশাদ কেবল ‘প্লিজ, প্লিজ’ করতে পারলো।

এক পর্যায়ে প্যাট আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিল। প্যাট এরশাদের উপর আগে থেকেই যথেষ্ট বিরক্ত। সে আমার অনেক পুরানো এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যখন সিঙ্গাপুরে ছিলাম, লা-সালে আমরা এক সঙ্গে পড়তাম। ওর বাড়ি সিঙ্গাপুরে।

খুবই বড়লোকের মেয়ে। চরিত্রগতভাবে সোজাসাপ্টা ধরণের, উচিত কথা মুখের উপর বলে দেয়। গত কয়েক বছর ধরেই সে লন্ডনে থাকছে। প্যাটের কথা আমার কাছে এরশাদ আগেই বহুবার শুনেছে। তাই মাস কয়েক আগে আমরা যখন লন্ডন থাকছিলাম তখন প্যাটকে ডিনারে দাওয়াত করি।

হোটেলে খাওয়ার টেবিলে আলাপ করতে করতে এরশাদ তার বাহাদুরীর গল্প শোনাচ্ছিল প্যাটকে। এক কালে সে কত হ্যান্ডসাম ছিল, মেয়েরা তার জন্য কী রকম পাগল ছিল, প্রেসিডেন্ট থাকা কালে মেয়েরা-গৃহবধুরা তার সঙ্গে বিছানায় যাবার জন্য কতটা ব্যাকুল ছিল, একবার কেউ গেলে বারবার যাবার জন্য তাকে কতটা বিরক্ত করতো- এই সব কাহিনী! দৃশ্যতই প্যাট খুব বিরক্ত হচ্ছিল। আমিও বিব্রত বোধ করছিলাম। শেষে এরশাদ বয়ান করতে থাকলো- কিভাবে, কোন বিশেষ যোগ্যতায় সে জয় করে নিয়েছে আমাকে। এ পর্যায়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি প্যাট, কিছুটা রূঢ়তার সঙ্গেই তার বিরক্তি প্রকাশ করেছিল।

যতদূর মনে পড়ে সেদিনের সেই ডিনারটি তেমন একটা জমেনি। তখন থেকেই এরশাদ এবং প্যাট পরস্পরকে পছন্দ করতো না। এরশাদ বলতো, “তোমার এই বন্ধুটি অভদ্র। ” তো, সেই অভদ্র বন্ধুটিই আমার হাত থেকে এক পর্যায়ে ফোনটি নিয়ে নিল। শুরু হলো এরশাদের সঙ্গে তার আলাপচারিতা।

এমনভাবে আক্রমণ করতে থাকলো সে, শুনে আমারই কান গরম হয়ে যাচ্ছিল। এ ঘটনার পর ঢাকায় ফিরে আসা এবং এরশাদের স্ত্রী হিসাবে সমাজে নিজের পরিচিতি তৈরি করার আর কোন আগ্রহই থাকলো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কী ভেবেছিলাম, আর কী হলো। ভেবেছিলাম বাকীটা জীবন জন্মভূমি বাংলাদেশে কাটিয়ে দেব, বাংলায় কথা বলবো, হাত দিয়ে ভাত খাবো।

যে মাটিতে জন্ম হয়েছে- সেখানেই হবে মৃত্যু। কিন্তু সেটাও বুঝি ভাগ্যে নেই। এরপর এরশাদ আমাকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করেছে। আমি ফোন ধরিনি। দিন কয়েক পরে একদিন জেবিন এলো।

সে জানালো অনেক কথা। এরশাদকে তার বড় স্ত্রী রওশন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এক কাপড়ে, একটি মাত্র ব্রিফকেস নিয়ে সে এসে উঠেছে বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে। অর্থাৎ আমার বাসাতেই থাকে এখন সে। জেবিনকে অনুরোধ করেছে আমাকে যেন বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়।

ওকে বলতে বলেছে, ‘যা হয়েছে, তা আর হবে না। এখন থেকে সে কেবল আমারই, আমার কথা মতই চলবে বাকী জীবন। ’ মনে হলো, ঠিক আছে- তাহলে না হয় আর একবার চেষ্টা করে দেখি চলবে??

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।