আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদিশার আত্মজীবনীর সবচেয়ে মুখরোচক অংশটুকু পড়ুন

৭১ এ ছোট ছিলাম, যুদ্ধে যেতে পারি নাই, এই আক্ষেপ ফুরাবার না

কুকুরের লেজ ঢাকায় এলাম আমি আগে। আমি এবং এরিক, সরাসরি লন্ডন থেকে। শাদ থেকে গেল। ওখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম ওকে। আর এরশাদ এলো সপ্তাহখানেক পরে।

লন্ডন থেকে দুবাই, দুবাই থেকে ভারত, এবং তার পর দেশে। ৫ মাসেরও বেশি সময় এবার সে দেশের বাইরে। ভয় তার-দেশে ফেরা মাত্র তাকে এরেস্ট করা হতে পারে। এর আগে এই খালেদা জিয়ার শাসনামলেই জেলে ঢুকানো হয়েছিল তাকে। সেবার টানা ছয়টি বছর জেলে থাকতে হয়েছে।

জেলকে বড় ভয় তার। তাই এবার যাতে আবার জেলে যেতে না হয়, সেজন্য লন্ডনে থাকতে বহু দেন দরবার করেছে সে। ভারত, পাকিস্তান আর সৌদী আরবের অনেক লোকের সঙ্গে একাধিক মিটিং হয়েছে। এ সময়ই প্রথম আমি ‘র’, ‘আইএসআই’- এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই। বিভিন্ন পরে সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পর যখন সে নিশ্চিত হয়েছে যে, দেশে ফিরলে তাকে গ্রেফতার করা হবে না, তখনই উদ্যোগ নিয়েছে ফেরার।

তারপরেও আমাদের মনে একটা ভয় ছিল। যেদিন তার ফেরার কথা, সকাল থেকেই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই এরশাদ আমাকে ফোন করলো। জানালো, কোন সমস্যা হয়নি। প্রেসিডেন্ট পার্কে আমি তখন তিন তলায়।

সেই যে পারিবারিক গোলযোগের কথা বলে ৬ তলা থেকে আমাকে নেমে যেতে বলা হয়েছিল, তারপর থেকে তিন তলায় আমার কেনা ফাটেই আছি এরিককে নিয়ে। সেদিনই বিকালে এরশাদ এলো আমার বাসায়। দেশে আসার পরই এরশাদ আবার বললো, “আমরা তিন তলায় নয়, ছয়তলায় থাকবো। ” তারপর সেই মত সে সব ব্যবস্থা করতে লাগলো। রাজনীতিতে এরশাদ তখন নিতান্তই গুরুত্বহীন।

সে নিজে নির্বাচনে অংশই নিতে পারেনি। তার দল মাত্র যে ১৪টি আসন পেয়েছে, সেগুলোও জাতীয় রাজনীতির প্রেেিত কোনই কাজে লাগছে না। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেরাই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে। এদিকে রওশন এরশাদ এমপি হওয়ার কারণে সংসদে জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে তার কাছে। এতসব কারণে রাজনীতি নিয়েও এরশাদের তখন আর আগের মত ব্যস্ততা নেই।

এ সময়টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে সামাজিকভাবে আমাকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য। আমি বললাম, “এর আর কী দরকার। বিয়ে তো আমাদের হয়েই গেছে। আমরা একসঙ্গে এক বাসায় থাকলেই পারি। ” তার কথা, “এর জন্যই তো আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা দরকার।

” এরমধ্যে ৬ মার্চ আমার জন্মদিন এসে গেল। মাত্র ৫ দিন পরে ১১ মার্চ এরিকের জন্মদিন। আমি বললাম, “এক সপ্তাহে দু’টি অনুষ্ঠান না করে বরং এরিকেরটাই ঘটা করে পালন করি। ” এরশাদ রাজী হলো। ততদিনে আমি আবার উঠে এসেছি প্রেসিডেন্ট পার্কের ছয় তলার ফাটে।

সেখানেই আয়োজন করা হলো অনুষ্ঠানের। এরশাদের ভাই জিএম কাদের, তার এক বোন, এমপিদের মধ্যে মশিউর রহমান রাঙা, তাজুল ইসলাম- এরা এলেন। এরশাদের অনেক বন্ধুবান্ধবকে দেখলাম। আর এলেন বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা। ফটো সাংবাদিকদের মধ্যে রেকু ভাইকে এলেন।

রেকুভাই তখন জনকণ্ঠে। রেকুভাইকে অনেকদিন পর দেখলাম। খুবই ভালো ফটোগ্রাফার, সেই সঙ্গে ভালো মানুষ। এরশাদের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর তেমন একটা আসেননি আমার কাছে। এছাড়া আমার কয়েকজন পুরানো বন্ধু বান্ধবও এলো।

জন্মদিনে এরিককে একটা কালো রংয়ের প্রিন্স কোট পরানো হলো। আমি পরলাম লাল ও খয়েরি রঙের একটি চুনরি প্রিন্টের শাড়ি। এরিককে দেখে জিএম কাদের খুশি হলো বলে মনে হলো না। অনুষ্ঠানে এরশাদ ছিল খুবই হাসিখুশি। হঠাৎ আমার এক পুরানো বন্ধু বললো, “কী ব্যাপার, এরিকের জন্মদিনে পিটার এলো না? কই এরিকের বাবা কই?” এই কথাটি বোধকরি এরশাদের খুবই লাগলো।

সে বললো, “এরিক তো আমার ছেলে। বিদিশার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমিই এরিকের বাবা। ” এরশাদের কথায় পুরো বাসায় যেন বজ্রপাত হলো। সবাই থমকে দাঁড়ালো।

সেখানকার অনেকেই, বিশেষ করে তার আত্মীয়স্বজন এবং দলীয় লোকেরা, জানতো যে এরশাদই এরিকের বাবা। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি সে এভাবে দেবে, তা ভাবেনি তারা কেউই। এরশাদের ঘোষণার পর সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। রেকু ভাই একের পর এক তুলতে লাগলেন আমাদের বিভিন্ন ভঙ্গীর ছবি। পরদিন পত্রিকাগুলোয় এরিকসহ আমার ও এরশাদের ছবি প্রকাশিত হলো।

সেই সঙ্গে রিপোর্ট। রিপোর্টগুলো পড়তে যেয়ে আমি অবাক। রীতিমত নাটক এক একটা! কে কার চেয়ে বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে পারে- তা নিয়ে পরবর্তী কয়েকদিন পত্রিকাগুলোর মধ্যে যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। একটা পত্রিকা তো এর মধ্যে আবার আমার আব্বা আম্মাকেও টেনে আনলো। তাদের ব্যক্তিগত জীবন যাপন নিয়ে প্রকাশ করতে থাকলো উদ্ভট সব কল্পকাহিনী।

এমনিতেও আমার পত্র-পত্রিকার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই, তার উপর আবার বাংলা পত্রিকা। বাংলা আমি তখনও ভালভাবে পড়তে পারি না। কাজেই কোন পত্রিকায় কী লেখা হলো সেটা আমার পড়া হচ্ছিল না। কিন্তু সে খবরগুলো আমার কানে দেয়ার লোক ছিল অনেক। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন এমনকি পার্টির লোকেরা পর্যন্ত কোথাও কিছু প্রকাশিত হওয়া মাত্র জানিয়ে দিত আমায়।

আজগুবি সব খবরের কথা শুনে শুনে আমার মাথা ঝিম ঝিম করতো। এরশাদকে বললাম, এসব আজগুবি রিপোর্টের প্রতিবাদ করতে। কেউ কিছু না বললে, ওদের এই অত্যাচার চলতেই থাকবে। কিন্তু এরশাদ কিছু বললো না, কিছু করলোও না। চুপচাপ থাকলো।

তার যুক্তি হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে ওদের উৎসাহ আরো বেড়ে যাবে। তখন তারা আরো লেখতে থাকবে। তার এই যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো। এর মধ্যে কোন একটি পত্রিকায় লেখা হলো, এরশাদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এরিকের জন্মের পরে। এটি পড়ে এরশাদের পিএস রেজা বললো, “স্যার আপনাদের ইংল্যান্ডের বিয়ে চলবে না।

ওই বিয়ে তো করেছেন মাত্র দু’মাস আগে। কমপে এক বছর আগের বিয়ে দেখাতে হবে। ” বিষয়টি এরশাদের মাথায় ঢুকলো। রেজা, হাজী আবু বকর এদেরকে চারদিকে পাঠানো হলো কোন কাজী অফিসের এক বছর আগের কোন খালি পাতা জোগাড় করার জন্য। এরকম খালি পাতা নাকি অনেক কাজী ইচ্ছা করেই রেখে দেয়, পরে বেশি টাকার বিনিময়ে সেখানে ব্যাকডেটে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে।

এরশাদ প্রতিদিনই খবর নেয়, আর রেজারা শোনায় ব্যর্থতার সংবাদ। প্রতিটি ব্যর্থতার সংবাদ এরশাদের জেদ আরও বাড়িয়ে দেয়। শেষে এরশাদ ঘোষণা করলো, যত টাকা লাগুক ব্যাক ডেটে বিয়ে দেখাতে হবে। দেশের সব কাজী অফিসে খোঁজ নিতে বললো সে তার চামচাদের। শেষে পাওয়া গেল বাড়ির পাশে কেরানীগঞ্জে।

জিঞ্জিরার কোন এক কাজীর খাতায় নাকি ঠিক এক বছর আগের তারিখে একটা পাতা খালি আছে। কাজীসহ রেজিস্ট্রি খাতা নিয়ে আসা হলে প্রেসিডেন্ট পার্কে। সেটা ২৭ মার্চ, ২০০২ এর কথা। আয়োজন করা হলো আমার দ্বিতীয়বার বিয়ের। এরশাদ আমাকে বুঝালো, আগের বিয়ে দিয়ে এরিকের বৈধতা প্রমাণ করা যাবে না।

অন্তত এরিকের কথা ভেবে যেন আমি রাজী হই। আমি আর আপত্তি করলাম না। আবার বিয়ে, এক মুরগী দুই বার জবাই হলো। বিয়েতে আমার ছোট বোন তৃষা এবং তার স্বামী ছিল। তৃষার স্বামী হলো আমার পরে সাী।

উকিল হলেন জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ আনওয়ার হোসেন। এই লোকটি দৈনিক জনতার সম্পাদক। পরবর্তীতে বহুবার তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমাকে ‘মা মা’ বলে ডাকতেন। খুবই ভদ্রলোক।

বিয়েতে সাী হলো রেজা এবং হাজী আবুবকর। বিয়েতে বর কনের নাম লেখার সময় দেখলাম আগে বিয়ে হয়েছিল কিনা- সে সংক্রান্ত একটি ঘর আছে। আমার ক্ষেত্রে সেই ঘরে ‘ডিভোর্সী’ লেখা হলো। কিন্তু এরশাদের ক্ষেত্রে ঘরটি ফাঁকা রাখা হলো। বিয়েতে কাবিন কত ধরা হয়েছিল? আমার এই মুহূর্তে ঠিক মনে নেই।

এক লাখও হতে পারে, আবার দুই লাখও হতে পারে। তবে এতটুকু মনে আছে যে, সেই কাবিনের মধ্যে আবার একটা বড় অংশ ওয়াশিল হিসাবে দেখানো হয়েছে। মার্চের ৬ তারিখে আমার জন্মদিনে এরশাদ আমাকে একটা গহনা দিয়েছিল। সেটাকেই নগদ ওয়াশিল হিসাবে দেখানো হলো (চলবে.....)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।