আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বায়নের বার্ড ফ্লু, বার্ড ফ্লু'র বিশ্বায়ন এবং দরিদ্র খামারীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম

munirshamim@gmail.com

এক. ক্রমবর্ধমান বার্ডফ্লূর সংক্রমনের আশংকায় সারা বাংলাদেশ এখন আতংকগ্রস্ত। এ আতংক প্রতিদিন বাড়ছে। ক্ষিপ্রগতিতে, চারিদিকে। শহর থেকে গ্রামে। আবার গ্রাম থেকে শহরে।

মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে, উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে। নিম্ববিত্ত, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ, যাদের বছরে দু'একবার বয়লার মুরগীর মাংস খাওয়াতো দূরে থাক, প্রতিদিন দু'বেলা লবন-ভাত-পানি জোগাড় করার দুর্ভাবনায় কেটে যায় সকাল-সন্ধ্যা, এমনকি নির্ঘূম রাত্রি, তারাও বার্ড ফ্লু আতংকের বাইরে নেই। বরং বার্ড ফ্লূর সম্ভাব্য ভিকটিম তারাই হবে। বয়লার মুরগীর মাংস খেয়ে নিজস্ব পুষ্টি চাহিদা না মেটাতে পেরেও নিরাপদ বাসস্থান, জীবন-যাপন এর সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং স্বাস্থ্য তথ্যে প্রবেশাধিকার না থাকার কারণে। প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশের বিকৃত এবং অতিনাগরায়ন প্রক্রিয়ায় দূর্বল এবং অস্বাস্থ্যকর বর্জব্যবস্থাপনার হাত ধরে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হচ্ছে প্রধানত 'নাগরিক কাক', অন্যান্য প্রাণী এবং পাখিকূল।

তারপর প্রকৃতির চিরায়ত অতি সরল নিয়মে শ্রেণীবিণ্যাসিত পক্ষপাতপূর্ণ রাষ্ট্র কাঠামোয় পক্ষপাতহীনভাবে বার্ড ফ্লু আতংক উন্মুক্ত হচ্ছে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য। ধনী ও দরিদ্রের জন্য। শহর ও গ্রামের জন্য। নারী ও পুরুষের জন্য। শিশু ও বৃদ্ধের জন্য।

তবে প্রাথমিক এ আতংকগ্রস্ততা শ্রেণী নিরপেক্ষ হলেও বার্ড ফ্লুর সম্ভাব্য আর্থনীতিক ও সামাজিক ফলাফলটি কোনভাবেই শ্রেণী নিরপেক্ষ হবে না। বাংলাদেশের দরিদ্র খামারি সহ প্রান্তিক জনগণ, এমনকি মধ্যবিত্তের জন্য মূল দুঃসংবাদটি এখানেই। দুই. ধনী পুঁজিবাদী দেশগুলোর প্রত্যক্ষ উপনিবেশ তৈরি করে লুন্ঠনের প্রক্রিয়াটি ২য় বিশ্বযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ক্রমাগতভাবে বন্ধ হয়ে যাবার পর লুন্ঠনের নতুন প্রক্রিয়ার বিদ্যাজাগতিক টেবলেট হিসেবে আবির্ভূত হয় বিশ্বায়ন। শোষণের আরও শক্তিশালী ফলিত ফর্মূলা হিসেবে দরিদ্র দেশ এবং দরিদ্র মানুষদের অদৃশ্য উপনিবেশিক পুঁজিবাদী শৃঙ্খলে বন্দী করার ক্ষেত্রে দ্রুত ডাল-পালা গজিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিটি প্রান্তিক দেশে আর্থনীতিক ও সামাজিক জীবনে এমন কিছু পরিবর্তন দেখাতে বা আনতে সক্ষম হয়েছে যা আপাত: সুখকর, অভিনব বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

বিশ্বায়ন বিশ্বপুঁজিবাদের লুন্ঠন প্রক্রিয়ার স্বার্থেই মানুষের রুচি, খাদ্যাভ্যাস সব কিছুতে তৈরি করেছে বিভিন্ন আরোপিত বৈচিত্রহীন ফর্ম। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংস্কৃতি, জীব-বৈচিত্রময়তা, মানুষের রুচি-অভ্যাস কোন কিছুকেই বিবেচনায় আনা হয় নি। গত দু'দশকে বাংলাদেশে দ্রুত বিকশিত পোল্ট্রি শিল্প তারই একটি জলন্ত উদাহরণ। তিন. বিশ্বায়নের মোড়কে 'ক্রস-ব্রডার ইকোনমি' এবং বাজার উদারিকরণের হাত ধরেই আমাদের দেশে প্রবেশ করে বয়লার মুরগী নির্ভর পোল্ট্রি শিল্প। গত শতকের আশির দশকে।

কানাডা ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি শেভরণ, নেদারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানী হেনরিক্স এবং আমেরিকা ও সব শেষে ভারতের কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানী চিক (বাচ্চা) রফতানী শুরু করে বাংলাদেশে। সূচনায় দৃশ্যমান ফলাফলে আমরা পুলকিত হই খুব বেশি করে। স্বাভাবিকভাবেই। গ্রামে-শহরে খুব দ্রুত ঘটে যায় পোল্ট্রি বিপ্লব। আমাদের খাদ্যাভ্যসে পরিবর্তন আসে।

আমরা মোটামুটি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি বয়লার মুরগীর ওপর। ইতোমধ্যে আমাদের স্থানীয় জাতটিও দূর্লভ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে কোটি কোটি ডলারের মুনাফা নিশ্চিত করে প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশ বাংলাদেশের কতিপয় প্রান্তিক পুঁজিপতি ফেরিওয়ালা ব্যবসায়ীর কাছে মেধাস্বত্ত্বধিকার (পেটেনশীপ) বিক্রি করে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো কেটে পড়ে। আমরা এই ভেবে পুলকিত হইযে, আমাদের ব্যবসায়ীরা, উৎপাদকেরা স্থানীয়ভাবে 'চিক' (বাচ্চা মুরগী) উৎপাদন করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পোল্ট্রি শিল্প তার বিকাশের ধারাবাহিকতায় আক্রান্ত হতে থাকে বার্ড ফ্লু দ্বারা।

আস্তে আস্তে বিশ্বায়নের গর্ভে জন্ম নেয়া পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীক বার্ড ফ্লুরও বিশ্বায়ন হতে থাকে। বিশ্বায়নের বার্ড ফ্লুর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অভিঘাতটি লাগে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে। এ অভিঘাতটিও মূলত: বিশ্বপুঁজিবাদের মুনাফা তৈরির স্বার্থেই। তবে সেটি বুঝার জন্য হয়তো আমাদের আরও কয়দিন অপেক্ষা করতে হবে। চার. বয়লার মুরগীকেন্দ্রীক বাংলাদেশে বিকশিত পোল্ট্রি শিল্পের অভিঘাতের হাত ধরে আমাদের স্থানীয় জাতের প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে।

দেশি মুরগী হিসেবে বাজারে যেটি আসলে পাওয়া যায় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশি ও ফার্ম- এ দুয়ের ক্রস-প্রোডাকশন। তাও আবার পর্যাপ্ত নয়, সীমিত এবং বেশি দাম। যুগ যুগ ধরে বাড়িতে, সনাতন প্রক্রিয়ায় যে মুরগী আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবারগুলো উৎপাদন করেছে তা আজ খুজে পাওয়া ভার। আমাদের দেশজ জাত ধ্বংশের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানী। আবার স্থানীয় জাতটি নষ্ট করে যে পোল্ট্রি শিল্পটি বিকশিত হয়েছে সেটিও বার্ড ফ্লুর বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে এখন ধ্বংশের দ্বার প্রান্তে।

বার্ড ফ্লুর চলমান গতিটা শুধু থামানো না যায় তবে এবার শুধু এ শিল্পটিই ধ্বংশ হবে না। সাথে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট দরিদ্র খামারীরা এবং তাদের পরিবারগুলোও। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার যে সংগ্রামের স্বপ্নে মেতে উঠেছিল দরিদ্র মানুষগুলো তাদের সে স্বপ্নটা আবারও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে অন্যায্য বিশ্বায়নের অনিবার্য অভিঘাত হিসেবে। অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো বার্ড ফ্লুর প্রতিশেধক-প্রতিরোধক বাজারজাতকরণে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আবারও মুনাফা তৈরি করবে কোটি কোটি ডলারের।

মুনাফাকেন্দ্রীক পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যায্য ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ভিকটিম হিসেবে দরিদ্র দেশ ও দরিদ্র মানুষগুলোর বাঁচার সংগ্রাম বারবার হোচট খেতে থাকবে, ঠিক আমাদের পোল্ট্রি শিল্পের মতো। ( এ লেখাটি কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত হয়েছে)


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.