আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি স্বপ্ন খুনের গল্প : তৃতীয় পর্ব - স্বপ্ন নিয়ে বিপন্ন মানবতার পাশে

যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!

(রাজনীতি বিমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং আরো দুএকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ তরুণী একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল । সেই তরুণ তরুণীদের অংশ হিসাবে কয়েকটি পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করব তাদের স্বপ্ন খুনের সত্য ঘটনা ) প্রথম পর্ব - স্বপ্নের শুরু । ২য় পর্ব - স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ শুরু আমাদের কাজের সাধারণ মুলনীতি ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কিছু করা আর সেই সাথে সমাজ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক ব্যাপারগুলির দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা । কিন্তু "সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কিছু করার" সাধারণ ধারণা থেকে "মানবতার জন্য কিছু করার" মত ধারণায় আমাদের পরিবর্তন হলো দুটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে। ওয়াইল্ড পোলিও এবং অমিত অনেকেরই মনে থাকবার কথা অমিতের কথা ।

ছোট্ট যে সাহসী ছেলেটি ওয়াইল্ড পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল । ওর চিকিৎসার জন্য একসময় সারা বাংলাদেশ একত্র হয়েছিল । ওর রোগের কথা যখন প্রথম জানা যায় তখন টিভিতে ওর একটি ইন্টারভিউ দেখে আমাদের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয় । এই সাহসী ছেলেটিকে বাচাবার জন্য কি কিছু করা যায়? আমাদের মিটিং এ দ্বিমত আসলো যে আসলে আমাদের কাজের পরিধি ওর জন্য কোন উদ্যোগ নেয়াকে এলাউ করেনা । কিন্তু সে আপত্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের কাছে টিকলোনা ।

আমরা ঠিক করলাম অমিতের জন্য কিছু করবো । অমিতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলাম, অভয় দিলাম, সাথে আছি । এরপর শুরু করলাম অমিতের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা । প্রথমে চেষ্টা করলাম নিজেদের মধ্যে টাকা তোলবার । কিন্তু সেবার সাধারণ কাজগুলি করতেই আমাদের হিমশিম অবস্থা, বুঝতে পারলাম নিজেদের মধ্যে নেয়া উদ্যোগে কাজ হবেনা ।

পথে নামতে হবে, পথে নামলাম আমরা । দুটি ব্যানার লিখলাম, দুটি মাইক ভাড়া নিলাম, দুটি টেবিল আরর দশ বারোটি চেয়ার । এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু তরুণ তরুণী বসে পড়ল নিউমার্কেটের দুই গেটে (আজিমপুরের দিকের গেট এবং বলাকা গেট)। ২০০০ সালের মার্চ - এপ্রিলের কথা । প্রচন্ড গরমের মধ্যে শুরু হলো আমাদের অমিতের জন্য পথযাত্রা ।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস প্রাকটিক্যাল মাথায় উঠলো (আমরা প্রায় সবাই সায়েন্স ফ্যাকাল্টির হওয়াতে এটা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত ছিলো), আমরা সারাদিন নিউমার্কেটের দুই গেটে বসে অমিতের কথা বলি আর ওর জন্য সাহায্য চাই । আমরা কয়েকজন সারা দিন থাকলেও অনেকে পালা করে ক্লাস করে, কাজ শেষ করে আসতে লাগলো । নিজের চোখে দেখলাম মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ । সেই সাথে অবশ্য কিছু কুৎসিত রূপও দেখলাম কিছু মানুষের । আমাদের সাথে মেয়ের সংখ্যা বেশী হওয়াতেই প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হলো, তারপর অবশ্য নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরাই আমাদের কাজকর্ম নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব নিলেন।

পৃথিবীটা যে কত ছোট সেটা তখন বুঝেছিলাম, ৭ দিন ছিলাম আমরা নিউমার্কেটের দুই গেটে, এর মাঝে মনে হয় কয়েকশো পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলো । পরিচিতদের সবাই যে আবার ব্যাপারটিকে ভালো ভাবে নিলেন তাও নয় । এমনও হয়েছে যেসব শিক্ষকের ক্লাস করিনি সকালে, বিকালে তারা আমাদের নিউমার্কেটে দেখে অবাক হয়েছেন। আবার তারাই আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন । ৭ দিনের এই চেষ্টায় আমরা তুললাম ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ।

তারপর অমিতের মা এবং চাচাকে আমন্ত্রন জানিয়ে টি এস সির সেমিনার রুমে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার হাতে হস্তান্তর করলাম টাকা । অমিতের মায়ের চোখের অশ্রু আমাদের স্বপ্ন দেখায় আরো সাহস জোগালো । প্রথম আলো ও কয়েকটি পত্রিকা সংবাদটি কাভার করলো। ২০০৫ সালে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেল অমিত । তবে ও যে সংগ্রামের সাহস বুনেছিলো আমাদের মাঝে সেটি হারিয়ে যায়নি ।

শাওনকে বাচাতে যুদ্ধ অমিতের ঘটনার পর এরকম আরো অনেক অনুরোধ এসেছে আমাদের কাছে। কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো মা এরকম প্রিয়জনরা কিভাবে যেন আমাদের খুজে নিতেন । কিন্তু অনেক অনুরোধই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে কারণ বুঝতে পারছিলাম একের পর এক এই ধরনের উদ্যোগ আমাদের মুল কাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে । আমাদের চেষ্টামত সাহায্য করেছি কিন্তু তারপরও বুঝি বড় নির্মম ছিলো সেই প্রত্যাখ্যানগুলি । কিন্তু ২০০২ সালের শুরুতেই আমরা মুখোমুখি হলাম আরেক বাস্তবতার।

আরিফুল ইসলাম শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র, আমাদের নিজেদের ছেলে, কারো বন্ধু, কারো সহপাঠী ওর ক্যান্সার ধরা পড়লো । চিকিৎসার জন্য ৭-৮ লাখ টাকা দরকার কিন্তু ওর পরিবারের সেই সামর্থ্য ছিলোনা । এবার দ্বিধাহীনভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম আবার পথে নামার । ঠিক করলাম একটা বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবো শাওনের জন্য । আবার পথে নামলো "সেবা" তবে ভিন্নভাবে ।

এর আগে ২০০০ সালে আমাদের নিজেদের তহবিল সংগ্রহের জন্য পাবলিক লাইব্রেরীতে ফরিদা পারভীনের একক সঙ্গীত সন্ধ্যা আয়োজনের অভিজ্ঞতা আমাদের ছিলো, ঠিক করলাম সেটাকে কাজে লাগাবো । অনেকেই পরামর্শ দিলো ব্যান্ড শো করবার জন্য । পরিচিতও ছিলো অনেকে । কিন্তু ঠিক করলাম ব্যান্ড শো নয়, আমাদের মাটির গানকেই প্রোমোট করবো । আবারও যোগাযোগ করলাম ফরিদা পারভীনের সাথে ।

একবাক্যে রাজী হয়ে গেলেন আবার আমাদের জন্য গান গাইতে, সাথে তিনি উদ্যোগ নিয়ে রাজী করালেন বাংলা লোকগীতির সব দিকপালকে একত্র করতে । প্রিয় শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায়, রথীন্দ্র নাথ রায়, ইন্দ্র মোহন রাজবংশী সবাই একত্র হলেন এক ছায়াতলে । বাংলাদেশের মাটির গানের এই চার দিকপালকে নিয়ে আমরা "শাওনকে বাচাতে লোক সঙ্গীত সন্ধ্যা" আয়োজন করলাম শিশু একাডেমী মিলনায়তনে । এই ধরনের লোক সঙ্গীত ভিত্তিক অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি যে কত কঠিন কাজ তা যারা কখনো এ রকম প্রোগ্রাম আয়োজন করেননি তা বোঝানো যাবেনা । আমরা এক ঝাক তরুণ দিনের পর দিন ছুটে বেড়ালাম পরিচিত অপরিচিত সবার কাছে একটি টিকিট বিক্রির জন্য ।

এক একটি টিকিট তা যেই মুল্যেরই হোকনা কিন বিক্রি করা ছিলো বিশ্বজয়ের সমতুল্য । সেই আবেগ বোঝানো যাবেনা । তবে পাশে পেলাম অনেককেই । ব্যক্তিগত পরিচয়, ফরিদা পারভিনের উদ্যোগের ফলে এগিয়ে আসলো কর্পোরেট হাউজগুলি আর সি কোলা, ডেটল, লিভার ব্রাদার্স এবং এক্সিম ব্যাংককে পাশে পেলাম স্পন্সর হিসাবে । সেই সময় ঢাকার সব গুলি বড় বড় এ্যাড ফার্মে ঘুরেছি প্রতিশ্রুতিও পেয়েছি অনেক স্পন্সরের কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাইনি ।

প্রতিষ্ঠিত অনেকের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সেই সময় আমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল । তখন বুঝেছিলাম মিডিয়াতে ফরিদা পারভীন, এর মত শিল্পীরা যেমন আছেন, এর বিপরীত মানসিকতার লোকের সংখ্যাও কম নয় । এই একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলা সম্ভব । বাংলা লোকসঙ্গীতের এই চার দিকপাল শাওনের জন্য গান গাইলেন বিনা পারিশ্রমিকে । অনুষ্ঠার থেকে পাওয়া সব অর্থ আমরা তুলে দিলাম শাওনের মার হাতে ।

তখন প্রায় সব কটি পত্রিকা খুব ভালো ট্রিটমেন্ট দিলো সংবাদটিতে । আর বিশেষ করে ততদিনে পত্রিকার অনেকের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামের কারণে পরিচয়ও হয়ে গিয়েছিলো । ইন্টারনেট থেকে পাওয়া দুটি সংবাদের লিংক । আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন, সেবা সম্পর্কে এর কাজ সম্পর্কে অনেক কথা বলা আছে রিপোর্ট দুটিতে । আমাদের ছবিও আছে ।

ডেইলী ষ্টারে প্রকাশিত রিপোর্ট - Students' organization of Dhaka University holds charity musical event in aid of an ailing student, Shawon কয়েকটি লাইন ডেইলী ষ্টারের রিপোর্ট থেকে Sheba, apart from helping Shawon, has so far contributed in a large number social projects that has included distribution of warm clothes among members of homeless urban population, blood collection from university students and free donation among needy patients in various hospitals, campaign against abuse of medicine, environmental awareness, dengue fever eradication and treatment, etc. আরেকটি রিপোর্ট অনলাইন একটি সাইট বাংলামিউজিক ডট কম থেকে (বাংলা রিপোর্টগুলি অনলাইনে খুজে পাচ্ছিনা) । - A Caring Endeavour স্বপ্ন খুন হওয়াতে কষ্ট আছে, তবে এরকম স্মৃতিগুলি আবার স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগায় । (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.