আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফারুকী'র "টেলিভিশন" বনাম আমার ১৪ ইঞ্চি সাদা কালো টিভি

এই সেই ............. মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী'র টেলিভিশন দেখতে মানুষের সারি দেখে আমার ফেলে আসা ১৪ ইঞ্চি সাদা কালো টিভির কথা মনে পরে গেল। তখন গ্রামে থাকি, আমার গ্রামে তখনো টমাস এডিসনের আবিষ্কারের ছোঁয়া পৌছেনি। তাই অন্ধকার তাড়ানোর একমাত্র ব্যবস্থা ছিল কেরোসিন চালিত হারিকেন। প্রতিদিন মা-চাচীরা হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে রাখতেন আর সন্ধ্যা হলেই তাতে আগুন দিয়ে চারপাশ আলোকিত করা হতো। সেই সময় আমাদের গ্রামে বিনোদনের মাধ্যম ছিল নাটক বা পালা গানের আসর যা অনেকদিন পর পর বসত।

দৈনিক বিনোদন বলতে ছিল কেচ্ছা কাহিনী বলা বা রেডিও শোনা। যারা বয়স্ক ছিল তারা ছোটদের নিয়ে কেচ্ছা শোনাত। সেই সময় আমাদের ঘরে আনা হয় ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি। আমাদের গ্রামে তখন আর কোন টেলিভিশন ছিলো না। টেলিভিশন চালানো হত ব্যাটারি দিয়ে।

ব্যাটারির চার্জ শেষ হলে তিন মাইল দুর থেকে চার্জ করিয়ে আনা হতো। কোন দিন চার্জ করতে না পারলে তাতে গরম পানি দিয়ে বা রোদে অনেকক্ষণ রেখে দিয়ে টিভি চালানো হতো। দেশে তখন এত চ্যানেল ছিল না। স-বেধন নীলমণি হিসেবে শুধু বিটিভিই ছিল। বিটিভিতে তখন ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হতো বাংলা ডাবিং-কৃত সিরিয়াল "আকবর দা গ্রেট" "সোর্ড অফ টিপু সুলতান" "আলিফ লাইলা", নাটক বলতে ছিল হুমায়ুন আহমেদ এর "অয়োময়", বাকের ভাই খ্যাত "কোথাও কেউ নেই", তৈাকির আহমেদ অভিনীত "রূপনগর" আর এসব দেখার জন্য দুর দূরান্ত থেকে লোকজন আসত আমাদের বাড়িতে।

তখন টিভি বাড়ির ভেতর না রেখে বাহিরে বের করে দেওয়া হতো যেন সবাই অনুষ্ঠান দেখতে পারেন। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হলে গ্রামে অন্য রকম উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো। আর আমাদের বাড়ির বাহিরের উঠান হয়ে উঠত মিনি গ্যালারি। সবাই রাত জেগে থাকত খেলা দেখার আসায় আবার কেউ কেউ খড় বিছিয়ে খেলা শুরুর আগ পর্যন্ত কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিত। খেলা শুরু হলেই মিনি গ্যালারিতে শুরু হতো উল্লাস ও বিষাদের আরেক খেলা।

আর উল্লাসের উত্তেজনায় দাদার ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘুম ভাঙ্গা কণ্ঠে বলতেন "শয়তানের বাক্সের জন্য ঘুমানোও দায়। " সেই শয়তানের বাক্সের মেজাজ মাঝে মাঝে বিগড়ে যেত, আর তখন সে কাঁপাকাঁপি করে বিগড়ে দিত আমাদের মেজাজ। তারপর ডাক্তার ডেকে ঠিক করা হতো। টিভির ডাক্তারের কাছে থেকে আমিও দেখে নিতাম কিভাবে টিভির রোগ সারানো হয়, তারপর আবার কখনো টিভির সমস্যা দেখা দিলে আমিই শুরু করতাম ডাক্তারি, কখনো সফলতা আসত কখনো আসতোনা। আর যখন আমি ব্যর্থ হয়ে যেতাম তখন আবার ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আসতে হতো।

তারপর একসময় টমাস এডিসনের আবিষ্কারের ছোঁয়া আমাদের গ্রামকে ছুঁয়ে গেল। আমরা অন্ধকার থেকে মুক্তি পেলাম। মা-চাচীরা মুক্তি পেলো প্রতিদিন চিমনি মোছার যন্ত্রণা থেকে। ব্যাটারিও মুক্তি পেল গরম পানি খাওয়ার হাত থেকে। আর সেই ১৪ ইঞ্চি টিভিটি তড়িৎ পেয়েও চলল কিছুদিন।

তারপর দেখা গেল সভ্যতার সাথে সে খাপ খায় না। এখন সাদাকালোর যুগ শেষ, সবাই রঙ্গিন হতে চায়। আশপাশের সবাই ইতিমধ্যে ঐ সভ্যতায় না লিখিয়েছে। সবার ঘরে ঘরে চলে আসছে রঙ্গিন টিভি। ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টিভিটিকে দেখতে আসার লোকও কমে যেতে লাগল।

সেই মনোকষ্ঠেই কিনা টিভিটি কথা বলা বন্ধ করে দিল। সারাদিন শ্লেষ ঝরত ঝরতো তার কণ্ঠ থেকে। তারপর তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আর হাসপাতাল থেকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হলো এটি এখন কোমায় চলে গেছে, ওর চিন্তা ছেড়ে দিতে। হাসপাতালের এই ব্যবস্থাপত্র পেয়ে আমরাও তার কথা ছেড়ে দিলাম আর নাম লিখলাম সভ্যদের দলে। এখন রঙ্গিন টিভি ঝলমল করে সেই সাদাকালো টিভির স্থলে কিন্তু সেই আনন্দ সেই উৎসব আর আসেনা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.